অধিকাংশ খাতে নেই ন্যূনতম মজুরি by শাহ আলম খান
গাছের গুঁড়ি নিয়ে যাচ্ছে শ্রমিক। বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে তোলা ছবি -আনোয়ার হোসেন জয় |
যে
ব্যক্তি শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেন, আভিধানিক অর্থে তিনিই হচ্ছেন
শ্রমিক। সেই অর্থে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশায় কর্মজীবী সবাই শ্রমিক
হওয়ার কথা। কিন্তু শ্রম অধিকারের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সর্বনিু মজুরিপ্রাপ্ত
কায়িক শ্রমধারী প্রান্তিক কর্মজীবীই হচ্ছেন একজন শ্রমিক, যারা অর্থনীতির
প্রাণ এবং উৎপাদনের মূল কারিগর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশসহ
বিশ্বজুড়েই এই শ্রেণীর শ্রমিকরা সব সময় সর্বাগ্রে দলিত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত।
শ্রমের ঘনত্ব অনুযায়ী যথাসময়ে এদের ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার বিষয়টি যেন
‘স্থায়ী সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে। এটি অব্যাহত রয়েছে বাংলাদেশেও। দেশের ৬৭
খাতে শ্রম দিচ্ছেন শ্রমিকরা। এর মধ্যে ন্যূনতম মজুরি দেয়ার আনুষ্ঠানিক
ঘোষণা রয়েছে ৪৩ খাতে। তবে ঘোষণা থাকলেও এর কার্যকারিতা নেই অধিকাংশ খাতে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলা গড়ে তুলি।’ দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, মিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ সরকারি ছুটির দিন।
মে দিবস মানেই শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণের আওয়াজ। বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় দিন। প্রতি বছরই ঘুরেফিরে আসে দিনটি। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্যমূল্য এবং দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। এতে ৩ লাখ শ্রমিক অংশ নেন। আন্দোলন নস্যাৎ করতে এক পর্যায়ে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করে। নিহত শ্রমিকদের রক্তে ভিজেছিল শিকাগোর রাজপথ। শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ৬ শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় আত্মহত্যা করেন এক শ্রমিক। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। দিবসটি কেন্দ্র করে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বেসরকারি কর্মসংস্থানের খাতগুলোর সংস্কারে ব্যাপক সভা-সেমিনার ও হইচই শুরু হয়। বাধ্য হয়ে মালিকরাও তাদের কলকারখানার পরিবেশ শ্রমবান্ধব করতে কম-বেশি সংস্কার আনে। সস্তা শ্রমের কারণে বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশ এক আলোচিত নাম। তদুপরি শিল্প দুর্যোগের ইতিহাসে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সংঘটিত সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি সবার কাছে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বঞ্চিত শ্রমিকদের কাহিনী : রাজধানীর সর্বত্র এখন রাস্তাঘাট, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ চলছে। এসব কাজের জন্য ঠিকাদারের বিলবাবদ কোটি কোটি টাকা ছাড় করা হলেও সেই অর্থের খুব কম পরিমাণই যাচ্ছে শ্রমিকের পকেটে। ঠিকাদারের অধীনে মধুবাগ, মিরেরটেক ও মীরবাগে কাজ করছেন দিনমজুর শ্রমিক আবুল কাসেম, আনোয়ারা বেগম ও লাভলী বেগম। তাদের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয় শুক্রবার সকালে। তারা জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তা ভাঙাগড়ার মতো কষ্ট ও শ্রমসাধ্য কাজ করেও এই দুর্মূল্যের বাজারে দিনে তাদের মজুরি হচ্ছে- পুরুষ তিনশ’ টাকা ও মহিলা আড়াইশ’ টাকা। তাদের দাবি- যে কষ্টসাধ্য শ্রম তারা এখানে দিচ্ছেন এর ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত কমপক্ষে ৭০০ টাকা। কিন্তু সেটি তারা পাচ্ছেন না। একই দিন হোটেল শ্রমিক কুমিল্লার কাইয়ুম হোসেন জানান, রাজধানীর হাতির ঝিল সংলগ্ন একটি হোটেলে কাজ করেন তিনি। পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়েও তিনি এক বেলা খাবারসহ মাসে সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি মজুরি পাচ্ছেন না। মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এলেও মালিক সেটি কার্যকর করছেন না। একই এলাকার ওয়ার্কশপ শ্রমিক মো. সুজন ও রবীন্দ্র মজুমদার জানান, প্রকৌশল কাজে তারা যে শ্রম দিচ্ছেন, এতে তাদের যথেষ্ট মেধা খরচ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক সে শ্রম অনুযায়ী তারা পরিশ্রম পাচ্ছেন না। থাকা-খাওয়া নিজেদের বহন করা সত্ত্বেও তাদের মাসিক মজুরি যথাক্রমে আট হাজার ও ছয় হাজার টাকা মাত্র।
