হত্যার বিচার ও প্রতিক্রিয়া by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
অনেক বাধা-বিঘ্ন, জটিলতা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর হতে শুরু করেছে। পাঁচজনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বাকিরা পলাতক। ধরা পড়লে কার্যকর হবে। হত্যা মামলার রায় কার্যকর হওয়ায় জনগণ স্বস্তি প্রকাশ করেছে।
বিভিন্ন দল ও মতের নেতৃবৃন্দও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক মতভেদ এেেত্র প্রভাব ফেলেনি। আওয়ামী লীগের বাইরেও ভিন্নমতাবলম্বীরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার েেত্র দৃষ্টান্তটি অবদান রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন। প্রখ্যাত আইনজীবি ড, কামাল হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী, কমু্যনিস্ট পার্টির মহাসচিব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাই আইনী প্রক্রিয়ায় বিচার সম্পন্ন করার মর্মকথাটি বলেছেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি একই মনোভাব প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ দেশবাসীর মধ্যে চিন্তার ঐক্যসূত্রের প্রকাশ ঘটেছে সবার প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।কিন্তু মুখ খোলেননি জামায়াত ও বিএনপি নেতারা। সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেছেন সবাই। নীরবতাই যেন তাদের প্রতিক্রিয়া। অথবা যা তাদের প্রতিক্রিয়া, তা প্রকাশ করার সাহস তাদের নেই। দু'একজন মন্তব্য করেছেন, 'রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে মৃতু্যদণ্ডাদেশ বাতিল করতে পারতেন'। এ বিষয়টি জাতীয় ঐকতানে বেসুরো ঠেকেছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই যদি ল্য হয়ে থাকে, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকরণ এ প্রক্রিয়ার শুরু মাত্র, শেষ নয়। কোন প্রক্রিয়া শুরু হলেই যে তা কাক্মিখত পথে এগিয়ে যাবে, এমন ধারণা পোষণ করার যুক্তি নেই। কারণ আইনের শাসন অচল করার জন্যই তো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। হত্যার বিচার আইনী প্রক্রিয়ায় আনতেও লেগেছিল অনেক বছর। আইনী প্রক্রিয়ায় বিচার শুরু হবার পর প্রক্রিয়া কি নিজ গতিতে অগ্রসর হতে পেরেছিল? এ থেকেই ধারণা করা যায় যে, আইনী প্রক্রিয়ায় স্বস্তি বোধ করে না এমন শক্তি (অপশক্তি ?) দেশে রয়েছে। এ অপশক্তি এতই শক্তিধর যে, তারা আইনী প্রক্রিয়ার 'চাক্কা জাম' করে রাখতে জানে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার েেত্র তারা তা দেখিয়েছে।
শক্তিশালী অপশক্তির বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়ার জয়কে যেমন উৎসাহব্যঞ্জক মনে করার যুক্তি রয়েছে, তেমনি এ প্রাথমিক জয়কে চূড়ান্ত জয় মনে করার কোন কারণ নেই। তুষ্টির কারণ তো মোটেই নেই। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মতো বড় জয়ের পর কেন পঁচাত্তরে অপশক্তির উত্থান ঘটল, আইনী প্রক্রিয়া কেন অচল হয়ে পড়ল, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। অপশক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে। আইনী প্রক্রিয়ার বাইরে অপশক্তির পদচারণাকে স্তব্দ করে দিতে হবে। তাহলেই আইন নিজ গতিতে চলা শুরু করবে।
প্রথমেই বিএনপি-জামায়াত দল দু'টির নীরবতা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। দু'দলের নেতা-নেত্রীদের মুখে কুলুপ অাঁটা। যারা প্রয়োজনে নি্#৬৩৭৪৩;্রয়োজনে কথার ফুলঝুরি ফোটাতে আনন্দ পান, যারা সত্য-মিথ্যার কথামালায় সকাল-সন্ধ্যা মাতিয়ে রাখেন, তাদের মুখ বন্ধ। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেই চাচ্ছেন না। টেলিফোনও ধরছেন না। দু'একজন মুখ ফসকে যা বলেছেন তাহলো, 'নীরবতাও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া', 'রাষ্ট্রপতি তো মা করতেও পারতেন'।
