প্রসঙ্গ ইসলাম নারীর মর্যাদা ও অধিকার অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম
মানব সভ্যতা ভূপৃষ্ঠে বিকশিত হয়েছে প্রথম মানব হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম ও প্রথম মানবী হযরত হাওয়া আলায়হাস্ সালামের মিলিত পরিশ্রমে। আদম নর, হাওয়া নারী। নর ও নারী মিলেই মানব জাতি।
মেয়ে মানুষ ও পুরম্নষ মানুষ সমন্বয়ে মানবতার সুবিসত্মৃত পরিচয় উদ্ভাসিত যেমন হয়েছে তেমনি উজ্জীবিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে।প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মাদুর রসূলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম নর প্রধান পৃথিবীতে নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার কায়েম করে এক মহাবিপস্নব সাধন করেন। কুরআন মজীদের একখানা পূর্নাঙ্গ সূরা রয়েছে, যার নাম নিসা। নিসা শব্দের অর্থ নারী।
বিশ্ব মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে প্রিয় নবী সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম সর্বপ্রথম নারীদেরকে যথাযোগ্য সম্মানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে নারীদের স্বাধীনতা বলতে কোনো কিছুই ছিলো না। নারীমুক্তির চিনত্মাও করা যেতো না। তারা ছিলো আসবাবপত্রের মতো। তারা হয়ে গিয়েছিলো পণ্যসামগ্রী। নিদারম্নণ নির্যাতন তাদের সইতো হতো নিত্যদিন। নারীরা কেবলই পুরম্নষের সেবা করবে; পুরম্নষের অঙ্গুলি হেলনে উঠবে-বসবে এমনতরো ধারণা বিরাজ করছিলো সবখানে। সেবাদাসী প্রথা প্রকট আকার ধারণ করেছিলো সমাজ-জীবনে। দেবদাসী প্রথাও বিদ্যমান ছিলো। সৃষ্টি হয়েছিলো থিওডোরা ও আম্রপালীর মতো অসংখ্য গণমনোরঞ্জনকারিণী রমণীর। খোদ আরব মুলুকে অনেক পিতাই দারিদ্র্যের আশঙ্কায়, লজ্জা-শরমের অজুহাতে কন্যা সনত্মানকে জীবনত্ম কবর দিতে কুণ্ঠা বোধ করতো না।
প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম নারীদেরকে এক করম্নণ হাল থেকে, এক অমানবিক অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন এবং তাদেরকে কন্যা হিসেবে, ভগি্ন হিসেবে, মাতা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে সবের্াপরি মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য অধিকার প্রদান করলেন। তাদেরকে তিনি ন্যায্য ও সম্মানজনক মর্যাদা দান করলে ন। তারা লাভ করলো সদাশয়তা ও শ্রদ্ধা। তারা পিতা-মাতার নিকট থেকে কন্যা হিসেবে প্রাপ্ত হলো স্নেহ-মমতা এবং আদর। শুধু তাই নয়, নারী উত্তরাধিকারও অর্জন করলো। ভগি্ন হিসেবে ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিকট থেকে লাভ করলো সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং সমমর্যাদা। মাতা হিসেবে সবার নিকট থেকে পেলো যথাযথ কতর্ৃত্ব ও ভক্তি। মাতা হয়ে ওঠেন মহিমান্বিত। বধূ হিসেবে লাভ করে অভিনন্দন, মুবারকবাদ, শুভেচ্ছা এবং আনত্মরিক অভ্যর্থনা। পরিবারের সকল সদস্যের কাছ থেকে লাভ করে প্রেম-প্রীতি, কতর্ৃত্ব, উত্তরাধিকার। মানুষ হিসেবে প্রাপ্ত হয় সামাজিক মান-মর্যাদা এবং মানবিক মূল্যবোধ।
বিশ্ব মানব সভ্যতা গড়ে তোলার ৰেত্রে পুরম্নষের যেমন অবদান রয়েছে, নারীরও তেমন অবদান রয়েছে। আলস্নাহ জালস্নাশানুহু ইরশাদ করেন : হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরম্নষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)।
কন্যা সনত্মান জন্ম দিলে বেশি খুশি হওয়া উচিত। হাদিস শরীফে আছে : যে স্ত্রীলোকের গর্ভ থেকে প্রথম কন্যা সনত্মান জন্ম গ্রহণ করে সে পুণ্যময়ী।
