ভারত-ভাবনার বিকাশ ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ by রাজু আলাউদ্দিন
লাতিন আমেরিকার যে দুজন লেখকের প্রতি আমার
মনোযোগ এবং কৌতূহল এখনও অবিচ্ছিন্ন তারা হলেন অক্তাবিও পাস এবং হোর্হে
লুইস বোর্হেস। ভৌগোলিকভাবে দেখলে আমরা প্রথমেই যেটা লক্ষ্য করব তা হল এ দুই
বিশ্ব-মনীষার উত্থান ঘটেছে মহাদেশের পরস্পরবিরোধী দুই মেরু থেকে : একজন
উত্তরের অন্যজন দক্ষিণের, যদিও দুজনই একই ভাষার জরায়ু থেকে উৎসারিত।
মহাদেশের রাজনীতি বা বিশ্বরাজনীতি কিংবা সাহিত্য-বহির্ভূত অন্যান্য বিষয়ে চিন্তার ভিন্নতা থাকলেও যে বিষয়টি তাদের অভিন্নতার একাসনে অধিষ্ঠিত করেছে তা হল বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে উভয়ের গভীর কৌতূহল ও অপরিমের পাণ্ডিত্য।
গোটা স্প্যানিশ ভাষাতেই প্রতিভাবান অনেক লেখক থাকলেও বিশ্ব সংস্কৃতির সহস্র শিখা থেকে নিজের ভাষা ও সাহিত্যকে আলোকিত ও উষ্ণ করার তৃতীয় কোনো নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
একই ভাষার এ দুই লেখকের মধ্যে অন্য আরেকটি মিল এই যে দুজনই ভারতীয় ভাষা, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ছিলেন সরব এবং সক্রিয় : লেখায় এবং বাক্যালাপে।
আমার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য অবশ্য ভারত-সংস্কৃতি সম্পর্কে এ দুই মনীষার কোনো তুলনামূলক আলোচনা বা চিন্তা-ভাবনার সাযুজ্য তুলে ধরা নয়। আমি শুধু ভারত সংস্কৃতি সম্পর্কে পাসের ভাবনাগুলো এ প্রবন্ধে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করব। আর ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রবন্ধে একই বিষয়ে বোর্হেসের চিন্তা-ভাবনা তলব করার চেষ্টা করব।
এটা ভাবা অসম্ভব নয়, ভারতে আসার আগ থেকেই পাস ভারতের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতেন। তবে সেই জানাশোনা কতটা গভীর ও বিস্তৃত তা আমরা না জানলেও যেটা নিশ্চিত করে বলা যায় তা হল সেই জানাশোনা তখনও পর্যন্ত ভাবনার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেনি।
একথা বলার কারণ হচ্ছে এই, তিনি যে পরবর্তী সময়ে ভারতে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসবেন এবং এ দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ লিখবেন তার কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না।
এটা অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না, ভারতে আসার ফলে ভারতীয় শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং কৌতূহল দানা বাঁধতে শুরু করে।
পাসের ভারতে আসাও ছিল অপরিকল্পিত, নিতান্তই উঁচু পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফল। সে কাহিনীর বয়ান পাসের কৌতূহলী পাঠকরা খুঁজে পাবেন তার ভারতবর্ষের আলোয় (In light of India) গ্রন্থে।
আমি এ গ্রন্থের কোনো কিছুই উদ্ধৃত করে এ প্রবন্ধটিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে চাই না। কারণ এ বইটি বেরোনোর পরপরই এক দীর্ঘ আলোচনা লিখে তার ভারত-ভাবনার কথা পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য লেখক অক্তাবিও পাস নন, বরং কথক বা আলাপি অক্তাবিও পাস। এলেনা পনিয়াতৌস্কা নামে মেহিকোর এক লেখিকা পাস সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন এবং সেটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে।
এরপর বইটির একাধিক সংস্করণ হয়েছে। বইটি মূলত অক্তাবিও পাসের সঙ্গে এলেনার কথোপকথনের ভিত্তিতে তৈরি একটি বই যার বৈশিষ্ট্য খানিকটা স্মৃতিধর্মী। কথোপকথনের আগে পরে দেশ এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর কালানুক্রমিক উল্লেখ এবং বর্ণনা দিয়ে তাদের দীর্ঘ বাক্যালাপকে সাজিয়ে তুলেছেন।
পাসের প্রবন্ধের সরসতা ও স্বচ্ছতা বাক্যালাপেও একইভাবে হাজির। আর এলেনা যেহেতু ঔপন্যাসিক, মেহিকোর একালের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকদের একজন, ফলে এই গ্রন্থে পাসের প্রাবন্ধিক বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষুণ্ন রেখেই তিনি গ্রন্থটিকে প্রায় উপন্যাসের মতোই উপভোগ্য করে তুলেছেন।
বইটির নাম অক্তাবিও পাস : বৃক্ষের ভাষা ((Octavio Paz: Las Palabras del arbol)। পাস হচ্ছেন এনসাইক্লোপেডিক যুগের সেসব লেখকদের মতো যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় ছিলেন বিচরণশীল।
চিত্রকলা, সাহিত্য, নৃতত্ত্ব, দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস- প্রায় সব শাখাকেই তার সৃষ্টিশীল মনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। আর এসব বিষয়ে তার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ কিংবা মন্তব্য ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন।
