রাজধানীজুড়ে শতাধিক অবৈধ বাসস্ট্যান্ড by হাফিজ মুহাম্মদ
নিউ মার্কেট থেকে গাবতলী, ফকিরাপুল থেকে যাত্রাবাড়ী কাউন্টারে ঠাসা।
দিন-রাত
যানজট। সীমাহীন দুর্ভোগ, যন্ত্রণা। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রতিদিনের চিত্র
এটি। কোনোভাবেই মুক্তি মিলছে না যানজট থেকে। এ যানজটের অন্যতম কারণ অবৈধ
বাস টার্মিনাল ও কাউন্টার। কর্তৃপক্ষের নাগালের মধ্যেই সড়কগুলো দূরপাল্লার
বাস টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। নির্দিষ্ট স্থান রেখে তা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের
আনাচে-কানাচে। দিনের বেলায় এসব বাস কম প্রবেশ করলেও রাতে তাদের দৌরাত্ম্য
বেড়ে যায়। মাঝে মধ্যে আবার কোস্টার পরিবহন দিয়ে মূল টার্মিনালে নিয়ে যায়।
পণ্য পরিবহনগুলোও এসময় প্রবেশ করতে শুরু করে। রমজান ও ঈদে শহর কি আকার ধারণ
করে সে দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষ। সরজমিন দেখা যায় নিউমার্কেট থেকে
গাবতলী, ফকিরাপুল থেকে সায়েদাবাদ পুরোটাই যেন বাসস্ট্যান্ড।
আকতার হোসেন। মতিঝিলে একটি প্রাইভেট ফার্মের কর্মকর্তা। প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরেন রাত আটটার পরে। আর মিরপুর রোডে যখন আসেন তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা থেকে নয়টা। শুধু এখান থেকে তার মিরপুরের বাসায় পৌঁছতে লেগে যায় এক/দেড় ঘণ্টা। এর কারণ আসাদগেট থেকেই আকতারকে জ্যামে থাকতে হয়। তখন গাড়ির গতি পিঁপড়ার গতি ধারণ করে। আকতার বলেন, আসাদগেট থেকে রাস্তার পাশে পরিবহনগুলো থামানো থাকে। কোথাও তা ঘুরানো হয়। এ কারণেই মূলত যানজট বাদে। শ্যামলী থেকে কল্যাণপুর-দারুসসালাম পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশেই এক দুই লেন ধরে থামানো থাকে পরিবহন। এ কারণেই যানজটের সৃষ্টি হয় বলে তিনি মনে করেন।
শুধু আকতার হোসেন নয়। এ রোড দিয়ে গণপরিবহনে চলাচলকারী সাধারণ মানুষের সবার অবস্থাই বেগতিক। তাদের প্রতিনিয়ত সড়কে ব্যয় করতে হয় কয়েক ঘণ্টা। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে তাদের কখনো গভীর রাতও হয়ে যায়। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় দেখছেন না তারা। সাধারণ নাগরিকরা এ সমস্যার কারণ হিসেবে দুষছে শহরের সড়কগুলোয় অব্যবস্থাপনা, পরিবহন কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য, যত্রতত্র অবৈধ টার্মিনাল তৈরি করা। অন্যদিকে বাস টার্মিনালের রাজস্ব আদায়কারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে তিনটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল ছাড়া তাদের আর কোনো বৈধ টার্মিনাল নেই। তারা গাবতলী, মহাখালী এবং সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকেই কেবল রাজস্ব পান। এর বাইরের টার্মিনাল ও কাউন্টারগুলো অবৈধ। এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের একই দাবি রাজধানীতে তিনটি মাত্র বৈধ বাস টার্মিনাল রয়েছে। এর বাইরে যেসব টার্মিনাল রয়েছে সেগুলো বিভিন্ন উপায়ে ম্যানেজ করে চলেন কিছু বাস মালিক। প্রশাসন এবং প্রভাবশালী মহলই এর সঙ্গে জড়িত। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাস থামিয়ে রেখে যানজট তৈরি করে বলে তারাও স্বীকার করেছেন।
সরজমিন দেখা যায়, ঢাকার বাস টার্মিনাল এখন আর নির্দিষ্ট স্থানে আটকে নেই। যেমন গাবতলী বাস টার্মিনাল এখন টেকনিক্যাল, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজগেট, আসাদগেট, ফার্মগেট, পান্থপথ ও কলাবাগান ও নিউমার্কেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এসব জায়গায় গড়ে উঠেছে বাস কোম্পানির শত শত টিকিট কাউন্টার। গাবতলীর পার্শ্ববর্তী মিরপুরের মাজার রোড, এক নম্বর, রাইনখোলা ও দুই নম্বরেও রয়েছে এগুলোর স্টেশন এবং কাউন্টার। রাস্তার দুই পাশে দুুই লেন পর্যন্ত থাকে বাস থামানো। আর অভ্যন্তরীণ রোডের গণপরিবহনগুলো চলাচলে ফাঁকা থাকে এক কিংবা দুই লেন সড়ক। একারণে যানজট প্রতিদিনই মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীদের এখন আর হাতে সময় গুণে বের হলে চলে না।