কন্যা সনত্মান হোক কিংবা পুত্র সনত্মান হোক উভয়েই আলস্নাহর দেয়া এক অনন্য নিআমত। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আলস্নাহরই, তিনি যা ইচ্ছে করেন সেটাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছে করেন কন্যা সনত্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সনত্মান দান করেন। (সূরা শুরা : আয়াত ৪৯)। এখানে এই আয়াতে কারীমায় লৰণীয় যে, এতে প্রথমে কন্যা সনত্মানের উলেস্নখ করে কন্যার কদর যে কতো তা বিবৃত হয়েছে।
প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কন্যা বা ভগি্নকে লালন পালন করে, তাদেরকে সুশিৰা দান করে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করে, তারপর বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সৎপাত্রে ন্যসত্ম করার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে দেয় তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।
আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই অন্ধকার ও অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন যুগে, সেই পাপ- পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত সময়কালে পুরম্নষ সমাজের উপেৰা, অবহেলা, জুলুম, নির্যাতন নারী সমাজকে এমন অসহায় অবস্থায় নিয়ে এসেছিলো যে, তারা ভাবতেই পারতোনা মানুষ হিসেবে তারা কোনো স্বীকৃতি পাবে। তারা যেনো সৃষ্টি হয়েছে কেবল মাত্র পুরম্নষের চিত্তবিনোদনের জন্য এবং সনত্মান প্রজননের জন্য। এই অমানবিক অবস্থা থেকে নারীদের উদ্ধার করে ইসলাম। ইসলামে যে বিয়ে-শাদীর বিধান রয়েছে তাতে নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো পুরম্নষ কোনো নারীকে বিয়ে করতে পারে না। স্বামী গ্রহণের ৰেত্রে কনের পছন্দের ওপর জোর গুরম্নত্ব দেয়া হয়। পুরম্নষের স্ত্রীর ওপর যতোটুকু অধিকার, স্ত্রীরও পুরম্নষের ওপর ততোটুকু অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। কুরআন মজীদে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে ইরশাদ হয়েছে : হুন্না লিবাসুল্ লাকুম্ ওয়া আন্তুম লিবাসুল্ লা হুন্না_ তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)।
প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম বলেন : তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তাদেরও তোমাদের উপর তেমনি অধিকার আছে। (তিরমিযী শরীফ)। স্ত্রী ও স্বামী দৈহিকভাবে ভিন্ন দুটো সত্তা হলেও তারা দুয়ে মিলে এক আত্মা_ এই চেতনা ইসলামে রয়েছে। মায়ের পায়ের তলে জান্নাত_ এটাও ইসলামেই রয়েছে। ইসলামই সর্বপ্রথম নারীকে সম্পত্তির ৰেত্রে পুরম্নষের সহশরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং মৃতের সম্পত্তির হিস্যাদার হিসেবে তার অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলামের উত্তরাধিকার বিষয়ক বিধি-বিধানে যে বারোজন উত্তরাধিকারী স্থির করা রয়েছে তার মধ্যে আটজনই নারী। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরম্নষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ। (সূরা নিসা : আয়াত ৭)। ইসলাম পারিবারিক ও সামাজিক ৰেত্রে অবদান রাখবার অধিকার নারীদেরকেও দিয়েছে। উপার্জনৰেত্রেও নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইরশাদ হয়েছে : পুরম্নষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। (সূরা নিসা : আয়াত ৩২)।
ইসলামেই বলা হয়েছে : নর-নারী উভয়েরই অবশ্য কর্তব্য বিদ্যা অর্জন করা। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নর-নারী সমান অবদান রাখতে পারে। আমরা ইসলামের পাতায় পাতায় মুসলিম রমণীদের অসংখ্য অবদান দেখতে পাই। ইসলাম নারীদের যে মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে তা মানব সভ্যতার গতিপথকে সমুন্নত করেছে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
No comments