কথা না বলার বুঝতে হলে পেছন ফিরে তাকাতে হবে। এ খুনীরা কারা ? কাদের ছত্রছায়ায় তাদের অবস্থান ? কাদের মদদে তাদের তর্জন-গর্জন ? হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন মোশতাক। অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করেছিলেন জেনারেল জিয়া, যিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। যে হত্যার অপরাধ থেকে দায়মুক্তির আইনী ছত্রছায়া জেনারেল জিয়া দিয়েছিলেন, তারই প্রতিষ্ঠিত এবং তার স্ত্রীর পরিচালিত দল কিভাবে সে হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের বিচারে স্বস্তি প্রকাশ করবে ? বরং বিচার কেন হলো, এটাই তাদের অস্বস্তি। কথাটা অস্বস্তিকর। হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না, এও কি হয়! হ্যাঁ, হয়েছে তো। শুধু বিচার চায় না, তাই নয় বরং গায়ের জোরে বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিলেন জিয়া। খুনীদের পুরস্কৃত ও করেছিলেন রা করার সাথে সাথে। জিয়া প্রতিষ্ঠিত দল জিয়ার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছে। এখন কোন্ মুখে স্বস্তি প্রকাশ করবে? আবার কেমন করেই বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাবে? জিয়া অবশ্য হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেও নিজের হত্যা ঠেকাতে পারেননি।
জিয়ার পর এরশাদ এলেন এবং গেলেন। তারপর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বিএনপি এলো। যথেষ্ট সুযোগ ছিল সেনাছাউনিতে জন্ম নেয়ার কোষ্ঠীনামা থেকে বেরিয়ে আসার। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার তারা করলেন না। নব্বই-এর গণঅভু্যত্থানের পটভূমিতে মতায় এসেও বিএনপি আইনের শাসনে ফিরতে চাইল না। আঁতুর ঘরকেই অাঁকড়ে থাকতে চাইল। পরম বিস্ময়ের সাথে আমরা দেখলাম, নব্বই-এর পর প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়েও বিএনপি ইনডেমনিটি আইন বাতিল করল না। এমনকি বাতিলের ইচ্ছাও প্রকাশ করল না। বিচারের পথ রুদ্ধ রেখে আর যাই হোক, আইনের শাসন কায়েম করা যায় না। আইনের শাসন হলো গণতন্ত্রের বড় শর্ত। কাজেই ইনডেমনিটি আইন বহাল রেখে বিএনপি-র গণতন্ত্র চর্চার দাবি গ্রহণযোগ্য হয় না।
নব্বই-এর পর থেকে বিএনপি দু'বার মতায় এসেছিল। এই দীর্ঘ সময়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের তারা আপনজনের মতো আগলে রেখেছিলেন। বিদেশে চাকরিতে বহাল রেখেছিলেন। পদোন্নতি দিয়েছিলেন। কোন বিপদে পড়তে দেননি। তাদের মাথার ওপর ছায়ার মতো বিরাজ করছিল বিএনপি। কাজেই এ হত্যাকারীদের এখন শাস্তি হলে, বিএনপি কোন মুখে তা সমর্থন করবে ? শাস্তির বিপ েকথা বললে জনরোষ ফুসে উঠবে, যা রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। তাই চুপ থাকাটাই যৌক্তিক মনে হয়েছে তাদের।
দু'একজন বলেছেন "রাষ্ট্রপতি মা করতে পারতেন"। প্রশ্ন হলো কেন মা করবেন ? হত্যাকারীরা কি মার যোগ্য কোন কাজ করেছেন? এমনকি মার যোগ্য কোন কথাও উচ্চারণ করেছেন ? রাষ্ট্রপতিকে মা করার মতা প্রদান করা হয়েছে আইনে। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে এই মতা প্রয়োগ করতে হলে যে সব বিবেচনা করতে হবে এবং বিবেকের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে, তাও তো মা প্রদর্শনের অলিখিত শর্ত এবং নিজ বিবেকের কাছে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া। যারা কথাটা বলেছেন, তাঁদের কাছেই প্রশ্ন, রাষ্ট্রপতি কোন অধিকারে এই হন্তারক মা করবেন ? তারা অবশ্য বলেছেন যে, দীর্ঘদিন সাজাভোগ করার কারণে তাদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা সঙ্গত।
দেখা যাক, তাদের এই যুক্তি কতটা সঙ্গত। প্রথমেই বিবেচনা করা যাক, দীর্ঘ কারাভোগের জন্য দায়ী কারা ? কারাভোগের দীর্ঘ সময়ের অধিকাংশকালেই সরকারে ছিল বিএনপি। তারা তো বিচার প্রক্রিয়াকে নিজেরাই আটকে রেখেছিলেন। মাত্র দু'জন বিচারককে আপীল বিভাগে নিয়োগ করলে, এমনকি সাময়িক নিয়োগ দিলেও বিচারকার্য অনেক আগেই সম্পন্ন হতে পারত। বিএনপি সে কাজটি না করে বিচার বিলম্বিত করেছিল। অতএব হন্তারক দীর্ঘ কারাভোগের জন্য তো বিএনপি-ই দায়ী। তাদের মুখে 'দীর্ঘ কারাভোগের' জন্য শাস্তি লাঘবের দাবি মানায় কি ? এটা কি তাদের আত্মপ্রবঞ্চনা নয় ?