অন্যদিকে সায়েদাবাদ টার্মিনালের চিত্রও একইরকম। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক যেন পুরোটাই বাস টার্মিনাল। আর তার বিস্তৃতি এখন পৌঁছে গেছে ফকিরাপুল, মতিঝিল, পলাশী মোড়, মালিবাগ, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, মানিকনগর, বাসাবো, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা ও নর্দা পর্যন্ত। অন্যদিকে মিরপুর ১০, ১৪ নম্বর, কচুক্ষেত ও পান্থপথেও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ওপর থেকে চলাচলকারী বাসকে থামিয়ে রাখতে দেখা যায়। এসব স্থানেও প্রায় সব বাস কোম্পানির রয়েছে কাউন্টার। সায়েদাবাদ থেকে বের হওয়ার রাস্তায় এসব পরিবহনের যাত্রাবাড়ী, পোস্তাগোলা, জুরাইন, সাইনবোর্ডসহ আরো একাধিক স্থানে কাউন্টার রয়েছে। সেসব স্থানেও সড়কের উপরেই বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হয়। এসব অবৈধ বাসস্টেশনের বিরুদ্ধে কখনো পুলিশকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
তবে ভিন্ন চিত্র মহাখালী বাস টার্মিনালের। এ বাস টার্মিনালে বাইরে খুব একটা স্ট্যান্ড নেই। এখান থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো শুধুমাত্র এয়ারপোর্ট এবং উত্তরা থেকে যাত্রী উঠা-নামা করে। এসব স্থানে কিছু কাউন্টার রয়েছে। এ রুটের আবদুল্লাহপুরে দিন-রাত বেশিরভাগ সময় সড়কের উপর বাস থামানো দেখা যায়। এ কারণে আবদুল্লাহপুরে প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে।
এ তিনটি টার্মিনালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অরাজকতা ঘটছে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও অরাজকতা রোধে তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। সোমবার রাতে কল্যাণপুর বাস টার্মিনালের (অবৈধ) সামনের সড়কে প্রচুর যানজট দেখা যায়। এ যানজটে দাঁড়িয়েই বাসগুলো যাত্রী ওঠানামা করে। সামনে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তারা কিছুই বলছে না। কল্যাণপুর ব্রিজের নিচে দায়িত্ব পালনরত এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, অনেক পরিবহন কোম্পানি তাদের যাত্রীদের সুবিধার্থে এখানে কাউন্টার করেছেন। আমরা কি বলবো, আমাদের স্যারেরাই তো কিছু বলছেন না।
সাধারণ বাস মালিকরা বলেছেন, মূলত প্রভাবশালী মালিকদের কারণেই মূল টার্মিনালের ভেতর থেকে বাস চলাচল নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রভাবশালী মালিকরা পুলিশকে ম্যানেজ করে নিজেদের ইচ্ছামতো কাউন্টার বসিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেন। যানজটে পড়ে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। বিভিন্ন বাস কোম্পানির কাউন্টার মাস্টারদেরও কথা- টার্মিনালের বাইরে যেসব স্থানে কাউন্টার রয়েছে সেসব স্থান বাস টার্মিনাল স্থাপন করা হয়নি। শুধু বাস থামিয়েই যাত্রী উঠানো-নামানো হয়। এসব কাউন্টারের বৈধতা কিংবা কোনো অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন- এটা কোম্পানির ম্যানেজার জানে। তারা এটা জানেন না।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে মহাখালী এবং গাবতলী বাস টার্মিনালের উপর দিয়ে চলাচলকারী পরিবহনগুলো উত্তর সিটি করপোরেশনকে রাজস্ব দেয় এবং সায়েদাবাদের উপর থেকে চলাচলকারী বাসগুলো রাজস্ব দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু তারা যে মূল টার্মিনালের বাইরে আরো একাধিক টার্মিনাল, বাস কাউন্টার গড়ে তুলেছে সেটা সম্পর্কে দায়সারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী পরিবহন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক লে. কর্নেল সাবের সুলতান বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশন দুটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল থেকে (গাবতলী, মহাখালী) শুধু রাজস্ব আদায় করে। