ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে এত মৃত্যু! ৮ বছরে শুধু ঢাকা অঞ্চলেই নিহত ১৩২ by শুভ্র দেব

ট্রেনের ছাদে বিপজ্জনক ভ্রমণে ঘটছে একের পর এক ঘটনা। ঝরছে অনেক তাজা প্রাণ। শূন্য হচ্ছে মা বাবার কোল। বিপজ্জনক, ভয়ংকর জেনেও অনেকেই ভ্রমণ করছে ট্রেনের ছাদে । আবার ছাদে ভ্রমণ করে সর্বস্ব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেক। তবুও থেমে নেই ছাদে ভ্রমণ। ঢাকা রেলওয়ে থানার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে গত ৮ বছরে শুধুমাত্র ঢাকা অঞ্চলে মারা গেছেন ১৩২ জন। এরমধ্যে ২০১০ সালে ১০ জন, ২০১১ সালে ১২ জন, ২০১২ সালে ১৯ জন, ২০১৩ সালে ৬ জন, ২০১৪ সালে ৩ জন, ২০১৫ সালে ২ জন, ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ৫৮ জন ও ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত ৮ জন। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, চাকরি, শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুরসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছে। ঢাকা রেলওয়ে থানার পরিসংখ্যান থেকে জানা যারা নিহত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগের বয়স  ১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।
২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা। ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন চার বন্ধু। সাপ্তাহিক ছুটির বাইরে সরকারি বাড়তি ছুটি পেয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী দ্রুতযান ট্রেনের ছাদে বসে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলেন তারা। একপর্যায়ে নওগার রাণীনগরের একটি ওভার ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েন সবাই। খবর পেয়ে সান্তাহার জিআরপি পুলিশ তাদের গিয়ে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে তাদের মরদেহটাই সেখানে পড়ে ছিল। জিআরপি সূত্রে জানা গেছে নিহতরা হলেন, দিনাজপুর চিরিবন্দর উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম, নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আমিনুল ইসলাম, পঞ্চগড় বোদা উপজেলার আপেল মাহমুদ ও পার্বতীপুর উপজেলার মো. মনির। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে তাদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। শুধু তাই নয় গত ৭ই মে নেত্রকোনার পূর্বধলা থেকে ঢাকাগামী বলাকা কমিউটার ট্রেনের ছাদে উঠেছিল ১৩ বছর বয়সী কিশোর ইমরান হোসেন। পূর্বধলার থেকে শ্যামগঞ্জ যাওয়ার পথে চলন্ত ট্রেনেই সে এক বগি থেকে আরেক বগিতে লাফ দেয়। কিন্তু সে পড়ে যায় দুই বগির ফাঁকে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ইমরান ময়মনসিংহের ঈশ্বরদী উপজেলার ফানুর গ্রামের মোস্তফার ছেলে।
অসচেতনতা ও অসাবধানতাবশত যে শুধু ট্রেনের ছাদ থেকে মৃত্যুবরণ করছে এমন না। এর বাইরে ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগ রয়েছে অহরহ। ২৩শে মার্চ গফরগাঁওয়ে ঘটেছে এমনই এক ঘটনা। চারিপাড়া রেল ক্রসিংয়ে অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। খবর দেয়া হয় পুলিশে। পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। ততক্ষণে খবর চলে যায় ওই যুবকের বাড়িতে। স্বজনরা এসে তার মরদেহ শনাক্ত করে। ৩৯ বছর বয়সী ওই যুবকের নাম খোকন মিয়া। সে পাগলা থানার দিঘারপাড় গ্রামের বাসিন্দা। একটি সিগারেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে সে কাজ করতো। কিন্তু পরিবারের অভিযোগ খোকনকে ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, পারিবারিক কাজে সে টঙ্গী গিয়েছিল। রাতেই তার বাড়ি ফেরার কথা রয়েছে। কিন্তু গভীর রাতে খোকনের মোবাইল ফোন থেকে অজ্ঞাত কেউ ফোন দিয়ে জানায় খোকন অসুস্থ। সে জামালপুরের দেওগঞ্জে আছে। জরুরি চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তাই ৫ হাজার টাকার প্রয়োজন। টাকা পাঠানোর পর আর খোকনের মোবাইলে তারা যোগাযোগ করতে পারেননি। তাদের অভিযোগ ছিনতাইকারীরা খোকনকে ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক মানবজমিনকে বলেন, আমরা ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের পক্ষে না। কারণ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে অনেকেই মারা গেছেন। তাই আমরা যাত্রীদের ট্রেনের ছাদে উঠতে মানা করি। কোনো যাত্রীকে ট্রেনের ছাদে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে নামানো হয়। তারপরও অনেক যাত্রী আছে যারা টিকিট কেটে ছাদে উঠে বসে থাকে। বিশেষ করে গরমের দিনে বাতাসের জন্য অনেকে ছাদে উঠে। ওসি বলেন, কিছু বিশেষ দিনে ট্রেনে যাত্রীদের চাপ থাকে অনেক। তখন পুলিশ বাধা দিলেও কোনো কোনো কাজ হয় না। কারণ রেলওয়ে পুলিশের জনবল কম। একটি ট্রেনে দায়িত্ব পালন করে ২-৩ জন পুলিশ। যখন একসঙ্গে শতাধিক যাত্রী ছাদে উঠে তখন আর সম্ভবপর হয় না। অনেক যাত্রী এক সঙ্গে উঠলে তখন আর কিছু করার থাকে না। তবে আমরা জনসচেতনার জন্য কাজ করছি। লিফলেট বিতরণ, জনসচেতনতামূলক সভা, মাইকিং করে থাকি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, শখের বশে, সিট সংকট অথবা প্রচণ্ড গরমে বাতাসের জন্য অনেকেই ট্রেনের ছাদে উঠেন। এর বাইরে অপকর্ম করতে অনেকেই ছাদে উঠে। বিশেষ করে মাদকসেবীরা নির্বিঘ্নে সেখানে মাদক সেবন করে। ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করে। আবার পূর্ব শত্রুতার জের ধরে অনেকেই ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে। আবার অন্যত্র হত্যা করে ট্রেনের উপর থেকে ফেলে দেয়া। অপরাধ ঢাকতে এমন পথ অবলম্বন করে অপরাধীরা। কারণ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুতে সাধারণত আসামিকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগে অনেক সময় থানায় মামলা হয়। তবে মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি থাকে না। দিন পার হলে ঘটনাটিকে শুধুই অসাবধানতাবশত মৃত্যু হিসাবে ধরে নেয়া হয়। সূত্র বলছে, ট্রেনের ছাদে অপরাধ হলে প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। চলতি বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হয় নরসিংদীর ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সাকিব খান। সে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। পরে ওই দিনই রেলওয়ে পুলিশ ঢাকার বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণফুলি এক্সপ্রেসের ছাদ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। সাকিব নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হোমিও চিকিৎসক মো. শরফুউদ্দিনের ছেলে। মা পারুল বেগম ফুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সাকিবের বাবার অভিযোগ ছিল স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে তার ছেলেকে খুন করা হয়েছে। ফেসবুকে নরসিংদীর স্থানীয় এমপির ছবির নিচে খারাপ কমেন্টস করার জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। 
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শামসুউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ট্রেনে ছাদে ভ্রমণে আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। এরপরও যারা ছাদে ভ্রমণ করে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়। তবে ঈদ আসলে তাই নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ট্রেনের ছাদে ভ্রমণে যাত্রীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য। জনসচেতনতার জন্য লিফলেট, মাইকিং, পোস্টারিং, সভা করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.