শিশুশ্রম কমলেও ঝুঁকি কমেনি by প্রতীক বর্ধন

সম্প্রতি ভাগ্যহত শিশুদের ওপর একটি জরিপ করেছে সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি (সিএসআইডি)। সংস্থাটির গবেষণা অনুসারে, দেশে গত ১০ বছরে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। ১০ বছর আগে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪৯ লাখ ১০ হাজার, আর বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৪ লাখ ৮০ হাজারে। সেভ দ্য চিলড্রেন সুইডেন-ডেনমার্কের সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে সিএসআইডি। দ্বিতীয় ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন ফর চিলড্রেনে (১৯৯৭-২০০২) দেশে শিশুশ্রমের বিষয়টি প্রথম চিহ্নিত হয়। ২০০১ সালের মার্চ মাসে সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮২ নম্বর ধারায় অনুসমর্থন দেয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সে বছরই জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন শুরু করে। ১৯৯৪ সালের জাতীয় শিশুনীতিতে এটা স্বীকার করা হয় যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে গ্রাম–শহরের ভেদ নেই। উল্লেখ্য, শিশুশ্রমবিষয়ক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও জাতিসংঘের আরও কয়েকটি রীতিতে বাংলাদেশ অনুসমর্থন দিয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, দেশের মোট শ্রমিকের মধ্যে অন্তত ১২ শতাংশই হচ্ছে শিশু শ্রমিক। ১৯৯০ সালের আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, শহরাঞ্চলে ১৫ বছরের নিচে ২ লাখ ৯০ হাজার শিশু অতিদারিদ্র্যের কারণে শ্রমে নিয়োজিত হয়। কিন্তু শিশুনীতির বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় শিশুশ্রম হ্রাস অথবা বিষয়টি আমলে নেওয়ার উদ্যোগ নেই।
এই সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখনো অনেক বেশি। তাদের মধ্যে ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশু শ্রমিকেরা কাজে না গেলে তাদের ক্ষেত্রবিশেষে খেতেও দেওয়া হয় না। আবার তারা কাজে গিয়ে নানা রকম সমস্যারও মুখোমুখি হয়, যেমন: ক) নিয়োগকর্তারা তাদের কাজে নিতে চান না, খ) তাদের নিম্ন মজুরি দেওয়া হয়, গ) কর্মপরিবেশ পঙ্গু শিশুদের উপযোগী নয়, কাজে ভুল করলে তাদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়, বকাঝকা করা হয়, ঘ) শিশুদের বয়স অনুসারে কাজের ভার লাঘব করা হয় না, তাদের স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তি-সংক্রান্ত বিশেষ বিধান রয়েছে। শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারে, কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স হচ্ছে ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে হালকা কাজ করলে সেটাকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না।
এই শিশুরা অল্প বয়সে শ্রমে নিযুক্ত হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আবার এর কারণে তাদের শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়। তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতেই থাকে।
দেশে শিশুশ্রম কমেছে, এটা স্বস্তির খবর। সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিদ্যালয়ে গমনের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত এই সাফল্য। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। কারণ, সিএসআইডির গবেষণাতেই বেরিয়ে এসেছে, শিশুশ্রম কমলেও দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখনো ঢের বেশি। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, চরম দারিদ্র্যের কারণেই শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সরকারকে যেমন একদিকে শিশু অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, তেমনি দারিদ্র্য হ্রাসে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। শিশুশ্রম কমার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এর প্রভাব রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকারই এর কৃতিত্বের দাবিদার। শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ, তাদের নিরাপদ শৈশব ও কৈশোর নিশ্চিত করতে না পারলে রাষ্ট্র হিসেবেও আমরা দাঁড়াতে পারব না।
বিপুলসংখ্যক শিশুকে এমন মানবেতর অবস্থায় রেখে আমরা নিজেদের কোনোভাবেই সভ্য, মানবিক ও গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারি না। তাদের কচি হাত হাতুড়ি পেটানোর জন্য নয়, বাসন ধোয়ার জন্য নয়, ভারী বস্তু মাথায় তোলার জন্য নয়; পেনসিল দিয়ে খাতায় বা দেয়ালে আঁকিবুঁকি করার জন্য। যখন কল্পনার ডানায় ভর করে স্বপ্নের দেশে চলে যাওয়ার সময়, তখন তারা কারখানায়, রান্নাঘরে বা রাস্তায় হারভাঙা খাটুনি করতে করতে ক্লান্ত। এই অবস্থা কখনই কাম্য নয়।
আজ মে দিবসে শিশুর নিরাপদ শৈশব ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
bardhanprotik@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.