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে বাস কোম্পানিগুলো যে জায়গায় ভাড়া নিয়ে কাউন্টার গড়ে তুলেছে সেগুলো মালিক পক্ষর অনুমতি নেয়া আছে কিনা সেটা আমি জানি না। সিটি করপোরেশন এগুলো থেকে রাজস্ব পায় না। তবে টার্মিনালের উপর থেকে চলাচলকারী বাসগুলো থেকে টার্মিনাল ফি অনুসারে রাজস্ব আদায় করা হয়। আর পরিবহন বিভাগের নতুন জেনারেল ম্যানেজার লতিফ খান বলেন, তিনি এখনো কাগজপত্র দেখেননি, তবে এগুলো যদি অবৈধ হয়ে থাকে তাহলে সিটি করপোরেশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নিতাই চন্দ্র সেন জানান, আমাদের দূরপাল্লার একমাত্র বাস টার্মিনাল হচ্ছে সায়েদাবাদ। এর বাইরে আর কোনো বাস টার্মিনাল নেই। এখান থেকে শুধু রাজস্ব আদায় করা হয়। তবে বাইরে থেকে যেসব বাস ছেড়ে যায় সেগুলোও টার্মিনালের ফি পরিশোধ করে এর উপর দিয়ে চলাচল করে। শহরের অভ্যন্তরে বাসস্টেশন কিংবা কাউন্টার থাকলে অথবা রাস্তার উপরে বাসস্ট্যান্ড করে রাখলে তা অবৈধ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আহম্মেদ মজুমদার বলেন, ঢাকায় সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী এই তিনটি টার্মিনাল দূরপাল্লার বাসের জন্য সরকার অনুমোদিত। এর বাইরে বিভিন্ন সরকারি জায়গা দখল করে অনেক বাস মালিক কাউন্টার নির্মাণ করে টার্মিনাল বানিয়ে ফেলছে। মানিকনগর, কমলাপুর ও কল্যাণপুরে প্রায় দেখা যায় রাস্তার দুই পাশে দিনের পর দিন গাড়ি থামিয়ে রাখার পরেও সেগুলো দেখার কেউ নেই। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের একটা গাড়ি রাস্তার উপর রাখলে কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ রেকার নিয়ে চলে আসে। অথচ পরিবহন মালিক পক্ষ প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চলে। পুলিশ আমাদের অভ্যন্তরীণ রুটের গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও দূরপাল্লার এ অবৈধ বাসস্টেশন-কাউন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের গাড়িগুলো রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার কথা থাকলেও তারা দায়িত্বরত ট্রাফিকদের টাকা দিয়ে বিকাল থেকেই প্রবেশ করতে শুরু করে।
ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল করিম বলেন, মূল টার্মিনালের বাইরে যেসব স্থানে দূরপাল্লার পরিবহনের কাউন্টার রয়েছে সেটাকে টার্মিনাল বলা যায় না। এগুলো টার্মিনালের উপর দিয়েই যায়। তবে কিছু কিছু বাস শহরের ভেতরে প্রবেশ করে কাউন্টার থেকে যাত্রী তুলে। এগুলো রাতেই কেবল ভেতরে প্রবেশ করে।
দিনের বেলায় কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে ভেতরে প্রবেশ করে না। এগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, পূর্বে আরো বেশি কাউন্টার ছিল। সেগুলো পর্যায়ক্রমে কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এসব কাউন্টারের কারণে যানজট বৃদ্ধি পেলে সেগুলো কমিয়ে আনা হবে।
সায়েদাবাদের সড়কে যেন কোনো বাস না দাঁড়ায়, সে জন্য ২০১৬ সালে একবার নির্দেশনা জারি করেছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। তখন নগর ভবনে পরিবহন মালিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক যৌথসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল টার্মিনালের বাইরে কোনো বাস দাঁড়াবে না। শুধু টার্মিনালের ভেতর থেকে বাস ছেড়ে যাবে। টিকিট বিক্রি হবে টার্মিনালের ভেতর থেকে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের পর আড়াই বছর কেটে গেলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