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের ভাষায় কথা বলা উচিত। মোনাফেকির স্থান এখানে নেই। আইনী প্রক্রিয়া শেষ হবার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রায় কার্যকর করা হয়েছে। দীর্ঘ কারাভোগ যদি আইনের দৃষ্টিতে দণ্ড লাঘবের কোন মানদণ্ড হতো, তাহলে মাননীয় উচ্চ আদালত তা বিবেচনা করতেন। কিন্তু আমরা জানি, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের শাস্তি নমনীয়করণে 'সময়' কোন অবদান রাখে না। এ কারণে নাৎসি অপরাধীদের অর্ধশতাব্দী কাল পরেও বিচার করে শাস্তি দেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের সভ্য দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ার প্রথম যুগে দীর্ঘকাল পর কবর থেকে লাশ (কঙ্কাল) তুলে এনে বিচার করে শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছিল। কঠোরতা ছাড়া আইনের শাসন কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নমনীয়তা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় শুধু ধোঁয়ার সৃষ্টিই করতে পারে, অবদান রাখে না। এজেন্যই আইনে শক্ত অপরাধের কঠোর শাস্তি, ছোট অপরাধের নমনীয় শাস্তি।
যারা রাসেলের মতো নি্#৬৩৭৪৩;াপ শিশুকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি, তাদের মা করা হলে, দাগী অপরাধীরা উৎসাহ পাবে। নতুন নতুন দাগী অপরাধী আবার হত্যায় মেতে উঠবে। এটাই কি 'মার' পরে নেতাদের কাম্য ?
দণ্ডাদেশ দ্বারা পাঁচ বা দশজন মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মারাই উদ্দেশ্য নয়। যেসব বিচারক দণ্ডাদেশ দেন, তাঁরাই জানেন যে, মৃতু্যদণ্ডাদেশ তাদের আনন্দ দেয় না। তাঁরা এই কঠিন দায়িত্বটি করেন, সমাজের শান্তির জন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, বিবেকের দায়মুক্তির জন্য।
অনেকে বলে থাকেন, পাশ্চাত্যের কোন কোন দেশে মৃতু্যদণ্ডাদেশ নাই। সেসব দেশে কি আইনের শাসন নেই? আছে। আইনের শাসন অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই মৃতু্যদন্ডাদেশ রদ করা হয়েছে। অর্থাৎ যে কারণে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয়া হয়, সেই কারণটি সমাজ থেকে অপসৃত হয়েছে বলেই মৃতু্যদণ্ডাদেশের প্রয়োজন অনুভূত হয় না। এ বিষয়টি সমাজ বিবর্তনের সাথে সহ্নঙ্ৃক্ত। আজও সৌদী আরবে দেখা যায়, খোলা ময়দানে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে এবং তাদের উল্লাস ধ্বনীর মধ্যে মৃতু্যদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামীর শিরোশ্ছেদ করা হয় অত্যন্ত কুশলী জল্লাদের তরবারি চালনার মাধ্যমে। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখন এমনটা হয় না সামাজিক মানসিকতার কারণে। তারা মৃতু্যদণ্ড কার্যকর করে স্বচ্ছভাবে এবং কারাগারে। যাতে সাধারণ মানুষ মানসিক 'শক' না পায়, সেজন্যেই তাদের দেখানোর ব্যবস্থা নাই। আরাও উন্নত সমাজে মৃতু্যদণ্ড পরিহার করা হয়েছে। সমাজ বিবর্তনের ধারাকে অস্বীকার করার উপায় নাই। এ থেকে সরে আসাও যায় না।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার
No comments