শ্রম পরিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকরা শ্রম দিচ্ছেন দেশে এমন খাতের সংখ্যা মোট ৬৭টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিকের উপস্থিতি। বাকি খাতগুলো হচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ খাত, ইটের ভাটা, চা শিল্প, বই বাঁধাই, রাইস মিল বা চাতাল, হস্তচালিত তাঁত, ক্ষুদ্র ও ধাতব শিল্প, তামাক শিল্প, দোকান-প্রতিষ্ঠান, ট্যানারি, টোব্যাকো, স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, হোসিয়ারি, দর্জি, স’মিল, মৎস্য ও মৎস্য খামার, রাবার, পোলট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ফেরিওয়ালা, জেলে, রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি, সেলুন, দোকান ও বিউটি পার্লার, প্রিন্টিং প্রেস, ডক অ্যান্ড পোর্ট, ফার্নিচার, সড়ক, জুট, জুট প্রস ও জুট বেলিং, খাদ্য, পাদুকা, ম্যাচ, নার্সারি, ডেকোরেটর, স্বর্ণকার, ওষুধ, পাওয়ার লুম স্পিনিং মিল, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ অন্যতম।
জানা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ও বিপুলসংখ্যক বেকার- এই ত্রিপক্ষীয় পরিস্থিতির জাঁতাকলে প্রতিনিয়ত এসব খাতের শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। এসব খাতের অধিকাংশ শ্রমিকই ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না কিংবা পেলেও এই নির্ধারিত মজুরি বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায়ই সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, দেশে মোট ৪৩টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ খাতে তা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ঘোষণাও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তা সর্বত্র পরিপালন হচ্ছে না। আমেরিকায় ১ ঘণ্টা কাজ করলে একজন শ্রমিক ৭ ডলার মজুরি পান। একইভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ২ ডলার। এভাবে দেশভেদে প্রতি ঘণ্টায় এই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের হার কোথাও আরও বেশি, কোথাও এ মাত্রার আশপাশেই।
বিলস’র সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে একেবারে উল্টোচিত্র। এখানে ন্যায্য ও ন্যূনতম মজুরি পাওয়া কিংবা দাবি করাটাই যেন অসভ্যতা। এর বাইরে শ্রমিক কল্যাণের অন্যান্য খাত যেমন শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ, প্রাপ্য ছুটিছাটা ও গ্রাচুইটি পাওয়ার অধিকার এগুলো একরকম কাগজে আইনেই রয়ে গেছে।
ওদিকে এসব খাতের অনেক শ্রমিকই আবার আত্মকর্মসংস্থানকারী যারা এসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার কল্পনাই করতে পারেন না। এই শ্রেণীর শ্রমিকরা দিনভর কষ্টার্জিত শ্রম দিয়েও শ্রমের ন্যায্য মজুরি পান না। বিশেষ করে কুলি, দিনমজুর, গৃহকর্মী কিংবা বিভিন্ন খাতের নির্মাণ শ্রমিক। আবার এই শ্রমিকদের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যও প্রকট। একই কাজে একই শ্রম দিয়ে সমমজুরি না পাওয়ার নজিরও রয়েছে অহরহ। সংশ্লিষ্ট খাতগুলো নিয়ে কাজ করেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব খাতে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিকই অশিক্ষিত ও অদক্ষ। কাজ করে শুধু গায়ের জোরে। তারা জানেন না শ্রম অধিকার কি। শ্রম আইনে তাদের জন্য কি সুযোগ রাখা আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম সচিব মিকাইল শিপার যুগান্তরকে জানান, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের জন্য রক্ষিত আইনানুগ অধিকার বাস্তবায়ন, শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি সুদৃঢ় করার পাশাপাশি তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। বিশেষ করে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্পসহ কয়েকটি খাতে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শ্রমিকরা কাজ করছে এমন সব খাতেই যাতে ন্যূনতম মজুরি একটা নিশ্চয়তা থাকে সে ব্যাপারেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে কাজ করছে।
