এই নির্বাচন বিজয়ীর গৌরব ম্লান করেছে by শারমীন মুরশিদ
তিন
সিটি করপোরেশনে গত মঙ্গলবার যে নির্বাচন হলো সে ব্যাপারে আমাদের
পর্যবেক্ষণ হলো, নির্বাচনটি ভালো হয়নি। আশানুরূপ হয়নি। নির্বাচনে যে
বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ভোটারদের অংশগ্রহণ, পোলিং এজেন্ট,
নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা। নির্বাচনের
সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হলে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়। সিটি
নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছে, বলা যাবে না। ব্রতীর পক্ষ থেকে আমরা ঢাকা
উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯১টি ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করি, যার
ভোটার সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। এর প্রতিটি কেন্দ্রে আমাদের প্রতিনিধিরা
কোনো না কোনো অনিয়ম প্রত্যক্ষ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ একটি কেন্দ্রের কথা
বলতে পারি। পোলিং কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ব্যালট পেপার কখন
নিয়েছেন। তিনি বললেন, ১৫ মিনিট। এর মধ্যে ১০০ ভোট পড়েছে, যা কোনোভাবেই
সম্ভব নয়। অথচ বাইরে থেকে সেই ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ছিল শান্ত।
সকালে ভোটারদের ভিড় থাকলেও আমরা লক্ষ করি যে বেলা ১১টা থেকে তাদের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। বেলা দুইটার পর গিয়ে দেখেছি, কেন্দ্রগুলোতে ভোটার নেই বললেই চলে। তবে গলায় ও বুকে সরকার-সমর্থক প্রার্থীদের ছবি ঝোলানো বহু সংখ্যক তরুণকে মহড়া দিতে দেখেছি। অথচ আইন অনুযায়ী কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে বাইরের কারও থাকার কথা নয়। সব মিলিয়ে বলব, কেন্দ্রগুলোতে বেসামাল ও বেহাল অবস্থা ছিল। আমরা বিভিন্ন বুথে গিয়ে দেখি ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে দু-তিনজন করে ঢুকছেন, যদিও সেখানে একজনের বেশি যাওয়ার কথা নয়।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বেশির ভাগ কেন্দ্রে আমরা বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট পাইনি। কোথাও তাঁরা অস্বস্তিকর পরিবেশ দেখে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেছেন, কোথাও তাঁদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট আসেনইনি। আমাদের মনে হয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিতে বিরোধী দলের ঘাটতি ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, সেখানে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভয়ে কাঁপছেন। একদল যুবক ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। পরে পুলিশ তা উদ্ধার করে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যে ধরনের তদারকির প্রয়োজন ছিল তারা তা করেনি। এর আগের নির্বাচনগুলোতে (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নয়) কমিশন নিজেদের কর্মী দিয়ে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছিল। কোনো অঘটন ঘটলে ত্বরিত ব্যবস্থা নিত। এবার এত জাল ভোটের পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা ঘটেনি সত্য, অনিয়ম হয়েছে অহিংস কায়দায়। আর যেসব ভোটকেন্দ্রে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তাও হয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে নয়।
বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপারের যে হিসাব দেখেছি তাতে ৪০-৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে। আমাদের কাছে এর পুরোটা প্রকৃত ভোটার মনে হয়নি। নিকটতম প্রার্থীর ভোটের হিসাবেও বড় ধরনের অসংগতি রয়েছে।
স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হওয়ার কথা অরাজনৈতিকভাবে। কিন্তু এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনটির চরিত্রটি ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। আগে কিছুটা রাখঢাক ছিল, এবার সেটিও নেই। হঠাৎ করে নির্বাচনের সিদ্ধান্তও হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই নির্বাচন করার জন্য যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা তা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়ে। এটাও অনিয়ম বলে মনে করি। সিটি নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মকাণ্ড ঘটলেও নির্বাচন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গাড়ির বহর নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রচার চালানো বা এমপিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে কমিশন ছিল নির্বিকার। বিগত নির্বাচনগুলোতে যে মান আমরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম এই নির্বাচনে সেটি ধরে রাখতে পারিনি। অর্থাৎ মানের অবনয়ন হয়েছে। আমরা যে ধরনের নির্বাচন চাই, এটি ছিল তা থেকে অনেক দূরে।
সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে পারলে আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি হয়তো এক ধাপ এগিয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা সেই কাজটি করতে পারিনি। যদিও এবার মেয়র প্রার্থীরা ছিলেন মেধাবী, যোগ্য, শিক্ষিত, সুভাষী ও তারুণ্যদীপ্ত। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদল তরুণের আগমন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি সুষ্ঠু না হওয়ায় যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের গৌরবও ম্লান হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, রাজনৈতিক দলগুলো প্রথাগত আচরণ থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি দলের সমর্থকেরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে মহড়া দিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। অন্যদিকে বিরোধী দল ভোট গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে যে বর্জনের ডাক দিয়েছে, সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
শারমীন মুরশিদ: প্রধান নির্বাহী, বেসরকারি সংস্থা ব্রতী।
সকালে ভোটারদের ভিড় থাকলেও আমরা লক্ষ করি যে বেলা ১১টা থেকে তাদের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। বেলা দুইটার পর গিয়ে দেখেছি, কেন্দ্রগুলোতে ভোটার নেই বললেই চলে। তবে গলায় ও বুকে সরকার-সমর্থক প্রার্থীদের ছবি ঝোলানো বহু সংখ্যক তরুণকে মহড়া দিতে দেখেছি। অথচ আইন অনুযায়ী কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে বাইরের কারও থাকার কথা নয়। সব মিলিয়ে বলব, কেন্দ্রগুলোতে বেসামাল ও বেহাল অবস্থা ছিল। আমরা বিভিন্ন বুথে গিয়ে দেখি ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে দু-তিনজন করে ঢুকছেন, যদিও সেখানে একজনের বেশি যাওয়ার কথা নয়।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বেশির ভাগ কেন্দ্রে আমরা বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট পাইনি। কোথাও তাঁরা অস্বস্তিকর পরিবেশ দেখে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেছেন, কোথাও তাঁদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট আসেনইনি। আমাদের মনে হয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিতে বিরোধী দলের ঘাটতি ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, সেখানে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভয়ে কাঁপছেন। একদল যুবক ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। পরে পুলিশ তা উদ্ধার করে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যে ধরনের তদারকির প্রয়োজন ছিল তারা তা করেনি। এর আগের নির্বাচনগুলোতে (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নয়) কমিশন নিজেদের কর্মী দিয়ে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছিল। কোনো অঘটন ঘটলে ত্বরিত ব্যবস্থা নিত। এবার এত জাল ভোটের পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা ঘটেনি সত্য, অনিয়ম হয়েছে অহিংস কায়দায়। আর যেসব ভোটকেন্দ্রে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তাও হয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে নয়।
বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপারের যে হিসাব দেখেছি তাতে ৪০-৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে। আমাদের কাছে এর পুরোটা প্রকৃত ভোটার মনে হয়নি। নিকটতম প্রার্থীর ভোটের হিসাবেও বড় ধরনের অসংগতি রয়েছে।
স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হওয়ার কথা অরাজনৈতিকভাবে। কিন্তু এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনটির চরিত্রটি ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। আগে কিছুটা রাখঢাক ছিল, এবার সেটিও নেই। হঠাৎ করে নির্বাচনের সিদ্ধান্তও হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই নির্বাচন করার জন্য যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা তা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়ে। এটাও অনিয়ম বলে মনে করি। সিটি নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মকাণ্ড ঘটলেও নির্বাচন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গাড়ির বহর নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রচার চালানো বা এমপিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে কমিশন ছিল নির্বিকার। বিগত নির্বাচনগুলোতে যে মান আমরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম এই নির্বাচনে সেটি ধরে রাখতে পারিনি। অর্থাৎ মানের অবনয়ন হয়েছে। আমরা যে ধরনের নির্বাচন চাই, এটি ছিল তা থেকে অনেক দূরে।
সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে পারলে আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি হয়তো এক ধাপ এগিয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা সেই কাজটি করতে পারিনি। যদিও এবার মেয়র প্রার্থীরা ছিলেন মেধাবী, যোগ্য, শিক্ষিত, সুভাষী ও তারুণ্যদীপ্ত। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদল তরুণের আগমন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি সুষ্ঠু না হওয়ায় যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের গৌরবও ম্লান হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, রাজনৈতিক দলগুলো প্রথাগত আচরণ থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি দলের সমর্থকেরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে মহড়া দিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। অন্যদিকে বিরোধী দল ভোট গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে যে বর্জনের ডাক দিয়েছে, সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
শারমীন মুরশিদ: প্রধান নির্বাহী, বেসরকারি সংস্থা ব্রতী।
No comments