'রক্তঋণ শোধে গৌরবান্বিত by শংকর কুমার দে
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর ফাঁসির পর মামলা তদনত্ম করার সেই অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েন তদনত্মকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। খুনীদের যে ফাঁসি দেয়া হলো এটা তাঁর তদনত্মের ফসল।
এই তদনত্মের ফসল ঘরে তুলে আনতে গিয়ে জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। চাকরি হারিয়েছিলেন, প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন। খুনীদের ফাঁসি হওয়ার পর তাঁর জীবন সার্থক। নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছেন। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার ইতিহাসে নিজেও শামিল হতে পারায় গৌরবান্বিত। তিনিও একটি অধ্যায়। অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন শাসত্মি তাকে পেতেই হবে_খুনীদের ফাঁসি হওয়ার পর তা প্রমাণিত হয়েছে। এভাবেই তদনত্মকারী অফিসার আবদুল কাহার আকন্দ সংৰিপ্তভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা তদনত্মের দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করেন।যে ৫ খুনীর ফাঁসি হয়েছে তার মধ্যে মেজর (অব) বজলুল হুদাকে ব্যাঙ্কক থেকে ফিরিয়ে দেশে আনেন তদনত্মকারী অফিসার আবদুল কাহার আকন্দ। এ জন্য ব্যাঙ্ককে যেতে হয়েছে তাকে দু'বার। তাঁকে ব্যাঙ্ককের আদালতে সাৰ্য দিতে হয়েছে। প্রমাণ করতে হয়েছে হুদা মৃতু্যদ-প্রাপ্ত মামলার আসামি। বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি খুব সহজ ছিল না। ব্যাঙ্ককের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে কারাগারে আটক ছিল বজলুল হুদা। তিনি জানালেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনে যারা গুলি ছুড়ে হত্যা করেছে তাদের মধ্যে বজলুল হুদা অন্যতম। বজলুল হুদার গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ তনয় শেখ কামাল। বজলুল হুদার সঙ্গে ছিল ল্যান্সার মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন নূর, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে আনা থেকে শুরম্ন করে খুনীদের জিজ্ঞাসাবাদ, জবানবন্দী, তদনত্মের ইতিবৃত্ত এখন কেবলই ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা তদনত্ম করতে গিয়ে তাঁকে খুনীদের পৰ থেকে বার বার প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকার তাঁকে বাধ্যতামূলক চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবনে এসব ঘটনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদনত্ম সম্পন্ন করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা তদনত্ম করতে গিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছি খুনীরা ছিল কত বর্বর, কতটা মানবতাবিরোধী। নিষ্পাপ শিশু রাসেল, নিরপরাধ বেগম মুজিব, শেখ কামাল ও শেখ জামালের নববধূর নৃশংস হত্যাকা-ের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তদনত্মে।
আবদুল কাহার আকন্দ বলেছেন, তদনত্ম শুরম্ন করার ১৩ বছর পর খুনীদের ফাঁসি হয়েছে। তখন সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া, মামলার সাৰ্য-প্রমাণ, আলামত সংগ্রহসহ নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তদনত্ম সম্পন্ন করাটা মোটেও সহজ ছিল না। সেদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসি হওয়ার কথা কল্পনা করার বিষয়টি ছিল স্বপ্নের মতো।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তদনত্মকারী কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তদনত্মকারী কর্মকর্তা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সচিত্র প্রতিবেদন অলিখিতভাবে রেডিও টেলিভিশনে প্রদর্শন ছিল নিষিদ্ধ। আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ইনডেমনিটির মতো কালো আইন করে বিচারের পথ রম্নদ্ধ করা হয়েছিল। এই ধরনের একটি ঐতিহাসিক হত্যা মামলার তদনত্ম করাটা একদিকে যেমন ছিল সৌভাগ্যের, আরেক দিকে ছিল দুঃসাহসিক। আব্দুল কাহার আকন্দ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মতো ঐতিহাসিক মামলার তদনত্ম করার পর সর্বোচ্চ আদালতে বিচারের সর্বোচ্চ শাসত্মি মৃতুদ-ের রায়ে ৫ খুনীর ফাঁসি হওয়ার ঘটনাটি আমার আমৃতু্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখন বিদেশে পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি দেয়ার কাজটি দ্রম্নত সম্পন্ন করতে পারলেই জাতির জনকের রক্তের ঋণ শোধ হবে।
No comments