রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান, স্থিতিশীলতা ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রকেই ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে by মোহাম্মদ আবুল হোসেন
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে
ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন
আওয়ামী লীগ সরকার ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ
জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)কে আলোচনার টেবিলে বসতে উৎসাহিত করতে হবে
যুক্তরাষ্ট্রকেই। যুক্তরাষ্ট্র যদি তা না-ও পারে অথবা তারা এ বিষয়টি এড়িয়ে
চলতে চায় তাহলেও তাদেরকে যা করতে হবে তাহলো- এক. সমমনা গণতান্ত্রিক
দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রাজনৈতিক
উত্তেজনা নিরসনের জন্য আলোচনার টেবিলে বসানোর উদ্যোগ নেয়। এমন দেশ হতে পারে
যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। একই সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নিতে, যদিও নয়া
দিল্লি এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিরোধীদের সঙ্গে সমঝোতায় বসতে
প্রভাব খাটানোর ইচ্ছা থেকে দৃশ্যত দূরে রয়েছে। ভারতের নেতারা দৃশ্যত তাদের
স্বার্থের হিসাব কষছেন। যদি শেখ হাসিনা তার একনায়কোচিত শাসনের বিরুদ্ধে
আন্তর্জাতিক কোন বাধার মুখোমুখি না হন বা সামান্যই বাধা আসে তাহলে বাংলাদেশ
এরই মধ্যে যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়েছে তা বৃদ্ধি পাবে। এতে ইসলামপন্থি
কট্টর গ্রুপগুলোর উত্থান সহজ হবে। দুই. বিরোধী দল যে সহিংস কৌশল নিয়েছে এবং
সরকারের যে ব্যর্থতা- এ দু’ বিষয়েই আরও উচ্চকন্ঠে সমালোচনা করতে হবে। তিন.
বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য সুশীল সমাজের মধ্যে সংলাপকে
উৎসাহিত করতে হবে, যাতে জড়িত থাকবে উঠতি প্রজন্ম। রাজনৈতিক অবস্থার যদি
আরও অবনতি হয় তাহলে তাতে ভুগবে অবশ্যই দু’পক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের এশিয়া প্যাসিফিক বিষয়ক সাব কমিটির এক শুনানিতে এসব কথা বলেছেন
বক্তারা। ৩০শে এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এ শুনানি অনুষ্ঠিত
হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় কি হতে
পারে সে বিষয়ে এ শুনানি হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটির
প্রফেসর আলী রিয়াজ, হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের সরকার বিষয়ক পরিচালক জ্ইে
কানসারা, ইউএস-বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড রিলেশন্স এসোসিয়েশনের সহ
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি স্টিফেন ডি ফ্লেইশ্চিল। শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন
কমিটির চেয়ার সিনেটর ম্যাট স্যামন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক
উত্তেজনাকর পরিস্থিতি অর্থনীতির চরম ক্ষতি করেছে। সামাজিক অগ্রগতি
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ বৃহৎ মুসলিম প্রধান এ দেশটির
গণতান্ত্রিক উন্নয়ন পশ্চাতমুখী হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশী দু’জন সাংবাদিককে
হত্যা করেছে ্ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীরা। এতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তা হলো-
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝ থেকে অধিক সুবিধা আদায় করবে ধর্মীয়
উগ্রবাদীরা। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে
ক্ষমতায় আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বছর ওই দিনে ‘গণতন্ত্র হত্যা
দিবস’ সেøাগানকে সামনে নিয়ে বিএনপি প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করে। শুরু হয় সড়ক
অবরোধ। এতে রাজপথে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এতে গত ৪ মাসে কমপক্ষে ১২০ জন নিহত
হয়েছেন। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী বিরোধী দলীয় প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মীকে
পুলিশ আটক করেছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ে বিরোধী দলীয় ২০ জন সমর্থককে
হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক এই প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক সহিংসতার মূলে সেই
২০১৪ সালের নির্বাচন, যা বিরোধী দল বর্জন করেছিল এবং ওই নির্বাচনে
অস্বাভাবিকভাকে কম ভোট পড়েছিল। এর প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৬ই জানুয়ারি
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয়। তাতে নির্বাচন
প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, নির্বাচনে বাংলাদেশের
মানুষের ইচ্ছার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন ঘটেনি। বাংলাদেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে
উন্নতি করলেও গত ১৬টি মাস দেশটি চলছে এক দলীয় শাসনে। এতে গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়া হুমকিতে পড়েছে। পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একনায়কোচিত
মনোভাবের বিরোধিতায় বিরোধী দল যে সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তাতে এ দেশের
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হুমকিতে পড়েছে। গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে একটি
নিয়মিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন হয়েছে। এতে ব্যতিক্রম শুধু ২০০৭ সালে
সেনাবাহিনী দু’ বছরের জন্য ক্ষমতা নেয়া। তারা এটা করেছিল রাজনৈতিক সহিংসতা ও
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে মতৈক্যে পেীঁছতে
ব্যর্থতার কারণে। কিন্তু শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে ছাড়াই নির্বাচন দিয়ে
দিলেন। এতে জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়
নির্বাচিত হন প্রার্থীরা। বাকি আসনগুলোতে শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ ভোট পড়ে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে এই ভোটের হার ছিল শতকরা ৮৬ ভাগ। ফলে শেখ হাসিনার
সর্বশেষ নির্বাচনে সে তুলনায় ভোট পড়েছে খুবই কম। ওই শুনানিতে বলা হয়, ২০০৭
সালে যেমনটি করেছিল এবার বাংলাদেশ সেরকম রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে
সেনাবাহিনী এগিয়ে আসবে বলে কোন ইঙ্গিত মিলছে না। তবে পরিস্থিতি যদি আরও
উল্লেখযোগ্য হারে অবনতি হয় তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। শুনানিতে একজন
বক্তা বলেন, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর জড়িত হওয়ার সুযোগ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছেন
শেখ হাসিনা। সেনাবাহিনী ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে
দুর্নীতিমুক্ত করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে তাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সে
অভিজ্ঞতার আলোকে তারা রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছে। ওই শুনানিতে বলা হয়,
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে বাংলাদেশের স্¦াধীনতা যুদ্ধের
পরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা
করে দেয়া হয়েছে। বিগত সরকারগুলো এ বিষয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে
পুনরুজ্জীবিত করেনি অপ্রত্যাশিত ঘটনা এড়াতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ
বিষয়ে যে বিচার করছেন সেটাকে বলা হচ্ছে বিরোধীদের দমনের একটি অস্ত্র হিসেবে
এবং এর পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক
গোষ্ঠীগুলো প্রশ্ন তুলেছে।
No comments