‘বৃক্ষের ভাষা’র- আলাপি পাসের মধ্যেও আমরা এসব গুণাবলীর উপস্থিতি দেখতে পাই। বাঙালি বা ভারতীয় পাঠকদের জন্য বাড়তি কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য রয়েছে ভারতবর্ষের নানা বিষয়ে পাসের সুগভীর পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্য।
পাস ভারতে মেহিকোর রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন ১৯৫১ সালের ২২ ডিসেম্বর। আসার মাস খানেক পর মেহিকোর আরেক লেখক আলফন্সো রেইয়েসকে লেখা এক চিঠিতে তিনি ভারত সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লেখেন ‘প্রাচ্য- যদি পুরোপুরি আন্তরিকতা নিয়ে বলি- আমাকে খানিকটা হতাশই করেছে (বহিরাঙ্গিক দিক থেকে : রং, ভূদৃশ্য, ইত্যাদি)। নয়া দিল্লি কোনো শহর নয়।
এ হচ্ছে বাগান, সমতলভূমি, উষরভূখণ্ড আর ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর ইংরেজদের অনুকরণে তৈরি দালানকোঠার সমাহার। রাষ্ট্রভবন কেকের (Pastel) মতো রাজকীয়। পুরান দিল্লির রেড ফোর্ট খুবই সুন্দর। এ হচ্ছে সপ্তদশ শতকের মোগল ভবন যা ভার্সাইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বাগানগুলো অপূর্ব। তবে দেশটি আমি সামান্যই দেখেছি।’১
ভারতের বহিরাঙ্গিক এ বর্ণনার পাশাপাশি এও জানাচ্ছেন চিঠির শেষে যে মহাভারত এবং রামায়ণ পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। মাস তিনেক পর তিনি আরেক চিঠিতে জানাচ্ছেন : ‘লোকজন এত অর্থহীন আর গুরুগম্ভীর আর রসকষহীন! মেয়ে মানুষেরা সাধারণত সুন্দরী, কিন্তু শূন্য। এদের মধ্যে আনন্দ আর ইন্দ্রিয়াসক্তির সজীব আগুনের অভাব।
এও সম্ভব শিব-ভক্ত, শৃঙ্গাররসাত্মক মন্দির আর তান্ত্রিকবাদের দেশে! ‘ইলিয়াড’-এ ফিরে আসি। এটি যখন আমার কাছে আসে তখন রামায়ণ পড়ছিলাম। আবারও বলি : পক্ষপাতিত্ব বা অবিচার করার ইচ্ছা আমার নেই, তবু গ্রিকদের মধ্যে আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি।
এ জন্য নয় যে, ওরা বেশি মানবীয়, বরং এ জন্য যে এসব বীর আর তাদের অতিমানবীয় কর্মকাণ্ড মানুষের অতিমানবীয় রূপকে তুলে ধরে। অন্যদিকে, ভারতীয় বীররা তুলে ধরে দেবতাদের রূপ। অর্জুন এবং কৃষ্ণের (মরমী এবং ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ছাড়া অট্টোর সংস্করণে যেমনটা দেখা যায়) মধ্যেকার সংলাপ মানুষের তুচ্ছতার সামনে পবিত্র ও বৈরাট্যের এক পরীক্ষা।
তুমি আমার (সৃষ্টি ও ধ্বংসের) হাতিয়ার- কৃষ্ণ বলছেন অর্জুনকে। একিলিসও এক হাতিয়ার, তবে, জানি না, মনে হয়, কিংবা আমাদের কাছে মনে হয় যেন বিপুল ও স্বাধীন ইচ্ছার এক প্রতিভু যা রাম এবং অর্জুনের মধ্য পাওয়া যায় না।’২
রামায়ণ, মহাভারত কিংবা ভগবত গীতার চরিত্রগুলো ও ভারত দেখার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে পাস এমন এক জগতের সামনে এসে পড়েছেন যার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ তার অভ্যস্ত স্বাদের অনুকূল না হলেও তুল্যমূল্যের কঠিন ও পরিশ্রমী পথে প্রবেশে চেষ্টা করছেন। এ পথে তার যাত্রা ছিল দীর্ঘ।
এবং তিনি যত বেশি গভীরে প্রবেশ করছিলেন তত বেশি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনাকে সঠিক ও সমৃদ্ধ করে নিতে পেরেছিলেন। যার ফলে পরবর্তীকালে এসব বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া ও মতামত বদলে গিয়েছিল অনেকটাই।
যে গ্রিক সংস্কৃতির মধ্যে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বলেছিলেন তা ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত না হলেও ভারত তার পরিপক্ব (Madurez) জীবনের মাতৃত্ব অর্জন করতে পেরেছিল। আলোচ্য গ্রন্থে এলেনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পাস বাগানের উপমা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন এ ভাবে : “বাগান হচ্ছে শৈশবের আর ভালবাসার আবেগময় খেলার মঞ্চ।
আমার ক্ষেত্রে দুটি বাগান : মিক্সোয়াকে আমার শৈশবের আর দিল্লিতে আমার পরিপক্বতার (Madurez) । ‘বাগানের গল্প’-এ আমি সে কথা বলেছি।” ৩
পূর্বের ঢালু (Ladera Este) কাব্যগ্রন্থে আমরা তার এ পরিপক্বতার কাব্যময় প্রকাশ দেখতে পাব। আর তার গদ্যময় প্রকাশ দেখতে পাব বানর-ব্যাকরণিক (Monkey G rammarian)’ কিংবা ভারতবর্ষের আলোয় গ্রন্থে।
ভারত, বৃহত্তর পরিসরে- প্রাচ্যের ভাবনা ও সৃজনশীলতা তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। এলেনাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন ‘১৯৬২ সালে প্যারিস ছেড়ে দিল্লিতে আসি। প্রাচ্যে এটা আমার প্রথম সফর নয়।
১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে পরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের কাজ নিয়ে বছরখানেক কাটিয়েছিলাম, প্রথমে ভারতে পরে জাপানে। সেই সময় থেকেই চীন, জাপান, কোরিয়া এবং ভারতের সভ্যতার প্রতি আমি গভীরভাবে আগ্রহী হয়েছিলাম।