আর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যুগ্ম মহাসচিব ও বিএনপির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জাফরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আসলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি যৌক্তিক কিন্তু অনেকটা আপেক্ষিকও। কারণ সবাই যেমন সমান কাজ করেন না, আবার সমান দক্ষও নন। এক্ষেত্রে সব খাতেই সমন্বিত হারে একটা জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হওয়াটা জরুরি। এটি করা গেলে যে খাতের শ্রমিকই হোক না কেন, জাতীয় মানদণ্ডে নির্ধারিত অংকের নিচে কাউকে স্বল্প মজুরি দিয়ে আর ঠকানো যাবে না।
দেশে মোট কর্মসংস্থানের হার বিবেচনা করলে সরকারি খাতে মাত্র ৫ শতাংশের বিপরীতে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান ঘটছে ৯৫ শতাংশ। আর উৎপাদনশীল কাজে বেসরকারি খাতের গতি সঞ্চারের প্রাণ হচ্ছেন শ্রমিকরা। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় মিলিয়ে বিভিন্ন খাতের কয়েক লাখ শিল্প-কারখানায় এসব শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নিয়োগপত্র মিলছে না। যাদের মিলছে সেখানেও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার মতো শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। তাতে থাকছে না গ্রাচুইটি পাওয়ার নিশ্চয়তা।
এ রকম নানা অসঙ্গতির ভেতর দিয়েই প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করছে দেশের অর্থনীতি। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বরাবরই এগিয়ে থাকছে এই বেসরকারি খাতগুলো। এতকিছুর পরও এখন দেশে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি বেকার রয়েছে। শ্রম অধিকার বঞ্চিত হওয়ার এটিও একটি পরোক্ষ কারণ। অর্থাৎ একজনকে বাদ দিয়ে কারখানা মালিককে আরেকজনকে পেতে বেগ পোহাতে হয় না বললেই চলে।
সরকারি শিল্প খাত বা কলকারখানার স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় লাখের মতো। এর সমপরিমাণ রয়েছেন অস্থায়ী শ্রমিক। তবে দেশের বড়, মাঝারি শিল্প-কলকারখানার ৯৮ ভাগই এখন বেসরকারি মালিকানায়। বেসরকারি শিল্প খাতের ৮০ ভাগই আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। এখানে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে নির্মাণ শিল্পে সর্বোচ্চ শ্রমিক নিযুক্ত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সারা দেশে রিকশা শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ লাখ। আর যান্ত্রিক যানবাহন শ্রমিকের সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। দেশের ৪০ হাজার রাইস মিলে কর্মরত রয়েছেন ৫ লাখেরও বেশি শ্রমিক।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলা গড়ে তুলি।’ দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, মিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ সরকারি ছুটির দিন।
মে দিবস মানেই শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণের আওয়াজ। বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় দিন। প্রতি বছরই ঘুরেফিরে আসে দিনটি। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্যমূল্য এবং দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। এতে ৩ লাখ শ্রমিক অংশ নেন। আন্দোলন নস্যাৎ করতে এক পর্যায়ে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করে। নিহত শ্রমিকদের রক্তে ভিজেছিল শিকাগোর রাজপথ। শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ৬ শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় আত্মহত্যা করেন এক শ্রমিক। