যে ১২ জলস্নাদে ফাঁসি কার্যকর করল ৫ খুনীর by শংকর কুমার দে
বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনীর ফাঁসি যে ১২ জলস্নাদ কার্যকর করেছে তাদের কাছ থেকে চমকপ্রদ কাহিনী জানা গেছে। কনডেম সেল থেকে খুনীদের হ্যান্ডকাফ ও মুখম-লে যমটুপি পরিয়ে আনে তারাই। ফাঁসি কার্যকরের সেই রাতে জলস্নাদদের করানো হয় নানা পদের ভূরিভোজ।
কোন্ জলস্নাদ কত বছর ধরে সাজা ভোগ করছে আর কতটি ফাঁসি কার্যকর করে কত বছরের সাজা মওকুফ পাচ্ছে তার বিশদ বিবরণও জানা গেছে।১২ জলস্নাদের মধ্যে ৯ জন ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই। অপর ৩ জলস্নাদকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আনা হয়। এক সপ্তাহ ধরে তাদের রাখা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কয়েদ ভবনে। বুধবার দিনের বেলায়ই জানিয়ে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। রাতের বেলায় ফাঁসি কার্যকর করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেও বলা হয় তাদের। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করতে উৎসাহীদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয় জলস্নাদদের।
যে ১২ জলস্নাদ ফাঁসি কার্যকরে অংশ নেয় তাদের একজন হাফিজউদ্দিন। তার পিতার নাম সাহেব আলী। বাড়ি গাজীপুরে। তারা সাজা হয়েছে ৪০ বছর। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করাসহ ২২ বার মোট ফাঁসি কার্যকর করেছে। তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আনা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আরেক জলস্নাদের নাম হচ্ছে কালু মিয়া। তাকেও কাশিমপুর কারাগার থেকে আনা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তার পিতার নাম সোহরাব মিয়া। সাজা হয়েছে ৩১ বছর। ১২ বার ফাঁসি কার্যকর করেছে সে। শাজাহান ভুইয়া। পিতা হোসেন আলী। নরসিংদীতে তার গ্রামের বাড়ি। ৪২ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ফাঁসি কার্যকর করেছে ২২ বার। মাসুম। পিতা সাফিউলস্নাহ। তার বাড়ি ঢাকায়। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ৭ বার ফাঁসি কার্যকর করেছে। এসএম কামরম্নজ্জামান ফারম্নক। পিতা নাদের শেখ। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে । ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ৫ বার ফাঁসি কার্যকর করেছে।
তানভির হোসেন রাজু। পিতার নাম জিএম হালিম। বাড়ি ঢাকায়। সে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ফাঁসি কার্যকর করেছে ৯ বার। আবুল। পিতা আবদুল হানিফ। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। ৫০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ফাঁসি কার্যকর করেছে ৫ বার। মোফাজ্জল হোসেন। পিতা-দবিরউদ্দিন। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ৫ বার ফাঁসি কার্যকর করেছে সে। মনির হোসেন। পিতা-মকতুল হোসেন। বাড়ি ঢাকায়। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ফাঁসি কার্যকর করেছে ৭ বার। জালাল বেপারী। পিতা-আবদুল মালেক বেপারী। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ফাঁসি কার্যকর করেছে ৫ বার। শেখ ছানোয়ার। পিতা-আবদুল আজিজ শেখ। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ৫ বার ফাঁসি কার্যকর করেছে সে। বাবুল। পিতা-আকরাম আলী। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ফাঁসি কার্যকর করেছে ৭ বার।