পাণ্ডিত্য অর্জনের ইচ্ছা নয়, বরং মননশীল বা নান্দিক কৌতূহলের চেয়ে অতিরিক্ত কিছুর দ্বারা আলোড়িত হয়ে জাপান চীন এবং ভারতের দর্শন এবং কাব্যতত্ত্বের মহান গ্রন্থগুলোর কোনো কোনোটি আমার আগেই পড়া ছিল। আসলে ভারতের সংস্কৃত ভাষার মহান সাহিত্যের চেয়ে বরং চীনা এবং জাপানি গদ্য ও কবিতাকে আমার অনেক কাছের মনে হয়েছিল। অন্যদিকে, ভারতীয় ভাবুকতা আমকে মুগ্ধ করেছিল, এখনও আমাকে মুগ্ধ করে এর মহান ঐক্য, যুক্তির প্রখরতা, অবাধ কল্পনা আর পৌরাণিক চমৎকারিত্ব।”৪
ভারতীয় ভাবুকতার যে অংশটি তাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তা বুদ্ধবাদ। বুদ্ধের প্রতি বা বুদ্ধবাদের প্রতি তার গভীর অনুরাগ এবং শ্রদ্ধা অত্যন্ত গভীর। তিনি মনে করেন, ‘দুটি’ কারণে গৌতম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি : প্রথমত তিনি হলেন সেই লোক যিনি নিজেকে দেবতা বলে দাবি করেননি।
তিনি বললেন : ‘আমি দেবতা নই’ আর একই সময়ে এবং একই কারণে নিজেকে মানব বলেও দাবি করলেন না। বললেন, একজন আদর্শ মানুষের উচিত ‘মানব’ ধারণাকে বর্জন করা।”৫
সেই মৌলিক ১০টি প্রশ্নের বিপক্ষে বুদ্ধের নীরবতা সম্পর্কেও পাসের ব্যাখ্যা বুদ্ধবাদের মৌলিকতাকেই নিশ্চিত করে তোলে।
বুদ্ধের এ নীরবতার সঙ্গে পাস একমত কিনা এলেনা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বলেন “হ্যাঁ এবং না। সবই নির্ভর করে অর্থের মাধ্যমে আমরা কী বুঝলাম তার ওপরে। লোকশ্র“তি রয়েছে বুদ্ধকে ১০টি প্রশ্ন করা হয়েছিল : আত্মা শরীর থেকে স্বতন্ত্র কোনো ব্যাপার (Entidad) কিনা, সময় সসীম নাকি অসীম, মহাশূন্যের কোনো অন্ত আছে কিনা। এ জীবনের পরও কোনো জীবন আছে কিনা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের মৌলিক প্রশ্ন, দার্শনিক এবং ধার্মিকরা সবসময় কোনো না কোনোভাবে এ প্রশ্নগুলোর প্রতি সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধ ছিলেন নিশ্চুপ।
বুদ্ধের নীরবতা বহু বিতর্ক এবং ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে। এ নীরবতার কী অর্থ থাকতে পারে? আমার ধারণা লেভি-স্ট্রাসের মতে, যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নগুলো ছিল সামঞ্জস্যহীন। অর্থহীন সব প্রশ্ন।
তবে কোনো কোনো বুদ্ধবাদী দার্শনিক মনে করেন, এমন কিছু বিষয় আছে যার ব্যাপারে নীরব থাকা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না আর সেই কারণেই বুদ্ধ এদের কোনো জবাব দেননি। শব্দ হচ্ছে দ্বান্দ্বিক : কোনো কিছুকে ইতিবাচক করলে অন্যটি নেতিবাচক হয়ে পড়ে।
এমন এক মুহূর্ত আছে যখন একে ইতিবাচক বা নেতিবাচক, কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। কিংবা বলা যায়, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক, অর্থময়তা এবং অর্থহীনতা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে বা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা তৈরি করে। এটাই হতে পারে বুদ্ধের নীরবতার অর্থ।’৬
লাতিন আমেরিকার লেখকদের মধ্যে সম্ভবত পাস এবং বোর্হেসই গৌতম বুদ্ধকে অন্য যে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের ভাষায় তাকে নিয়ে লিখেছেন।
বোর্হেসের তো একটি আস্ত বই-ই রয়েছে বুদ্ধকে নিয়ে বুদ্ধবাদ কী (Que es el budismo, columbia, Buenos Aires, 1976) নামে। এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। পাস তাকে নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো কেতাব হয়তো লেখেননি কিন্তু তার বিভিন্ন প্রবন্ধে এবং সর্বশেষ এ পুস্তকে-দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধকে নিয়ে প্রসঙ্গত উল্লেখ এবং সশ্রদ্ধ মন্তব্য আমরা দেখতে পাব। বুদ্ধকে নিয়ে পাস-এর চূড়ান্ত মন্তব্য : “ভালবাসি বুদ্ধের সংস্কার; এ হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক।”
মোগল রাজবংশের উল্লেখ ছাড়া ভারতের ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না এটা আমরা সবাই জানি। আমি প্রায় দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি পৃথিবীর অন্য কোনো রাজবংশই মোগলদের বিদ্যা-বৃদ্ধি, শিল্পরুচি, মননশীলতা ও ভাবুকতার উচ্চতার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
সম্রাট বাবুর থেকে শুরু করে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত রয়েছে সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার এক ধারাবাহিক চর্চা। এ রাজবংশের যেন প্রত্যেকের রক্তের মধ্যেই সৃষ্টির উচ্চাকাক্সক্ষা প্রবহমান ছিল। বিশাল সাম্রাজ্য অটুট এবং বিস্তারের পাশাপাশি এ সৃজনশীলতাকে তারা অব্যাহত রেখেছেন সারা জীবন।
