শ্রমিকদের আস্থায় নিয়েই শিল্পের উন্নয়ন by ওয়াজেদুল ইসলাম খান
মহান মে দিবস। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি ও বিজয় উৎসবের দিবস। বাংলাদেশের
শ্রমজীবী মানুষ এখনো নানাভাবে নির্যাতিত, অবহেলিত ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার।
ন্যায্য মজুরি, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের
মতো মৌলিক অধিকারগুলো তাদের দেওয়া হয় না। নিরাপদ কর্মস্থল, শ্রমিকের
চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা আজও নিশ্চিত হয়নি। ব্যক্তিমালিকানাধীন
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আইনগত বাধা না থাকলেও ছলে-বলে-কৌশলে শ্রমিক-কর্মচারীদের
ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। কথায় কথায় ছাঁটাই নির্যাতন
চলছে। ছুটির ব্যবস্থা নেই। আট ঘণ্টার পরিবর্তে ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করানো হয়।
অথচ মে দিবসের সূচনা হয়েছিল আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও আট ঘণ্টা বিনোদন, এই দাবিতে। আজও নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও দেশের ৮০ শতাংশের ওপর শিল্প-কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারি মালিকানায় ছিল। শিল্প-কলকারখানাগুলোর প্রায় ১০০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ছিলেন সংগঠিত। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হলে বৃহৎ শিল্প-কারখানাগুলো ব্যক্তিমালিকানা খাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে এই খাত সংকুচিত হয়ে যায়।
আশির দশকে বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের সূত্রপাত। এই শিল্পে বর্তমানে ৩৫ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। এই শিল্পের ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। এই খাত থেকে দেশের জন্য বছরে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা আয়ের পাশাপাশি বহু নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলে একটি বড় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনাও কম নয়। চাপের মুখে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে তা যথেষ্ট নয়। পোশাকশিল্পের মালিকেরা কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে তথাকথিত শ্রমিক ছাঁটাই করে বাড়তি মজুরি দেওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন। বহু কারখানায় এই ন্যূনতম মজুরি কার্যকর হয়নি।
আশির দশক থেকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতসমূহ ক্রমে অবলুপ্তি ও দুর্বল হয়ে গেলেও সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় একদল লুটেরা পুঁজিপতি গড়ে ওঠে। এঁরা গার্মেন্টস, জাহাজভাঙা, চা-বাগান, আবাসন, সিরামিক, সিমেন্ট, ওষুধ, পরিবহন, প্লাস্টিক, চাতাল, ইটভাটা, বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চিকিৎসাব্যবসাসহ বহু ব্যবসায় দ্রুত বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা করতে থাকেন। এই খাতসমূহে বিরাট শ্রমবাজার সৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রামীণ নারীসহ জনগণের দরিদ্র অংশের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে।
দেশের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি লোক কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এসব শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনগত অধিকার থাকলেও কার্যত তা করতে দেওয়া হয় না। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের যেকোনো উদ্যোগকে আইনি-বেআইনি পন্থায় দমন করা হয়। এতে ইউনিয়ন গঠন করার উদ্যোক্তারা একদিকে চাকরি হারান, অন্যদিকে ইউনিয়ন তছনছ হয়ে যায়।
দেশের শ্রম আইন প্রণয়নে এবং সংশোধনের ক্ষেত্রেও মালিকেরা সরকারকে প্রভাবিত করে থাকেন। আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮ মোতাবেক দেশের শ্রম আইন প্রণয়নের জন্য যে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল; শ্রমিক, মালিক ও সরকার প্রতিনিধি সমন্বয়ে ওই ত্রিপক্ষীয় কমিটি দীর্ঘদিন কাজ করার পরও মালিকদের একগুঁয়েমির কারণে ত্রিপক্ষীয়ভাবে মতৈক্য হয়ে সুপারিশমালা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মালিকদের চাপে যে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হয়, তার অনেক ধারা শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থী। প্রচলিত শ্রম আইনের দর-কষাকষি প্রক্রিয়ার মধ্যে আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮ ভিত্তিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের যে পদ্ধতি আছে, তা সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ার কারণে ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পরিবর্তে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্যাসমূহ পুঞ্জীভূত হয়ে বিক্ষোভে রূপ নেয়। বর্তমানে গার্মেন্টসের মালিক কর্তৃপক্ষের বৈরী মনোভাবের কারণে প্রায়ই শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে আসছেন। এই সুযোগে এলাকার স্বার্থান্বেষী মহল, চাঁদাবাজ, ঝুট ব্যবসায়ী দলবাজির নামে শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এর জন্য কোনোভাবেই শ্রমিকেরা দায়ী নন। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করলে, তাঁদের ভোটের মাধ্যমে ইউনিয়ন গঠন বা প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দিলে আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষই একটা সমঝোতায় আসতে পারে।