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। দিবসটি কেন্দ্র করে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বেসরকারি কর্মসংস্থানের খাতগুলোর সংস্কারে ব্যাপক সভা-সেমিনার ও হইচই শুরু হয়। বাধ্য হয়ে মালিকরাও তাদের কলকারখানার পরিবেশ শ্রমবান্ধব করতে কম-বেশি সংস্কার আনে। সস্তা শ্রমের কারণে বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশ এক আলোচিত নাম। তদুপরি শিল্প দুর্যোগের ইতিহাসে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সংঘটিত সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি সবার কাছে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বঞ্চিত শ্রমিকদের কাহিনী : রাজধানীর সর্বত্র এখন রাস্তাঘাট, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ চলছে। এসব কাজের জন্য ঠিকাদারের বিলবাবদ কোটি কোটি টাকা ছাড় করা হলেও সেই অর্থের খুব কম পরিমাণই যাচ্ছে শ্রমিকের পকেটে। ঠিকাদারের অধীনে মধুবাগ, মিরেরটেক ও মীরবাগে কাজ করছেন দিনমজুর শ্রমিক আবুল কাসেম, আনোয়ারা বেগম ও লাভলী বেগম। তাদের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয় শুক্রবার সকালে। তারা জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তা ভাঙাগড়ার মতো কষ্ট ও শ্রমসাধ্য কাজ করেও এই দুর্মূল্যের বাজারে দিনে তাদের মজুরি হচ্ছে- পুরুষ তিনশ’ টাকা ও মহিলা আড়াইশ’ টাকা। তাদের দাবি- যে কষ্টসাধ্য শ্রম তারা এখানে দিচ্ছেন এর ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত কমপক্ষে ৭০০ টাকা। কিন্তু সেটি তারা পাচ্ছেন না। একই দিন হোটেল শ্রমিক কুমিল্লার কাইয়ুম হোসেন জানান, রাজধানীর হাতির ঝিল সংলগ্ন একটি হোটেলে কাজ করেন তিনি। পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়েও তিনি এক বেলা খাবারসহ মাসে সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি মজুরি পাচ্ছেন না। মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এলেও মালিক সেটি কার্যকর করছেন না। একই এলাকার ওয়ার্কশপ শ্রমিক মো. সুজন ও রবীন্দ্র মজুমদার জানান, প্রকৌশল কাজে তারা যে শ্রম দিচ্ছেন, এতে তাদের যথেষ্ট মেধা খরচ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক সে শ্রম অনুযায়ী তারা পরিশ্রম পাচ্ছেন না। থাকা-খাওয়া নিজেদের বহন করা সত্ত্বেও তাদের মাসিক মজুরি যথাক্রমে আট হাজার ও ছয় হাজার টাকা মাত্র।
শ্রম পরিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকরা শ্রম দিচ্ছেন দেশে এমন খাতের সংখ্যা মোট ৬৭টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিকের উপস্থিতি। বাকি খাতগুলো হচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ খাত, ইটের ভাটা, চা শিল্প, বই বাঁধাই, রাইস মিল বা চাতাল, হস্তচালিত তাঁত, ক্ষুদ্র ও ধাতব শিল্প, তামাক শিল্প, দোকান-প্রতিষ্ঠান, ট্যানারি, টোব্যাকো, স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, হোসিয়ারি, দর্জি, স’মিল, মৎস্য ও মৎস্য খামার, রাবার, পোলট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ফেরিওয়ালা, জেলে, রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি, সেলুন, দোকান ও বিউটি পার্লার, প্রিন্টিং প্রেস, ডক অ্যান্ড পোর্ট, ফার্নিচার, সড়ক, জুট, জুট প্রস ও জুট বেলিং, খাদ্য, পাদুকা, ম্যাচ, নার্সারি, ডেকোরেটর, স্বর্ণকার, ওষুধ, পাওয়ার লুম স্পিনিং মিল, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ অন্যতম।
জানা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ও বিপুলসংখ্যক বেকার- এই ত্রিপক্ষীয় পরিস্থিতির জাঁতাকলে প্রতিনিয়ত এসব খাতের শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। এসব খাতের অধিকাংশ শ্রমিকই ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না কিংবা পেলেও এই নির্ধারিত মজুরি বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায়ই সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, দেশে মোট ৪৩টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ খাতে তা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ঘোষণাও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তা সর্বত্র পরিপালন হচ্ছে না। আমেরিকায় ১ ঘণ্টা কাজ করলে একজন শ্রমিক ৭ ডলার মজুরি পান। একইভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ২ ডলার। এভাবে দেশভেদে প্রতি ঘণ্টায় এই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের হার কোথাও আরও বেশি, কোথাও এ মাত্রার আশপাশেই।
বিলস’র সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে একেবারে উল্টোচিত্র। এখানে ন্যায্য ও ন্যূনতম মজুরি পাওয়া কিংবা দাবি করাটাই যেন অসভ্যতা। এর বাইরে শ্রমিক কল্যাণের অন্যান্য খাত যেমন শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ, প্রাপ্য ছুটিছাটা ও গ্রাচুইটি পাওয়ার অধিকার এগুলো একরকম কাগজে আইনেই রয়ে গেছে।