মোগল ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন এবং সর্বজ্ঞ পণ্ডিতদের ক’জনইবা জানেন, সম্রাট বাবুরের ‘আত্মজীবনী’র ছায়ার গড়ে উঠেছে সাঁ-ঝ পের্সের মৌলিক কাব্যগ্রন্থ আনাবাস? পাসের ভাষায় : “বাবুর ভারতবর্ষ জয় করেছিলেন। তিনি যে জীবনপঞ্জি লিখেছেন সেখানে কেবল এক যোদ্ধাকেই দেখা যায় না বরং এক কবিকে দেখা যায়।
বাবুরের বইটি সাঁ-ঝ পের্সের আনাবাসকে প্রভাবিত করেছে, লেখক নিজেই আমাকে সে কথা বলেছিলেন।”৭
ভারতবর্ষের বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে এ ধরনের কৌতূহল উদ্দীপক মন্তব্যের পাশাপাশি এ গ্রন্থে রয়েছে পাসের জীবন ও কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ঘটনার উল্লেখ এবং কবির জবানীতে তার প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা। পাসের অনুরাগী মাত্রেই এ বইটি উপভোগ করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল পৃথিবীর বহু সংস্কৃতি ও সভ্যতার নানা সব উচ্ছল স্রোতধারা। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য থেকে দুই হাত ভরে নিয়েছেন তিনি, নিয়েছেন আত্মবিকাশ ও প্রসারের জন্য; দিয়েছেনও প্রচুর। কিন্তু এতসব দেশ ও সংস্কৃতি থাকতে কেবল ভারতবর্ষই তার ‘পরিপক্বতার’ আরেক মাতৃভূমি হয়ে উঠেছিল- এ তথ্য আমাদের শিহরিত না করে পারে না। এলেনার কাছে পাসের এ স্বীকারোক্তি গোপনে আমার কৌতূহলকে উসকে দিয়েছিল অন্য এক প্রশ্নের দিকে : বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তার কোনো আগ্রহ বা ভাবনা ছিল কি না।
১৯৯৫ সালে বিসলুম্ব্রেস দে লা ইন্দিয়া বা ইন লাইট অব ইন্ডিয়া বইটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ২৪ বছর পর প্রকাশিত হলেও তিন-চার জায়গায় অবিভক্ত ভারতের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক সূত্রে বাংলাদেশের উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তৃত বা সংক্ষিপ্ত আলোচনা তাতে নেই। তবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন ঠিকই, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখার তাগিদ বোধ না করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তার সহানুভূতি ছিল স্পষ্ট।
বাংলাদেশ
মার্কিন লেখক শেলডেন রোডম্যান ১৯৭১ সালে পাসের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন (সাক্ষাৎকারের কোথাও সময়ের উল্লেখ নেই। তবে বোঝা যায়, ওটি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে ঘটেছিল।)। সেখানে শেলডেন তার কাছে জানতে চান বাঙালিদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে তার ধারণার কথা :
‘আর বাঙালিরা এখন যে যুদ্ধ করছে?’
‘এটা সাংঘাতিক বেদনাদায়ক ব্যাপার,’ তিনি উত্তর দিলেন। ‘আপনার মতো আমারও সহানুভূতি বাঙালিদের প্রতি ও ভারতীয়দের প্রতি। তবে বাঙালিরা যদি স্বাধীনতা অর্জন করে, তাহলে সেটা ভারতের শর্তের অধীনেই হবে এবং কয়েক বছরের মধ্যে আবার তাদের নতুন করে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। ভারতের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এর ঐক্য ধরে রাখার সমস্যা, একই সঙ্গে তার বহুত্বের সমস্যাও রয়েছে। অতীতে ভারত কোনো জাতি ছিল না, ছিল একটি সভ্যতা। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিতর্ককে একই সভ্যতার মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে।’
[টাংস অব ফলেন এঞ্জেলস, শেলডেন রোডম্যান, নিউ ডাইরেকশনস, ১৯৭৪, পৃ. ১৪২)
পাসের এ মন্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঠিকতা বা দূরদর্শিতা নিয়ে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে; কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তার সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল তর্কাতীত। এ সাক্ষাৎকারে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যায়, এটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু ও বিজয় লাভের মাঝামাঝি কোনো সময়ের ঘটনা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তার মতো একজন অসাধারণ কবি ও প্রাবন্ধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন- এটা আমাদের জন্য কম গৌরবের নয়।
[আলফনসো রেইয়েস মেহিকোর প্রথম সারির লেখকদের একজন। স্প্যানিশ ভাষার গদ্য সাহিত্যে তিনি সঞ্চার করেছেন নতুন প্রাণ। পাস-এর মতো তিনিও ছিলেন মেহিকোর রাষ্ট্রদূত। পাস-এর চিঠিতে যে ইলিয়াড-এর উল্লেখ তা আসলে আলফনসো রেইয়েস কর্তৃক স্প্যানিশে অনূদিত সংস্কারণেরই উল্লেখ।
1. Correspondencia: Alfonso Reyes Y Octavio Paz, Edition de Anthony Stanton, Fondo de cultura Economica, 1999, P. 167-168
2. Correspondecia: Alfonso Reyes Y Octavio Paz, Edicion de Anthony Stanton, Fondo de cultura Economica, 1999, P. 180-181.
3. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998, P-98
4. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998, P-84-85.
5. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998. P-100.
6. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998. P 109-110.
7. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998, P 104-105.]
মহাদেশের রাজনীতি বা বিশ্বরাজনীতি কিংবা সাহিত্য-বহির্ভূত অন্যান্য বিষয়ে চিন্তার ভিন্নতা থাকলেও যে বিষয়টি তাদের অভিন্নতার একাসনে অধিষ্ঠিত করেছে তা হল বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে উভয়ের গভীর কৌতূহল ও অপরিমের পাণ্ডিত্য।
গোটা স্প্যানিশ ভাষাতেই প্রতিভাবান অনেক লেখক থাকলেও বিশ্ব সংস্কৃতির সহস্র শিখা থেকে নিজের ভাষা ও সাহিত্যকে আলোকিত ও উষ্ণ করার তৃতীয় কোনো নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
একই ভাষার এ দুই লেখকের মধ্যে অন্য আরেকটি মিল এই যে দুজনই ভারতীয় ভাষা, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ছিলেন সরব এবং সক্রিয় : লেখায় এবং বাক্যালাপে।
আমার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য অবশ্য ভারত-সংস্কৃতি সম্পর্কে এ দুই মনীষার কোনো তুলনামূলক আলোচনা বা চিন্তা-ভাবনার সাযুজ্য তুলে ধরা নয়। আমি শুধু ভারত সংস্কৃতি সম্পর্কে পাসের ভাবনাগুলো এ প্রবন্ধে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করব। আর ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রবন্ধে একই বিষয়ে বোর্হেসের চিন্তা-ভাবনা তলব করার চেষ্টা করব।
এটা ভাবা অসম্ভব নয়, ভারতে আসার আগ থেকেই পাস ভারতের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতেন। তবে সেই জানাশোনা কতটা গভীর ও বিস্তৃত তা আমরা না জানলেও যেটা নিশ্চিত করে বলা যায় তা হল সেই জানাশোনা তখনও পর্যন্ত ভাবনার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেনি।
একথা বলার কারণ হচ্ছে এই, তিনি যে পরবর্তী সময়ে ভারতে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসবেন এবং এ দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ লিখবেন তার কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না।
এটা অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না, ভারতে আসার ফলে ভারতীয় শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং কৌতূহল দানা বাঁধতে শুরু করে।
পাসের ভারতে আসাও ছিল অপরিকল্পিত, নিতান্তই উঁচু পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফল। সে কাহিনীর বয়ান পাসের কৌতূহলী পাঠকরা খুঁজে পাবেন তার ভারতবর্ষের আলোয় (In light of India) গ্রন্থে।
আমি এ গ্রন্থের কোনো কিছুই উদ্ধৃত করে এ প্রবন্ধটিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে চাই না। কারণ এ বইটি বেরোনোর পরপরই এক দীর্ঘ আলোচনা লিখে তার ভারত-ভাবনার কথা পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য লেখক অক্তাবিও পাস নন, বরং কথক বা আলাপি অক্তাবিও পাস। এলেনা পনিয়াতৌস্কা নামে মেহিকোর এক লেখিকা পাস সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন এবং সেটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে।
এরপর বইটির একাধিক সংস্করণ হয়েছে। বইটি মূলত অক্তাবিও পাসের সঙ্গে এলেনার কথোপকথনের ভিত্তিতে তৈরি একটি বই যার বৈশিষ্ট্য খানিকটা স্মৃতিধর্মী। কথোপকথনের আগে পরে দেশ এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর কালানুক্রমিক উল্লেখ এবং বর্ণনা দিয়ে তাদের দীর্ঘ বাক্যালাপকে সাজিয়ে তুলেছেন।
পাসের প্রবন্ধের সরসতা ও স্বচ্ছতা বাক্যালাপেও একইভাবে হাজির। আর এলেনা যেহেতু ঔপন্যাসিক, মেহিকোর একালের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকদের একজন, ফলে এই গ্রন্থে পাসের প্রাবন্ধিক বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষুণ্ন রেখেই তিনি গ্রন্থটিকে প্রায় উপন্যাসের মতোই উপভোগ্য করে তুলেছেন।
বইটির নাম অক্তাবিও পাস : বৃক্ষের ভাষা ((Octavio Paz: Las Palabras del arbol)। পাস হচ্ছেন এনসাইক্লোপেডিক যুগের সেসব লেখকদের মতো যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় ছিলেন বিচরণশীল।
চিত্রকলা, সাহিত্য, নৃতত্ত্ব, দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস- প্রায় সব শাখাকেই তার সৃষ্টিশীল মনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। আর এসব বিষয়ে তার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ কিংবা মন্তব্য ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন।
‘বৃক্ষের ভাষা’র- আলাপি পাসের মধ্যেও আমরা এসব গুণাবলীর উপস্থিতি দেখতে পাই। বাঙালি বা ভারতীয় পাঠকদের জন্য বাড়তি কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য রয়েছে ভারতবর্ষের নানা বিষয়ে পাসের সুগভীর পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্য।
