বলি হলো স্থানীয় সরকারব্যবস্থা by তোফায়েল আহমেদ
২৮
এপ্রিলের তিন সিটি নির্বাচনে বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্র,
গণপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থা এবং সার্বিকভাবে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের
নিরুদ্দেশ যাত্রায় নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হলো। এ নির্বাচনে একমাত্র অর্জন
হচ্ছে পদবি। আর অন্যদিকে রাজনীতি ও গণতন্ত্র অন্ধকারের পথে যাত্রা করল। এ
নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল,
সহিংস ও অনিয়মতান্ত্রিকতার রাজনীতির গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি
করেছিল। কিন্তু এই নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফল সেই সুযোগের মূলোৎপাটন
করেছে।
এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় আবার নতুন করে আস্থা স্থাপন করা কঠিন হবে। এ নির্বাচনে ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্রের, আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার। জাতীয় রাজনীতির সব ভার স্থানীয় সরকারের ওপর চাপানো হয়েছিল। সে ভার সওয়ার সাধ্য তার ছিল না, ফলে তাতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষের মধ্যে একটা ব্যাপারে খুব মিল রয়েছে। তারা কেউই স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর বা শক্তিশালী করতে চায়নি বা চায় না। তাদের অভিপ্রায়ের মধ্যেও তা নেই এবং ছিল না। দুপক্ষের কৌশলেও বেশ মিল আছে। এই তিন সিটির নির্বাচন ছিল উপলক্ষ মাত্র। তারা উভয়েই জাতীয় রাজনীতির কৌশল হিসেবে স্থানীয় সরকারকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। এই কৌশলে উভয়েই জয়ী হয়েছে। বিরোধীরা এখন জোর গলায় বলা শুরু করেছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব না। তারা বলছে, এর ফলে তাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আরও ‘পাকাপোক্ত’ হয়েছে। যদিও এই স্থানীয় নির্বাচনের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। আর সরকার দাবি করতে পারবে, বিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে গেছে। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এই কৌশলের রাজনীতিতে উভয়েই জয়ী হয়েছে তা ঠিক, কিন্তু এর ফলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। সেটা আমাদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি।
কথা হচ্ছে, দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক পরাশক্তির রাজনীতিতে স্থানীয় সরকারবিষয়ক নীতিকাঠামো নেই। নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা স্থানীয় সরকারকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ এই তিন সিটি নির্বাচনে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যেমন: পাঁচ সিটির মেয়রদের দুজন কারাগারে, তিনজন পলাতক, উপজেলা পরিষদের খবর নেই, আর সেই মিছিলে যুক্ত হলো এই তিন সিটি। তবে এবার যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সরকার-সমর্থিত হওয়ায় সে সমস্যা হয়তো হবে না। তবে সিটি করপোরেশন যে খুব কার্যকর হবে, তা বলা যায় না।
এই বিজয়ে বিজয়ীদের উল্লাস নেই, পরাজিতদের মনে বেদনাও নেই। পরাজিতরা এই নির্বাচনকে কৌশলগত দিক দিয়ে নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে। তারা নতুন উদ্যমে পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে যাবে, তবে কীভাবে তারা সেটা করবে, সেটাই দেখার বিষয়। ক্ষমতাসীনদের শিরস্ত্রাণে নতুন পালক যুক্ত হয়নি, বরং তাদের কপালে কলঙ্কতিলক জুটেছে।
এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও কম। তিন সিটিতে ভোট পড়েছে মোট ৪৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। স্থানীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এটা সর্বনিম্ন। আবার এটাও যে প্রকৃত হিসাব, তা-ও জোর গলায় বলা যাচ্ছে না। এদিকে ২০১৬ সাল হচ্ছে স্থানীয় নির্বাচনের বছর, কিন্তু মানুষ ভোট দিতে আস্থা পাবে বলে মনে হয় না। স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ত্রুটিও আছে। যেমন সব আলোচনা ও ডামাডোল হয়েছে মেয়র প্রার্থীকে কেন্দ্র করে। সব আলো ছিল তাঁদের ওপর। কিন্তু কাউন্সিল প্রার্থীদের নিয়ে কেউ কথা বলেনি। অথচ তাঁরাই হচ্ছেন স্থানীয় সরকারের প্রাণ, সেই চেতনার ধারক-বাহক। ফলে এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে। আবার সহিংসতা করেছেন কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীরাই। সেটাও ঘটেছে সরকার-সমর্থিত প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। এ কারণে এসব সামাল দেওয়া যেত। আর সেটা হলে নির্বাচনকে কিছুটা কলঙ্কমুক্ত করা যেত।
অন্যদিকে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও তারা ভোটারদের দিয়েই সেটা কাটিয়ে উঠতে পারত। ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে তারা সরকারের গা-জোয়ারির জবাব দিতে পারত। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে বিরাজমান আস্থাহীনতার বলি হলো স্থানীর সরকারব্যবস্থা। এটা ক্রিয়াশীল না হলে গণতন্ত্র কখনো কার্যকর হতে পারবে না। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে বলে সেখানে নির্বাচনী গণতন্ত্র কার্যকর হয়েছে। আর সেখানে আমরা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে আরও কমজোর করে ফেললাম। এর ফলে গণতন্ত্রের যে নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হলো, তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে, আমরা তা জানি না।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।
এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় আবার নতুন করে আস্থা স্থাপন করা কঠিন হবে। এ নির্বাচনে ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্রের, আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার। জাতীয় রাজনীতির সব ভার স্থানীয় সরকারের ওপর চাপানো হয়েছিল। সে ভার সওয়ার সাধ্য তার ছিল না, ফলে তাতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষের মধ্যে একটা ব্যাপারে খুব মিল রয়েছে। তারা কেউই স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর বা শক্তিশালী করতে চায়নি বা চায় না। তাদের অভিপ্রায়ের মধ্যেও তা নেই এবং ছিল না। দুপক্ষের কৌশলেও বেশ মিল আছে। এই তিন সিটির নির্বাচন ছিল উপলক্ষ মাত্র। তারা উভয়েই জাতীয় রাজনীতির কৌশল হিসেবে স্থানীয় সরকারকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। এই কৌশলে উভয়েই জয়ী হয়েছে। বিরোধীরা এখন জোর গলায় বলা শুরু করেছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব না। তারা বলছে, এর ফলে তাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আরও ‘পাকাপোক্ত’ হয়েছে। যদিও এই স্থানীয় নির্বাচনের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। আর সরকার দাবি করতে পারবে, বিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে গেছে। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এই কৌশলের রাজনীতিতে উভয়েই জয়ী হয়েছে তা ঠিক, কিন্তু এর ফলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। সেটা আমাদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি।
কথা হচ্ছে, দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক পরাশক্তির রাজনীতিতে স্থানীয় সরকারবিষয়ক নীতিকাঠামো নেই। নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা স্থানীয় সরকারকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ এই তিন সিটি নির্বাচনে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যেমন: পাঁচ সিটির মেয়রদের দুজন কারাগারে, তিনজন পলাতক, উপজেলা পরিষদের খবর নেই, আর সেই মিছিলে যুক্ত হলো এই তিন সিটি। তবে এবার যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সরকার-সমর্থিত হওয়ায় সে সমস্যা হয়তো হবে না। তবে সিটি করপোরেশন যে খুব কার্যকর হবে, তা বলা যায় না।
এই বিজয়ে বিজয়ীদের উল্লাস নেই, পরাজিতদের মনে বেদনাও নেই। পরাজিতরা এই নির্বাচনকে কৌশলগত দিক দিয়ে নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে। তারা নতুন উদ্যমে পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে যাবে, তবে কীভাবে তারা সেটা করবে, সেটাই দেখার বিষয়। ক্ষমতাসীনদের শিরস্ত্রাণে নতুন পালক যুক্ত হয়নি, বরং তাদের কপালে কলঙ্কতিলক জুটেছে।
এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও কম। তিন সিটিতে ভোট পড়েছে মোট ৪৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। স্থানীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এটা সর্বনিম্ন। আবার এটাও যে প্রকৃত হিসাব, তা-ও জোর গলায় বলা যাচ্ছে না। এদিকে ২০১৬ সাল হচ্ছে স্থানীয় নির্বাচনের বছর, কিন্তু মানুষ ভোট দিতে আস্থা পাবে বলে মনে হয় না। স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ত্রুটিও আছে। যেমন সব আলোচনা ও ডামাডোল হয়েছে মেয়র প্রার্থীকে কেন্দ্র করে। সব আলো ছিল তাঁদের ওপর। কিন্তু কাউন্সিল প্রার্থীদের নিয়ে কেউ কথা বলেনি। অথচ তাঁরাই হচ্ছেন স্থানীয় সরকারের প্রাণ, সেই চেতনার ধারক-বাহক। ফলে এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে। আবার সহিংসতা করেছেন কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীরাই। সেটাও ঘটেছে সরকার-সমর্থিত প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। এ কারণে এসব সামাল দেওয়া যেত। আর সেটা হলে নির্বাচনকে কিছুটা কলঙ্কমুক্ত করা যেত।
অন্যদিকে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও তারা ভোটারদের দিয়েই সেটা কাটিয়ে উঠতে পারত। ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে তারা সরকারের গা-জোয়ারির জবাব দিতে পারত। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে বিরাজমান আস্থাহীনতার বলি হলো স্থানীর সরকারব্যবস্থা। এটা ক্রিয়াশীল না হলে গণতন্ত্র কখনো কার্যকর হতে পারবে না। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে বলে সেখানে নির্বাচনী গণতন্ত্র কার্যকর হয়েছে। আর সেখানে আমরা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে আরও কমজোর করে ফেললাম। এর ফলে গণতন্ত্রের যে নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হলো, তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে, আমরা তা জানি না।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।
No comments