রাস্তার উপরে কোনো বাস দাঁড় করে রাখা হলে সেটা দেখা এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের। টার্মিনালের ভেতরে কোনো বাস রাখার বিধান নেই বলে জানান সিটি করপোরেশনের এক টার্মিনাল ব্যবস্থাপক। মালিকরা তাদের বাসগুলো রাখবেন নিজস্ব ডিপোতে। ওই ডিপো থেকে টার্মিনালে এসে যাত্রী নিয়ে বাস গন্তব্যে চলে যাবে। কিন্তু এ নিয়ম কেউ মানছে না। সবাই তাদের বাসগুলো টার্মিনালের ভেতরই রাখছেন।
আকতার হোসেন। মতিঝিলে একটি প্রাইভেট ফার্মের কর্মকর্তা। প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরেন রাত আটটার পরে। আর মিরপুর রোডে যখন আসেন তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা থেকে নয়টা। শুধু এখান থেকে তার মিরপুরের বাসায় পৌঁছতে লেগে যায় এক/দেড় ঘণ্টা। এর কারণ আসাদগেট থেকেই আকতারকে জ্যামে থাকতে হয়। তখন গাড়ির গতি পিঁপড়ার গতি ধারণ করে। আকতার বলেন, আসাদগেট থেকে রাস্তার পাশে পরিবহনগুলো থামানো থাকে। কোথাও তা ঘুরানো হয়। এ কারণেই মূলত যানজট বাদে। শ্যামলী থেকে কল্যাণপুর-দারুসসালাম পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশেই এক দুই লেন ধরে থামানো থাকে পরিবহন। এ কারণেই যানজটের সৃষ্টি হয় বলে তিনি মনে করেন।
শুধু আকতার হোসেন নয়। এ রোড দিয়ে গণপরিবহনে চলাচলকারী সাধারণ মানুষের সবার অবস্থাই বেগতিক। তাদের প্রতিনিয়ত সড়কে ব্যয় করতে হয় কয়েক ঘণ্টা। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে তাদের কখনো গভীর রাতও হয়ে যায়। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় দেখছেন না তারা। সাধারণ নাগরিকরা এ সমস্যার কারণ হিসেবে দুষছে শহরের সড়কগুলোয় অব্যবস্থাপনা, পরিবহন কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য, যত্রতত্র অবৈধ টার্মিনাল তৈরি করা। অন্যদিকে বাস টার্মিনালের রাজস্ব আদায়কারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে তিনটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল ছাড়া তাদের আর কোনো বৈধ টার্মিনাল নেই। তারা গাবতলী, মহাখালী এবং সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকেই কেবল রাজস্ব পান। এর বাইরের টার্মিনাল ও কাউন্টারগুলো অবৈধ। এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের একই দাবি রাজধানীতে তিনটি মাত্র বৈধ বাস টার্মিনাল রয়েছে। এর বাইরে যেসব টার্মিনাল রয়েছে সেগুলো বিভিন্ন উপায়ে ম্যানেজ করে চলেন কিছু বাস মালিক। প্রশাসন এবং প্রভাবশালী মহলই এর সঙ্গে জড়িত। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাস থামিয়ে রেখে যানজট তৈরি করে বলে তারাও স্বীকার করেছেন।
সরজমিন দেখা যায়, ঢাকার বাস টার্মিনাল এখন আর নির্দিষ্ট স্থানে আটকে নেই। যেমন গাবতলী বাস টার্মিনাল এখন টেকনিক্যাল, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজগেট, আসাদগেট, ফার্মগেট, পান্থপথ ও কলাবাগান ও নিউমার্কেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এসব জায়গায় গড়ে উঠেছে বাস কোম্পানির শত শত টিকিট কাউন্টার। গাবতলীর পার্শ্ববর্তী মিরপুরের মাজার রোড, এক নম্বর, রাইনখোলা ও দুই নম্বরেও রয়েছে এগুলোর স্টেশন এবং কাউন্টার। রাস্তার দুই পাশে দুুই লেন পর্যন্ত থাকে বাস থামানো। আর অভ্যন্তরীণ রোডের গণপরিবহনগুলো চলাচলে ফাঁকা থাকে এক কিংবা দুই লেন সড়ক। একারণে যানজট প্রতিদিনই মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীদের এখন আর হাতে সময় গুণে বের হলে চলে না।