পাস ভারতে মেহিকোর রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন ১৯৫১ সালের ২২ ডিসেম্বর। আসার মাস খানেক পর মেহিকোর আরেক লেখক আলফন্সো রেইয়েসকে লেখা এক চিঠিতে তিনি ভারত সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লেখেন ‘প্রাচ্য- যদি পুরোপুরি আন্তরিকতা নিয়ে বলি- আমাকে খানিকটা হতাশই করেছে (বহিরাঙ্গিক দিক থেকে : রং, ভূদৃশ্য, ইত্যাদি)। নয়া দিল্লি কোনো শহর নয়।
এ হচ্ছে বাগান, সমতলভূমি, উষরভূখণ্ড আর ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর ইংরেজদের অনুকরণে তৈরি দালানকোঠার সমাহার। রাষ্ট্রভবন কেকের (Pastel) মতো রাজকীয়। পুরান দিল্লির রেড ফোর্ট খুবই সুন্দর। এ হচ্ছে সপ্তদশ শতকের মোগল ভবন যা ভার্সাইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বাগানগুলো অপূর্ব। তবে দেশটি আমি সামান্যই দেখেছি।’১
ভারতের বহিরাঙ্গিক এ বর্ণনার পাশাপাশি এও জানাচ্ছেন চিঠির শেষে যে মহাভারত এবং রামায়ণ পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। মাস তিনেক পর তিনি আরেক চিঠিতে জানাচ্ছেন : ‘লোকজন এত অর্থহীন আর গুরুগম্ভীর আর রসকষহীন! মেয়ে মানুষেরা সাধারণত সুন্দরী, কিন্তু শূন্য। এদের মধ্যে আনন্দ আর ইন্দ্রিয়াসক্তির সজীব আগুনের অভাব।
এও সম্ভব শিব-ভক্ত, শৃঙ্গাররসাত্মক মন্দির আর তান্ত্রিকবাদের দেশে! ‘ইলিয়াড’-এ ফিরে আসি। এটি যখন আমার কাছে আসে তখন রামায়ণ পড়ছিলাম। আবারও বলি : পক্ষপাতিত্ব বা অবিচার করার ইচ্ছা আমার নেই, তবু গ্রিকদের মধ্যে আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি।
এ জন্য নয় যে, ওরা বেশি মানবীয়, বরং এ জন্য যে এসব বীর আর তাদের অতিমানবীয় কর্মকাণ্ড মানুষের অতিমানবীয় রূপকে তুলে ধরে। অন্যদিকে, ভারতীয় বীররা তুলে ধরে দেবতাদের রূপ। অর্জুন এবং কৃষ্ণের (মরমী এবং ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ছাড়া অট্টোর সংস্করণে যেমনটা দেখা যায়) মধ্যেকার সংলাপ মানুষের তুচ্ছতার সামনে পবিত্র ও বৈরাট্যের এক পরীক্ষা।
তুমি আমার (সৃষ্টি ও ধ্বংসের) হাতিয়ার- কৃষ্ণ বলছেন অর্জুনকে। একিলিসও এক হাতিয়ার, তবে, জানি না, মনে হয়, কিংবা আমাদের কাছে মনে হয় যেন বিপুল ও স্বাধীন ইচ্ছার এক প্রতিভু যা রাম এবং অর্জুনের মধ্য পাওয়া যায় না।’২
রামায়ণ, মহাভারত কিংবা ভগবত গীতার চরিত্রগুলো ও ভারত দেখার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে পাস এমন এক জগতের সামনে এসে পড়েছেন যার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ তার অভ্যস্ত স্বাদের অনুকূল না হলেও তুল্যমূল্যের কঠিন ও পরিশ্রমী পথে প্রবেশে চেষ্টা করছেন। এ পথে তার যাত্রা ছিল দীর্ঘ।
এবং তিনি যত বেশি গভীরে প্রবেশ করছিলেন তত বেশি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনাকে সঠিক ও সমৃদ্ধ করে নিতে পেরেছিলেন। যার ফলে পরবর্তীকালে এসব বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া ও মতামত বদলে গিয়েছিল অনেকটাই।
যে গ্রিক সংস্কৃতির মধ্যে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বলেছিলেন তা ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত না হলেও ভারত তার পরিপক্ব (Madurez) জীবনের মাতৃত্ব অর্জন করতে পেরেছিল। আলোচ্য গ্রন্থে এলেনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পাস বাগানের উপমা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন এ ভাবে : “বাগান হচ্ছে শৈশবের আর ভালবাসার আবেগময় খেলার মঞ্চ।
আমার ক্ষেত্রে দুটি বাগান : মিক্সোয়াকে আমার শৈশবের আর দিল্লিতে আমার পরিপক্বতার (Madurez) । ‘বাগানের গল্প’-এ আমি সে কথা বলেছি।” ৩
পূর্বের ঢালু (Ladera Este) কাব্যগ্রন্থে আমরা তার এ পরিপক্বতার কাব্যময় প্রকাশ দেখতে পাব। আর তার গদ্যময় প্রকাশ দেখতে পাব বানর-ব্যাকরণিক (Monkey G rammarian)’ কিংবা ভারতবর্ষের আলোয় গ্রন্থে।
ভারত, বৃহত্তর পরিসরে- প্রাচ্যের ভাবনা ও সৃজনশীলতা তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। এলেনাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন ‘১৯৬২ সালে প্যারিস ছেড়ে দিল্লিতে আসি। প্রাচ্যে এটা আমার প্রথম সফর নয়।
১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে পরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের কাজ নিয়ে বছরখানেক কাটিয়েছিলাম, প্রথমে ভারতে পরে জাপানে। সেই সময় থেকেই চীন, জাপান, কোরিয়া এবং ভারতের সভ্যতার প্রতি আমি গভীরভাবে আগ্রহী হয়েছিলাম।
