এক আলোক মানুষ স্মারকগ্রন্থ by রফিকুর রশীদ

প্রবহমান মানব সমাজকে এগিয়ে নিতে কিছু কিছু মানুষ মৌলিক ভূমিকা রাখেন। ভালো আর আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে তারা কর্মগুণে নিজেরাই হয়ে ওঠেন এক একজন আলোকমানুষ। সত্য ও সুন্দরের সাধনায় মানবজীবন মহিমান্বিত হয়। অনুরূপ মহিমার সুবাসিত গৌরব যারা অর্জন করেন, সমাজের উচিত তাদের মাথার মুকুট করে রাখা। কারণ সমাজে এমন মানুষ বেশি বেশি পরিমাণে দরকার। আর অগ্রজের প্রাপ্য পরিশোধ হতে দেখলে অনুজের অনুভবে ত্যাগের পথ অনুসরণের অনুপ্রেরণা লাভ হয়। তাতে সমাজের সুস্থতা ও সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন সংস্কৃতিবান হওয়ার সংস্কৃতিটাই এখনও ততটা শক্ত-পোক্ত নয়। তাই বহু দরকারি কাজ অনেক দেরিতে হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয় না। অর্থাৎ মনীষার অধীরকারী কোনো কোনো সমাজ হিতৈষীর মরণোত্তর মূল্যায়ন হলেও বহু ক্ষেত্রে আমরা নীরব থাকি। ফলে উত্তর প্রজন্মের কাছে মহাপ্রাণ মানুষটির সার্বজনীন সৃষ্টি, কীর্তি ও অর্জন ম্লান হয়ে আসে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থ তেমনি স্মৃতি-ধূসরতায় আচ্ছন্ন হতে যাওয়া এক আলোকমানুষকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে এনেছে, তুলে ধরেছে ভাবী কালের সামনে। গ্রন্থটির নাম ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম’।
দেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বের সমুদ্রশাসিত, নদীবাহিত ও ভূবৈচিত্র্যময় জেলা কক্সবাজারের এক প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ স আ ম শামসুল হুদা চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর হয়ে একাই কয়েকজনের কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন; শিক্ষকতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া, রাজনীতি, আইন-ব্যবসা, সমাজ সেবা; সবখানে থাকেননি শেষতক। রাজনীতি ও আইন-ব্যবসা ধেকে সরে এসেছেন। বাকিগুলোতে সাফল্যের জয়মাল্য কুড়িয়েছেন। কক্সবাজার সরকারি কলেজের দীর্ঘকালের সফল অধ্যক্ষ এবং বক্সবাজার আইন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ তিনি। কক্সবাজার শহরের সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পৌর প্রিপারেটরি হাই স্কুলের তিনি মুখ্য প্রতিষ্ঠাতা। আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেছনে তার প্রেরণাদায়ী ভূমিকা রয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় নানা উপলক্ষে সব সভা-সমাবেশ আলোকিত করে তিনি সমাজে সৌরভ ছড়িয়েছেন। মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। জমিদার-নন্দন হয়েও সমাজহিতৈষীর ভূমিকায় নিবেদিত থেকে তিনি সবার প্রাণের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
সমাজকে জ্ঞানের আলোয় দ্যুতিময় করা এ কর্মবীরের মহাপ্রয়াণের বিশ বছর পর তার স্মৃতি ও কর্মের মূল্যায়ন সমৃদ্ধ হয়ে ২০১৪ সালে কবি আসিফ নূরের সম্পাদনায় প্রকাশিত অধ্যক্ষ শা আ ম শামসুল হুদা চৌধুরী স্মারকগ্রন্থে ছয়টি পর্বে ৫১টি গদ্য এবং ১২টি নিবেদিত কবিতা মুদ্রিত হয়েছে। সোনালি পালক, রাজরকন, গুরুবয়ান, আলোর মিছিল ও রক্তরাগ শিরোনামে বিভাজিত পর্বগুলো জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী, অনুবাদক জাফর আলম, প্রফেসর মোশতাক আহমদ, কবি মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক সোমেশ্বর চক্রবর্তী, অধ্যাপক মুফীদুল আলম, অ্যাডভোকেট নূরুল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ রশিদ বিএ, অ্যাডভোকেট সালামতুল্লাহ, কমরেড ইদ্রিস আহমদ, সাইফুল্লাহ খালেদ, প্রফেসর জানে আলম চৌধুরী, অধ্যাপক মমতাজুল হক, মো জসিজুল হক সরকার, অধ্যাপক মনজুরুল হক হেলাল, প্রফেসর সিরাজুল মোস্তফা, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ফজলুল হক চৌধুরী, অরূপ বড়ুয়া তপু, প্রকৌশলী দিদারুল আলম, ইউসুফ মো. শামসুল হুদা, আহসান উল মওলা, শাহেদ ইকবাল, নাদিয়া সানি প্রমুখের লেখা অত্যন্ত সুখপাঠ্য আকর্ষণীয়। নিবেদিত কবিতায় সুলতান আহমেদ, হাফিজ রশিদ খান, আদিল চৌধুরী, ভাগ্যধন বড়ুয়া, অরণ্য শর্মা ও ইবনে আলতাফ বিশেষ জ্যোতিষ্মান। স্মারকগ্রন্থের ফ্ল্যাপে কবি রফিক আজাদ লিখেছেন, ‘বইটি নতুন প্রজন্মের চোখে ভালো কিছুর আলো ফেলবে।’ কবির এ আশাবাদ সর্বোতভাবেই সত্য। সুন্দর জীবনের নন্দিত আলোকচ্ছবি হয়ে এ গ্রন্থ উত্তর প্রজন্মকে প্রাণিত করবেই। সুলিখিত সম্পাদকীয়তে কবি আসিফ নূর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মিত্র বাহিনীর সৈনিকদের সমাধিলিপি থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘For your tomorrow/we gave our today;’. আসলেই অধ্যক্ষ চৌধুরী ভাবী কালের জন্যই মোমের মতো নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আলোকাঞ্জলি প্রদান করে গেছেন। তার প্রয়াস ও সাফল্যের জয়ধ্বনি উত্তরকালকে গাইতেই হবে। গ্রন্থের শেষে ‘আলোছায়া’ শিরোনামে শামসুল হুদা চৌধুরীর এক গুচ্ছ ছবি ও প্রতিকৃতি ঠাঁই পেয়ে এটির সৌকর্য বৃদ্ধি করেছে।
দু-একটি তথ্য-বিভ্রাট এবং বিষয়ের কারণে বহু লেখায় একই কথার উল্লেখ ঘটেছে। এটুকু ছাড়া সমগ্র গ্রন্থটি খুব আকর্ষণীয়। একটি অতি দরকারি সামাজিক দায় সম্পাদনে আসিফ নূর যে কঠোর শ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন সে জন্য তিনি উচ্চ প্রশংসার যোগ্য। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ ও সামগ্রিক শিল্প নির্দেশনা অভিজাত সুন্দর, বইটি সর্বমহলে সমাদর পাবে, এতে সংশয়ের কারণ নেই। হ খালেদ মাহবুব মোর্শেদ
বই
চোখের আলোয় দেখেছিলেম
অধ্যক্ষ স আ ম শামসুল হুদা চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ
সম্পাদক: আসিফ নুর
শিল্প সম্পাদক: ধ্রুব এষ
পৃষ্ঠা ।। ২৬৪ দাম ।। ৫০০ টাকা

No comments

Powered by Blogger.