অন্যদিকে সায়েদাবাদ টার্মিনালের চিত্রও একইরকম। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক যেন পুরোটাই বাস টার্মিনাল। আর তার বিস্তৃতি এখন পৌঁছে গেছে ফকিরাপুল, মতিঝিল, পলাশী মোড়, মালিবাগ, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, মানিকনগর, বাসাবো, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা ও নর্দা পর্যন্ত। অন্যদিকে মিরপুর ১০, ১৪ নম্বর, কচুক্ষেত ও পান্থপথেও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ওপর থেকে চলাচলকারী বাসকে থামিয়ে রাখতে দেখা যায়। এসব স্থানেও প্রায় সব বাস কোম্পানির রয়েছে কাউন্টার। সায়েদাবাদ থেকে বের হওয়ার রাস্তায় এসব পরিবহনের যাত্রাবাড়ী, পোস্তাগোলা, জুরাইন, সাইনবোর্ডসহ আরো একাধিক স্থানে কাউন্টার রয়েছে। সেসব স্থানেও সড়কের উপরেই বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হয়। এসব অবৈধ বাসস্টেশনের বিরুদ্ধে কখনো পুলিশকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
তবে ভিন্ন চিত্র মহাখালী বাস টার্মিনালের। এ বাস টার্মিনালে বাইরে খুব একটা স্ট্যান্ড নেই। এখান থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো শুধুমাত্র এয়ারপোর্ট এবং উত্তরা থেকে যাত্রী উঠা-নামা করে। এসব স্থানে কিছু কাউন্টার রয়েছে। এ রুটের আবদুল্লাহপুরে দিন-রাত বেশিরভাগ সময় সড়কের উপর বাস থামানো দেখা যায়। এ কারণে আবদুল্লাহপুরে প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে।
এ তিনটি টার্মিনালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অরাজকতা ঘটছে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও অরাজকতা রোধে তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। সোমবার রাতে কল্যাণপুর বাস টার্মিনালের (অবৈধ) সামনের সড়কে প্রচুর যানজট দেখা যায়। এ যানজটে দাঁড়িয়েই বাসগুলো যাত্রী ওঠানামা করে। সামনে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তারা কিছুই বলছে না। কল্যাণপুর ব্রিজের নিচে দায়িত্ব পালনরত এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, অনেক পরিবহন কোম্পানি তাদের যাত্রীদের সুবিধার্থে এখানে কাউন্টার করেছেন। আমরা কি বলবো, আমাদের স্যারেরাই তো কিছু বলছেন না।
সাধারণ বাস মালিকরা বলেছেন, মূলত প্রভাবশালী মালিকদের কারণেই মূল টার্মিনালের ভেতর থেকে বাস চলাচল নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রভাবশালী মালিকরা পুলিশকে ম্যানেজ করে নিজেদের ইচ্ছামতো কাউন্টার বসিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেন। যানজটে পড়ে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। বিভিন্ন বাস কোম্পানির কাউন্টার মাস্টারদেরও কথা- টার্মিনালের বাইরে যেসব স্থানে কাউন্টার রয়েছে সেসব স্থান বাস টার্মিনাল স্থাপন করা হয়নি। শুধু বাস থামিয়েই যাত্রী উঠানো-নামানো হয়। এসব কাউন্টারের বৈধতা কিংবা কোনো অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন- এটা কোম্পানির ম্যানেজার জানে। তারা এটা জানেন না।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে মহাখালী এবং গাবতলী বাস টার্মিনালের উপর দিয়ে চলাচলকারী পরিবহনগুলো উত্তর সিটি করপোরেশনকে রাজস্ব দেয় এবং সায়েদাবাদের উপর থেকে চলাচলকারী বাসগুলো রাজস্ব দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু তারা যে মূল টার্মিনালের বাইরে আরো একাধিক টার্মিনাল, বাস কাউন্টার গড়ে তুলেছে সেটা সম্পর্কে দায়সারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী পরিবহন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক লে. কর্নেল সাবের সুলতান বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশন দুটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল থেকে (গাবতলী, মহাখালী) শুধু রাজস্ব আদায় করে। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে বাস কোম্পানিগুলো যে জায়গায় ভাড়া নিয়ে কাউন্টার গড়ে তুলেছে সেগুলো মালিক পক্ষর অনুমতি নেয়া আছে কিনা সেটা আমি জানি না। সিটি করপোরেশন এগুলো থেকে রাজস্ব পায় না। তবে টার্মিনালের উপর থেকে চলাচলকারী বাসগুলো থেকে টার্মিনাল ফি অনুসারে রাজস্ব আদায় করা হয়। আর পরিবহন বিভাগের নতুন জেনারেল ম্যানেজার লতিফ খান বলেন, তিনি এখনো কাগজপত্র দেখেননি, তবে এগুলো যদি অবৈধ হয়ে থাকে তাহলে সিটি করপোরেশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নিতাই চন্দ্র সেন জানান, আমাদের দূরপাল্লার একমাত্র বাস টার্মিনাল হচ্ছে সায়েদাবাদ। এর বাইরে আর কোনো বাস টার্মিনাল নেই। এখান থেকে শুধু রাজস্ব আদায় করা হয়। তবে বাইরে থেকে যেসব বাস ছেড়ে যায় সেগুলোও টার্মিনালের ফি পরিশোধ করে এর উপর দিয়ে চলাচল করে। শহরের অভ্যন্তরে বাসস্টেশন কিংবা কাউন্টার থাকলে অথবা রাস্তার উপরে বাসস্ট্যান্ড করে রাখলে তা অবৈধ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আহম্মেদ মজুমদার বলেন, ঢাকায় সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী এই তিনটি টার্মিনাল দূরপাল্লার বাসের জন্য সরকার অনুমোদিত। এর বাইরে বিভিন্ন সরকারি জায়গা দখল করে অনেক বাস মালিক কাউন্টার নির্মাণ করে টার্মিনাল বানিয়ে ফেলছে। মানিকনগর, কমলাপুর ও কল্যাণপুরে প্রায় দেখা যায় রাস্তার দুই পাশে দিনের পর দিন গাড়ি থামিয়ে রাখার পরেও সেগুলো দেখার কেউ নেই। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের একটা গাড়ি রাস্তার উপর রাখলে কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ রেকার নিয়ে চলে আসে। অথচ পরিবহন মালিক পক্ষ প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চলে। পুলিশ আমাদের অভ্যন্তরীণ রুটের গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও দূরপাল্লার এ অবৈধ বাসস্টেশন-কাউন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের গাড়িগুলো রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার কথা থাকলেও তারা দায়িত্বরত ট্রাফিকদের টাকা দিয়ে বিকাল থেকেই প্রবেশ করতে শুরু করে।
ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল করিম বলেন, মূল টার্মিনালের বাইরে যেসব স্থানে দূরপাল্লার পরিবহনের কাউন্টার রয়েছে সেটাকে টার্মিনাল বলা যায় না। এগুলো টার্মিনালের উপর দিয়েই যায়। তবে কিছু কিছু বাস শহরের ভেতরে প্রবেশ করে কাউন্টার থেকে যাত্রী তুলে। এগুলো রাতেই কেবল ভেতরে প্রবেশ করে।
দিনের বেলায় কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে ভেতরে প্রবেশ করে না। এগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, পূর্বে আরো বেশি কাউন্টার ছিল। সেগুলো পর্যায়ক্রমে কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এসব কাউন্টারের কারণে যানজট বৃদ্ধি পেলে সেগুলো কমিয়ে আনা হবে।
সায়েদাবাদের সড়কে যেন কোনো বাস না দাঁড়ায়, সে জন্য ২০১৬ সালে একবার নির্দেশনা জারি করেছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। তখন নগর ভবনে পরিবহন মালিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক যৌথসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল টার্মিনালের বাইরে কোনো বাস দাঁড়াবে না। শুধু টার্মিনালের ভেতর থেকে বাস ছেড়ে যাবে। টিকিট বিক্রি হবে টার্মিনালের ভেতর থেকে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের পর আড়াই বছর কেটে গেলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
রাস্তার উপরে কোনো বাস দাঁড় করে রাখা হলে সেটা দেখা এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের। টার্মিনালের ভেতরে কোনো বাস রাখার বিধান নেই বলে জানান সিটি করপোরেশনের এক টার্মিনাল ব্যবস্থাপক। মালিকরা তাদের বাসগুলো রাখবেন নিজস্ব ডিপোতে। ওই ডিপো থেকে টার্মিনালে এসে যাত্রী নিয়ে বাস গন্তব্যে চলে যাবে। কিন্তু এ নিয়ম কেউ মানছে না। সবাই তাদের বাসগুলো টার্মিনালের ভেতরই রাখছেন।
No comments