পাণ্ডিত্য অর্জনের ইচ্ছা নয়, বরং মননশীল বা নান্দিক কৌতূহলের চেয়ে অতিরিক্ত কিছুর দ্বারা আলোড়িত হয়ে জাপান চীন এবং ভারতের দর্শন এবং কাব্যতত্ত্বের মহান গ্রন্থগুলোর কোনো কোনোটি আমার আগেই পড়া ছিল। আসলে ভারতের সংস্কৃত ভাষার মহান সাহিত্যের চেয়ে বরং চীনা এবং জাপানি গদ্য ও কবিতাকে আমার অনেক কাছের মনে হয়েছিল। অন্যদিকে, ভারতীয় ভাবুকতা আমকে মুগ্ধ করেছিল, এখনও আমাকে মুগ্ধ করে এর মহান ঐক্য, যুক্তির প্রখরতা, অবাধ কল্পনা আর পৌরাণিক চমৎকারিত্ব।”৪
ভারতীয় ভাবুকতার যে অংশটি তাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তা বুদ্ধবাদ। বুদ্ধের প্রতি বা বুদ্ধবাদের প্রতি তার গভীর অনুরাগ এবং শ্রদ্ধা অত্যন্ত গভীর। তিনি মনে করেন, ‘দুটি’ কারণে গৌতম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি : প্রথমত তিনি হলেন সেই লোক যিনি নিজেকে দেবতা বলে দাবি করেননি।
তিনি বললেন : ‘আমি দেবতা নই’ আর একই সময়ে এবং একই কারণে নিজেকে মানব বলেও দাবি করলেন না। বললেন, একজন আদর্শ মানুষের উচিত ‘মানব’ ধারণাকে বর্জন করা।”৫
সেই মৌলিক ১০টি প্রশ্নের বিপক্ষে বুদ্ধের নীরবতা সম্পর্কেও পাসের ব্যাখ্যা বুদ্ধবাদের মৌলিকতাকেই নিশ্চিত করে তোলে।
বুদ্ধের এ নীরবতার সঙ্গে পাস একমত কিনা এলেনা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বলেন “হ্যাঁ এবং না। সবই নির্ভর করে অর্থের মাধ্যমে আমরা কী বুঝলাম তার ওপরে। লোকশ্র“তি রয়েছে বুদ্ধকে ১০টি প্রশ্ন করা হয়েছিল : আত্মা শরীর থেকে স্বতন্ত্র কোনো ব্যাপার (Entidad) কিনা, সময় সসীম নাকি অসীম, মহাশূন্যের কোনো অন্ত আছে কিনা। এ জীবনের পরও কোনো জীবন আছে কিনা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের মৌলিক প্রশ্ন, দার্শনিক এবং ধার্মিকরা সবসময় কোনো না কোনোভাবে এ প্রশ্নগুলোর প্রতি সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধ ছিলেন নিশ্চুপ।
বুদ্ধের নীরবতা বহু বিতর্ক এবং ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে। এ নীরবতার কী অর্থ থাকতে পারে? আমার ধারণা লেভি-স্ট্রাসের মতে, যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নগুলো ছিল সামঞ্জস্যহীন। অর্থহীন সব প্রশ্ন।
তবে কোনো কোনো বুদ্ধবাদী দার্শনিক মনে করেন, এমন কিছু বিষয় আছে যার ব্যাপারে নীরব থাকা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না আর সেই কারণেই বুদ্ধ এদের কোনো জবাব দেননি। শব্দ হচ্ছে দ্বান্দ্বিক : কোনো কিছুকে ইতিবাচক করলে অন্যটি নেতিবাচক হয়ে পড়ে।
এমন এক মুহূর্ত আছে যখন একে ইতিবাচক বা নেতিবাচক, কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। কিংবা বলা যায়, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক, অর্থময়তা এবং অর্থহীনতা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে বা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা তৈরি করে। এটাই হতে পারে বুদ্ধের নীরবতার অর্থ।’৬
লাতিন আমেরিকার লেখকদের মধ্যে সম্ভবত পাস এবং বোর্হেসই গৌতম বুদ্ধকে অন্য যে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের ভাষায় তাকে নিয়ে লিখেছেন।
বোর্হেসের তো একটি আস্ত বই-ই রয়েছে বুদ্ধকে নিয়ে বুদ্ধবাদ কী (Que es el budismo, columbia, Buenos Aires, 1976) নামে। এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। পাস তাকে নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো কেতাব হয়তো লেখেননি কিন্তু তার বিভিন্ন প্রবন্ধে এবং সর্বশেষ এ পুস্তকে-দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধকে নিয়ে প্রসঙ্গত উল্লেখ এবং সশ্রদ্ধ মন্তব্য আমরা দেখতে পাব। বুদ্ধকে নিয়ে পাস-এর চূড়ান্ত মন্তব্য : “ভালবাসি বুদ্ধের সংস্কার; এ হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক।”
মোগল রাজবংশের উল্লেখ ছাড়া ভারতের ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না এটা আমরা সবাই জানি। আমি প্রায় দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি পৃথিবীর অন্য কোনো রাজবংশই মোগলদের বিদ্যা-বৃদ্ধি, শিল্পরুচি, মননশীলতা ও ভাবুকতার উচ্চতার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
সম্রাট বাবুর থেকে শুরু করে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত রয়েছে সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার এক ধারাবাহিক চর্চা। এ রাজবংশের যেন প্রত্যেকের রক্তের মধ্যেই সৃষ্টির উচ্চাকাক্সক্ষা প্রবহমান ছিল। বিশাল সাম্রাজ্য অটুট এবং বিস্তারের পাশাপাশি এ সৃজনশীলতাকে তারা অব্যাহত রেখেছেন সারা জীবন।
মোগল ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন এবং সর্বজ্ঞ পণ্ডিতদের ক’জনইবা জানেন, সম্রাট বাবুরের ‘আত্মজীবনী’র ছায়ার গড়ে উঠেছে সাঁ-ঝ পের্সের মৌলিক কাব্যগ্রন্থ আনাবাস? পাসের ভাষায় : “বাবুর ভারতবর্ষ জয় করেছিলেন। তিনি যে জীবনপঞ্জি লিখেছেন সেখানে কেবল এক যোদ্ধাকেই দেখা যায় না বরং এক কবিকে দেখা যায়।
বাবুরের বইটি সাঁ-ঝ পের্সের আনাবাসকে প্রভাবিত করেছে, লেখক নিজেই আমাকে সে কথা বলেছিলেন।”৭