শ্রমিকদের সংগঠিত করার অধিকার শিল্প বিকাশের পথকে সুগম করবে। তাই শিল্পে বিরোধ নিষ্পত্তি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে সুষ্ঠু পরিবেশের একমাত্র বিকল্প হচ্ছে শ্রমিকদের সংগঠিত হতে দেওয়া এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ সুগম করা।
ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
অথচ মে দিবসের সূচনা হয়েছিল আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও আট ঘণ্টা বিনোদন, এই দাবিতে। আজও নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও দেশের ৮০ শতাংশের ওপর শিল্প-কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারি মালিকানায় ছিল। শিল্প-কলকারখানাগুলোর প্রায় ১০০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ছিলেন সংগঠিত। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হলে বৃহৎ শিল্প-কারখানাগুলো ব্যক্তিমালিকানা খাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে এই খাত সংকুচিত হয়ে যায়।
আশির দশকে বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের সূত্রপাত। এই শিল্পে বর্তমানে ৩৫ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। এই শিল্পের ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। এই খাত থেকে দেশের জন্য বছরে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা আয়ের পাশাপাশি বহু নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলে একটি বড় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনাও কম নয়। চাপের মুখে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে তা যথেষ্ট নয়। পোশাকশিল্পের মালিকেরা কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে তথাকথিত শ্রমিক ছাঁটাই করে বাড়তি মজুরি দেওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন। বহু কারখানায় এই ন্যূনতম মজুরি কার্যকর হয়নি।
আশির দশক থেকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতসমূহ ক্রমে অবলুপ্তি ও দুর্বল হয়ে গেলেও সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় একদল লুটেরা পুঁজিপতি গড়ে ওঠে। এঁরা গার্মেন্টস, জাহাজভাঙা, চা-বাগান, আবাসন, সিরামিক, সিমেন্ট, ওষুধ, পরিবহন, প্লাস্টিক, চাতাল, ইটভাটা, বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চিকিৎসাব্যবসাসহ বহু ব্যবসায় দ্রুত বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা করতে থাকেন। এই খাতসমূহে বিরাট শ্রমবাজার সৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রামীণ নারীসহ জনগণের দরিদ্র অংশের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে।
দেশের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি লোক কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এসব শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনগত অধিকার থাকলেও কার্যত তা করতে দেওয়া হয় না। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের যেকোনো উদ্যোগকে আইনি-বেআইনি পন্থায় দমন করা হয়। এতে ইউনিয়ন গঠন করার উদ্যোক্তারা একদিকে চাকরি হারান, অন্যদিকে ইউনিয়ন তছনছ হয়ে যায়।
দেশের শ্রম আইন প্রণয়নে এবং সংশোধনের ক্ষেত্রেও মালিকেরা সরকারকে প্রভাবিত করে থাকেন। আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮ মোতাবেক দেশের শ্রম আইন প্রণয়নের জন্য যে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল; শ্রমিক, মালিক ও সরকার প্রতিনিধি সমন্বয়ে ওই ত্রিপক্ষীয় কমিটি দীর্ঘদিন কাজ করার পরও মালিকদের একগুঁয়েমির কারণে ত্রিপক্ষীয়ভাবে মতৈক্য হয়ে সুপারিশমালা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মালিকদের চাপে যে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হয়, তার অনেক ধারা শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থী। প্রচলিত শ্রম আইনের দর-কষাকষি প্রক্রিয়ার মধ্যে আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮ ভিত্তিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের যে পদ্ধতি আছে, তা সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ার কারণে ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পরিবর্তে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্যাসমূহ পুঞ্জীভূত হয়ে বিক্ষোভে রূপ নেয়। বর্তমানে গার্মেন্টসের মালিক কর্তৃপক্ষের বৈরী মনোভাবের কারণে প্রায়ই শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে আসছেন। এই সুযোগে এলাকার স্বার্থান্বেষী মহল, চাঁদাবাজ, ঝুট ব্যবসায়ী দলবাজির নামে শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এর জন্য কোনোভাবেই শ্রমিকেরা দায়ী নন। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করলে, তাঁদের ভোটের মাধ্যমে ইউনিয়ন গঠন বা প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দিলে আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষই একটা সমঝোতায় আসতে পারে।
শ্রমিকদের সংগঠিত করার অধিকার শিল্প বিকাশের পথকে সুগম করবে। তাই শিল্পে বিরোধ নিষ্পত্তি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে সুষ্ঠু পরিবেশের একমাত্র বিকল্প হচ্ছে শ্রমিকদের সংগঠিত হতে দেওয়া এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ সুগম করা।
ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
No comments