বুধবার রাতের বেলায় জলস্নাদদের খাওয়ানো হয় পোলাও, গরম্নর মাংস, খাশির মাংস, সব্জি, ডাল, কোল্ড ড্রিঙ্কস্। খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নেয় তারা। ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাদের ফাঁসির মঞ্চের কাছে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। ফাঁসি কার্যকরের জন্য পারদর্শী জলস্নাদদের থেকে তাদের বাছাই করে আনা হয়। ১২ জলস্নাদের মধ্যে মূল দায়িত্ব পালন করে ৪ জলস্নাদ। এই ৪ জলস্নাদ হচ্ছে শাজাহান, হাফিজ, কালু মিয়া ও রাজু।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এক জলস্নাদ একটি ফাঁসি কার্যকর করলে তার ৬০ দিনের সাজা কমে যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করার পর ১২ জলস্নাদের মধ্যে কে কতটি ফাঁসি কার্যকর করেছে সেই হিসাব অনুযায়ী তাদের সাজার মেয়াদ কমানো হবে।
খুনীদের গলায় ফাঁস পরানোর জন্য ফাঁসির মঞ্চের লিভার ধরে টান দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল এক জলস্নাদ। তার পেছনে ছিল আরেক জলস্নাদ, ফাঁসি দেয়ার আগে জলস্নাদরাই কনডেম সেলে গিয়ে খুনীদের হাতে পরিয়েছে হ্যান্ডকাফ। মাথায় পরিয়েছে যমটুপি। প্রতি খুনীকে হাতে হ্যান্ডকাফ ও মাথায় যমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চ পর্যনত্ম নিয়ে আসে দুই জলস্নাদ। কনডেম সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের দূরত্ব তিন থেকে চার মিনিটের পথ। ধীর পদে কনডেম সেল থেকে খুনীদের নিয়ে আসা হয় ফাঁসির মঞ্চে।
দিনের চেয়েও বেশি আলোকিত ছিল ফাঁসির মঞ্চ। হাই পাওয়ারের বাল্ব দিয়ে আলোকিত ফাঁসির মঞ্চের আশপাশের বালুকণা পর্যনত্ম দেখা যায়। কারা সেলে আটক বন্দীরাও ফাঁসির মঞ্চের আলো দেখতে পায়। ফাঁসির মঞ্চের সামনে থাকেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। জলস্নাদ একে একে নিয়ে আসে ৫ খুনীকে। ফাঁসির মঞ্চের সামনে দাঁড় করিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হয় ফাঁসির রজু (ম্যানিলা রোপ)।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম এক হাতে রিস্টওয়াচ ও অপর হাতে লাল রম্নমাল নিয়ে দাঁড়ান। রিস্টওয়াচ দেখে লাল রম্নমাল হাত থেকে ফেলে দেয়া মাত্রই এক জলস্নাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেয়। ফাঁসির মঞ্চের পাটাতন সরে গিয়ে খুনীর গলায় ফাঁস লেগে ১০ ফুট গভীরের কূপে গিয়ে আটকে থাকে। আঘাতে ঘাড়ের স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে যায়, আধাঘণ্টা গভীর কূপে আটকে থাকার পর খুনীদের বের করা হয়।
দুই জলস্নাদ ফাঁসি কার্যকর করার পর আসে অপর দুই জলস্নাদ। আধাঘণ্টা পর ফাঁসির মঞ্চের নিচে গভীর কূপ থেকে লাশ টেনে তোলে তারা। দুই হাতের, দুই পায়ের ও ঘাড়ের রগ কেটে দেয়। ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মুসফিকুর রহমান যিনি ফাঁসি দেয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীৰা করেছিলেন তিনিই আবার পরীৰা করে মৃতু্য নিশ্চিত করেন। বুধবার রাতে একে একে বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে ১২ জলস্নাদ ফাঁসি দিয়েছে। ফাঁসি দেয়ার পর ৫ খুনীর লাশ সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখে জলস্নাদরা। জলস্নাদদের চোখেমুখে ছিল আনন্দের হাসি। সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে রাখে তারা ৫ খুনীর লাশ। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর সুযোগ পেয়ে এই জলস্নাদরা ইতিহাসে জায়গা করে নেয়ার আনন্দে গর্ব করে।
No comments