ভারতবর্ষের বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে এ ধরনের কৌতূহল উদ্দীপক মন্তব্যের পাশাপাশি এ গ্রন্থে রয়েছে পাসের জীবন ও কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ঘটনার উল্লেখ এবং কবির জবানীতে তার প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা। পাসের অনুরাগী মাত্রেই এ বইটি উপভোগ করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল পৃথিবীর বহু সংস্কৃতি ও সভ্যতার নানা সব উচ্ছল স্রোতধারা। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য থেকে দুই হাত ভরে নিয়েছেন তিনি, নিয়েছেন আত্মবিকাশ ও প্রসারের জন্য; দিয়েছেনও প্রচুর। কিন্তু এতসব দেশ ও সংস্কৃতি থাকতে কেবল ভারতবর্ষই তার ‘পরিপক্বতার’ আরেক মাতৃভূমি হয়ে উঠেছিল- এ তথ্য আমাদের শিহরিত না করে পারে না। এলেনার কাছে পাসের এ স্বীকারোক্তি গোপনে আমার কৌতূহলকে উসকে দিয়েছিল অন্য এক প্রশ্নের দিকে : বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তার কোনো আগ্রহ বা ভাবনা ছিল কি না।
১৯৯৫ সালে বিসলুম্ব্রেস দে লা ইন্দিয়া বা ইন লাইট অব ইন্ডিয়া বইটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ২৪ বছর পর প্রকাশিত হলেও তিন-চার জায়গায় অবিভক্ত ভারতের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক সূত্রে বাংলাদেশের উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তৃত বা সংক্ষিপ্ত আলোচনা তাতে নেই। তবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন ঠিকই, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখার তাগিদ বোধ না করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তার সহানুভূতি ছিল স্পষ্ট।
বাংলাদেশ
মার্কিন লেখক শেলডেন রোডম্যান ১৯৭১ সালে পাসের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন (সাক্ষাৎকারের কোথাও সময়ের উল্লেখ নেই। তবে বোঝা যায়, ওটি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে ঘটেছিল।)। সেখানে শেলডেন তার কাছে জানতে চান বাঙালিদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে তার ধারণার কথা :
‘আর বাঙালিরা এখন যে যুদ্ধ করছে?’
‘এটা সাংঘাতিক বেদনাদায়ক ব্যাপার,’ তিনি উত্তর দিলেন। ‘আপনার মতো আমারও সহানুভূতি বাঙালিদের প্রতি ও ভারতীয়দের প্রতি। তবে বাঙালিরা যদি স্বাধীনতা অর্জন করে, তাহলে সেটা ভারতের শর্তের অধীনেই হবে এবং কয়েক বছরের মধ্যে আবার তাদের নতুন করে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। ভারতের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এর ঐক্য ধরে রাখার সমস্যা, একই সঙ্গে তার বহুত্বের সমস্যাও রয়েছে। অতীতে ভারত কোনো জাতি ছিল না, ছিল একটি সভ্যতা। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিতর্ককে একই সভ্যতার মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে।’
[টাংস অব ফলেন এঞ্জেলস, শেলডেন রোডম্যান, নিউ ডাইরেকশনস, ১৯৭৪, পৃ. ১৪২)
পাসের এ মন্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঠিকতা বা দূরদর্শিতা নিয়ে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে; কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তার সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল তর্কাতীত। এ সাক্ষাৎকারে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যায়, এটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু ও বিজয় লাভের মাঝামাঝি কোনো সময়ের ঘটনা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তার মতো একজন অসাধারণ কবি ও প্রাবন্ধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন- এটা আমাদের জন্য কম গৌরবের নয়।
[আলফনসো রেইয়েস মেহিকোর প্রথম সারির লেখকদের একজন। স্প্যানিশ ভাষার গদ্য সাহিত্যে তিনি সঞ্চার করেছেন নতুন প্রাণ। পাস-এর মতো তিনিও ছিলেন মেহিকোর রাষ্ট্রদূত। পাস-এর চিঠিতে যে ইলিয়াড-এর উল্লেখ তা আসলে আলফনসো রেইয়েস কর্তৃক স্প্যানিশে অনূদিত সংস্কারণেরই উল্লেখ।
1. Correspondencia: Alfonso Reyes Y Octavio Paz, Edition de Anthony Stanton, Fondo de cultura Economica, 1999, P. 167-168
2. Correspondecia: Alfonso Reyes Y Octavio Paz, Edicion de Anthony Stanton, Fondo de cultura Economica, 1999, P. 180-181.
3. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998, P-98
4. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998, P-84-85.
5. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998. P-100.
6. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998. P 109-110.
7. Octavio Paz: Las Palabras del arbol, Elena poniatowska. Plaza & Janes Editorial, 1998, P 104-105.]
No comments