অভিমত- ভূমিকম্প আতঙ্কিত নয় সতর্ক হোন- সম গোলাম কিবরিয়া
বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্পই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও ভূমিকম্পের বেলায় সে সুযোগ নেই। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগাম খবরের ভিত্তিতে জানমাল রায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু ভূমিকম্প সাধারণত হঠাৎ করে ঘটে থাকে। ফলে জানমাল রার প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
ভূমিকম্পের কারণে সাধারণত ঘরের ছাদ বা দেয়াল ধসে, বৈদু্যতিক খুঁটি বা গাছ পড়ে গিয়ে য়তি ঘটিয়ে থাকে। এ ছাড়াও বৈদু্যতিক তার পড়ে বা গ্যাস লাইন ফেটে অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটে এবং তা ছড়িয়ে পড়ে য়তি আরও বেড়ে যায়। ফলে ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলে হতাহতের ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য ভূমিকম্পের পূর্ববতর্ী, ভূমিকম্পের সময় এবং ভূমিকম্প পরবতর্ীতে করণীয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে এবং তা অনুসরণ করতে হবে। ভূমিকম্প পূর্ববতর্ী করণীয়সমূহের মধ্যে রয়েছে বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি নির্মাণ করা, গ্যাস, বিদু্যৎ ও পানি সরবরাহের সংযোগ ঝুঁকিমুক্ত কি না তা নিয়মিত পরীা করা, বাসাবাড়িতে এগুলোর অবস্থান এবং বন্ধ করার নিয়ম সম্পর্কে সকলকে জানিয়ে রাখা, জরম্নরী অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার সম্ভাব্য একাধিক পথ ও বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গা পরিবারের সকলকে দেখিয়ে রাখা, ভূমিকম্পের কারণে ঘরের ভারি আসবাবপত্র যেমন আলমারি, শেলফ, ফুলের টব, ছবির ফ্রেম ইত্যাদি পড়ে গিয়ে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারে সে জন্য পেছনে থেকে আংটা লাগিয়ে দেয়ালের সঙ্গে আটকিয়ে রাখা ভারি ও ভঙ্গুর জিনিসপত্র সেলফের নিচের তাকে রাখা, ফায়ার স্টেশন, হাসপাতাল/ কিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের টেলিফোন নম্বর বাড়ির প্রকাশ্য স্থানে রাখা যাতে সকলে তা দেখতে পারে, বহুতল ভবন/মার্কেট/হোটেল/ বিদ্যালয়ের সিঁড়ি প্রশস্থ করা এবং জরম্নরী দরজা ও সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখা, ভূমিকম্পের সময় আত্মরার জন্য ঘরে একটি ব্যাগে রেডিও, টর্চ লাইট, হাতুড়ি, হেলমেট, কুড়ালও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জারসমূহ মজুদ রাখা। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরম্নরী। ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাসিন্দা ভাড়া বাড়িতে অথবা ফ্যাট বাড়িতে বসবাস করেন। বাড়ির মালিক বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে বাসাটি নির্মাণ করেছেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। ফলে যে বাসায় আপনি বসবাস করছেন তা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি মোকাবেলায় কতটুকু সম তা জানা সম্ভব নয়। অধিকন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেট শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এ পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পের বিষয়ে আতঙ্কিত না হয়ে কি করতে হবে সে বিষয়ে জেনে রাখাই অধিক গুরম্নত্বপূর্ণ। এ পর্যায়ে দেখে নেয়া যাক, ভূমিকম্পের সময় কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়। ভূমিকম্প অনুভূত হলে শানত্ম থাকতে হবে, আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করা বা সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি থেকে বের হবার চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ ভূমিকম্প সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড স্থায়ী হয় এবং তা বুঝে উঠতেই ৫-১০ সেকেন্ড সময় চলে যায়। তাই ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে দৌড়ে বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে হবে এবং টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোন আসবাসপত্রের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। যার নিচে আশ্রয় নেবেন তা এমনভাবে ধরে থাকতে হবে যাতে সেটি মাথার ওপর থেকে সরে না যায়। এ সময়ে শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে অথবা পিলারের পাশে আশ্রয় নেয়া উত্তম। বারান্দা, ব্যালকনি, জানালা, বুকশেলফ, আলমারি, কাঠের আসবাবপত্র, বাঁধানো ছবি বা অন্য কোন ঝুলনত্ম ভারি বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে, যাতে ঐ সকল জিনিস গায়ের ওপর না পড়ে। রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রম্নত সম্ভব বের হয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে দ্রম্নত বাড়ির বিদু্যতের মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং গ্যাসের চাবি বন্ধ করতে হবে। উঁচু বাড়ির জানালা, বারান্দা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা বোকামি, কোনভাবেই এ কাজ করা যাবে না। এ সময়ে লিফট ব্যবহার করা যাবে না। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বিদু্যতের খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিতে হবে। জনাকীর্ণ ঘর যেমন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, সিনেমা হল, মার্কেটে থাকলে বাইরে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি করা উচিত নয়। পণ্য সামগ্রীর শেলফ থেকে দূরে আশ্রয় নিতে হবে এবং দু' হাত দিয়ে মাথা ঢেকে বসে পড়তে হবে। গাড়িতে থাকলে ওভারব্রিজ ফাইওভার গাছ ও বিদু্যতের খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামাতে হবে। ভূকম্পন না থামা পর্যনত্ম গাড়ির ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। ভূমিকম্পের ফলে ভাঙ্গা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। এ সময়ে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে যাতে ধুলাবালি শ্বাসনালীতে না ঢোকে। সম্ভব হলে দেয়ালের পাশে সরে আসতে হবে এবং উদ্ধারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হবে। শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এ সময়ে যাতে শ্বাসযন্ত্রে ধুলাবালি প্রবেশ না করে।এ সকল বিষয় ছাড়াও ভূমিকম্প পরবতর্ীতে করণীয় কিছু বিষয় রয়েছে, যা জানা খুবই জরম্নরী। কারণ সাধারণত একবার ভূমিকম্প হলে পরে আরও কম্পনের ঘটনা ঘটে থাকে। ভূমিকম্প পরবতর্ী করণীয়সমূহ হলো প্রথমবার অনুভূত কম্পন থেমে যাওয়ার পর ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নেয়া, বৈদু্যতিক/ টেলিফোনের খুঁটি ও তার, উঁচু দেয়াল ও ভবন থেকে দূরে থাকা, গ্যাস বা অন্য কোন রাসায়নিক দ্রব্যের গন্ধ পেলে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়া, জরম্নরী তথ্য পাওয়ার জন্য সম্ভব হলে রেডিও সেট ব্যবহার করা, কেউ অসুস্থ হলে যথাসম্ভব দ্রম্নত প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সংস্থাসমূহকে সহযোগিতা করা, উদ্ধারের েেত্র শিশু বৃদ্ধ অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেয়া। মনে রাখতে হবে প্রথমবার কম্পনের কারণে তিগ্রসত্ম বা আংশিক তিগ্রসত্ম ভবন, ব্রিজ ও বিভিন্ন অবকাঠামো পরবতর্ী ভূকম্পনে ধসে যেতে পারে, তাই সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তবে এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে য়তি কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই এ সকল বিষয়ে নিজে জানতে হবে এবং প্রতিবেশীকেও জানাতে হবে। সর্বোপরি ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজন নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।
No comments