ওদিকে এসব খাতের অনেক শ্রমিকই আবার আত্মকর্মসংস্থানকারী যারা এসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার কল্পনাই করতে পারেন না। এই শ্রেণীর শ্রমিকরা দিনভর কষ্টার্জিত শ্রম দিয়েও শ্রমের ন্যায্য মজুরি পান না। বিশেষ করে কুলি, দিনমজুর, গৃহকর্মী কিংবা বিভিন্ন খাতের নির্মাণ শ্রমিক। আবার এই শ্রমিকদের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যও প্রকট। একই কাজে একই শ্রম দিয়ে সমমজুরি না পাওয়ার নজিরও রয়েছে অহরহ। সংশ্লিষ্ট খাতগুলো নিয়ে কাজ করেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব খাতে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিকই অশিক্ষিত ও অদক্ষ। কাজ করে শুধু গায়ের জোরে। তারা জানেন না শ্রম অধিকার কি। শ্রম আইনে তাদের জন্য কি সুযোগ রাখা আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম সচিব মিকাইল শিপার যুগান্তরকে জানান, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের জন্য রক্ষিত আইনানুগ অধিকার বাস্তবায়ন, শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি সুদৃঢ় করার পাশাপাশি তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। বিশেষ করে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্পসহ কয়েকটি খাতে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শ্রমিকরা কাজ করছে এমন সব খাতেই যাতে ন্যূনতম মজুরি একটা নিশ্চয়তা থাকে সে ব্যাপারেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে কাজ করছে।
আর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যুগ্ম মহাসচিব ও বিএনপির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জাফরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আসলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি যৌক্তিক কিন্তু অনেকটা আপেক্ষিকও। কারণ সবাই যেমন সমান কাজ করেন না, আবার সমান দক্ষও নন। এক্ষেত্রে সব খাতেই সমন্বিত হারে একটা জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হওয়াটা জরুরি। এটি করা গেলে যে খাতের শ্রমিকই হোক না কেন, জাতীয় মানদণ্ডে নির্ধারিত অংকের নিচে কাউকে স্বল্প মজুরি দিয়ে আর ঠকানো যাবে না।
দেশে মোট কর্মসংস্থানের হার বিবেচনা করলে সরকারি খাতে মাত্র ৫ শতাংশের বিপরীতে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান ঘটছে ৯৫ শতাংশ। আর উৎপাদনশীল কাজে বেসরকারি খাতের গতি সঞ্চারের প্রাণ হচ্ছেন শ্রমিকরা। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় মিলিয়ে বিভিন্ন খাতের কয়েক লাখ শিল্প-কারখানায় এসব শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নিয়োগপত্র মিলছে না। যাদের মিলছে সেখানেও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার মতো শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। তাতে থাকছে না গ্রাচুইটি পাওয়ার নিশ্চয়তা।
এ রকম নানা অসঙ্গতির ভেতর দিয়েই প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করছে দেশের অর্থনীতি। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বরাবরই এগিয়ে থাকছে এই বেসরকারি খাতগুলো। এতকিছুর পরও এখন দেশে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি বেকার রয়েছে। শ্রম অধিকার বঞ্চিত হওয়ার এটিও একটি পরোক্ষ কারণ। অর্থাৎ একজনকে বাদ দিয়ে কারখানা মালিককে আরেকজনকে পেতে বেগ পোহাতে হয় না বললেই চলে।
সরকারি শিল্প খাত বা কলকারখানার স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় লাখের মতো। এর সমপরিমাণ রয়েছেন অস্থায়ী শ্রমিক। তবে দেশের বড়, মাঝারি শিল্প-কলকারখানার ৯৮ ভাগই এখন বেসরকারি মালিকানায়। বেসরকারি শিল্প খাতের ৮০ ভাগই আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। এখানে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে নির্মাণ শিল্পে সর্বোচ্চ শ্রমিক নিযুক্ত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সারা দেশে রিকশা শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ লাখ। আর যান্ত্রিক যানবাহন শ্রমিকের সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। দেশের ৪০ হাজার রাইস মিলে কর্মরত রয়েছেন ৫ লাখেরও বেশি শ্রমিক।
No comments