দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে মন্ত্রিত্ব থাকবে নাঃ প্রধানমন্ত্রী
মন্ত্রিসভার কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় উদ্বোধনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এ আশ্বাস দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বলেছেন, দুর্নীতি হলে এসব কাজ করা সম্ভব হতো না।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত এ যৌথ সভায় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে ড. এস এ মালেক, এম এ মান্নান, এইচ টি ইমাম, আমির হোসেন আমু, আবুল মাল আবদুল মুহিত, ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, কাজী আকরাম হোসেন, সৈয়দ রেজাউর রহমান, অনুপম সেন ও ড. হামিদা ভানু অংশ নেন।'দুর্নীতিবাজ' মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করে সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'শহীদ মিনারে অনেকে তোলপাড় করছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। এমনকি দুর্নীতির প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের অনুরোধ করব, দুর্নীতি দুর্নীতি না করে কোথায়, কখন, কিভাবে, কোন খাতে কত দুর্নীতি হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দেখান। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিলে হবে না। কারো সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে তার প্রমাণ দিতে হবে। দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারলে মন্ত্রিত্ব থাকবে না।'
কেউ পেছন ফিরে দেখে না_এমন অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যাঁরা এখন সরকারের দুর্নীতি নিয়ে এত কথা বলছেন, তাঁদের তো অতীতের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে দেখছি না।' তিনি আরো বলেন, 'দুর্নীতি কিভাবে করা হয়, সেগুলো তো আমরা দেখেছি।' প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মানুষ ভালো থাকলে আরো ভালো থাকতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বেশি ভালো চাইতে চাইতে আগের অবস্থায় যেন ফিরে যেতে না হয়।'
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, 'পত্রিকাগুলো এমন কিছু ঘটনা নিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে যাতে আমাদের ক্ষতি হয়। সমালোচনা ভালো, এতে আমরা শোধরাতে পারি; কিন্তু মিথ্যা লিখলে তো ক্ষতি হয়।' তিনি আরো বলেন, 'সাংবাদিকরা রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করলে কিছু যায় আসে না। অথচ তাঁদের কেউ কিছু বললে, সমালোচনা করলে সহ্য হয় না। সমালোচনা করলে তো সমালোচনা শোনার মানসিকতা থাকতে হবে। বললে তো শুনতে হয়। সহ্য করতে না পারলে হবে না।'
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বলেন, 'দুর্নীতি হলে তো এসব কাজ করা সম্ভব হতো না। আমরা জনগণের জন্য কাজ করতে ক্ষমতায় এসেছি। টাকা মেরে দিতে আসিনি। আমরা এ পর্যন্ত ২৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে ২২ শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এই দুই বছর ৯ মাসে আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছি, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাঁচ বছরেও তা পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দুই বছরে পারেনি। আমাদের স্বচ্ছতা আছে বলেই এটা পেরেছি। দুর্নীতি করলে তো পারতাম না।' বিগত জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি, তার জবাব দিতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর সফল হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এই সফরে আমরা লাভবান হয়েছি। সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল সমস্যার সমাধানসহ বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান আমরা করতে পেরেছি। জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি করেছিলেন। সেই সময় থেকে শুনে এসেছি, এটা নাকি গোলামি চুক্তি। এখন সেই চুক্তি কাজে লাগল।' তিনি আরো বলেন, 'সীমানা চিহ্নিত করা, ছিটমহল সমস্যার সমাধান কঠিন ও দুরূহ কাজ। স্বাধীন দেশের সীমানা থাকবে না_এটা হতে পারে না। ভারতের সঙ্গে খুঁটিনাটি যা-ই হয়েছে, তা আমরাই করেছি। অতীতের কোনো সরকারই এটা করতে পারেনি।'
বাণিজ্য চুক্তির ফলে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের ৩০৮টি আইটেমের বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, 'তারা বাংলাদেশের কোনো পণ্যই ভারতের বাজারে প্রবেশের ব্যবস্থা করেনি। উল্টো ভারতের পণ্য অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশের সব ব্যবস্থা করেছে। দেশ বেচার অপবাদ আমাদের ওপর দেওয়া হয়। কিন্তু দেশ বেচার কাজ করে তারা।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'তিস্তা পানি চুক্তি হয়নি, এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমি দুই মাস বা তিন মাস বলে সময় বেঁধে দিতে চাই না, তবে বলতে চাই, এ চুক্তি হবেই। পানি এমন একটা জিনিস, কেউ আটকে রাখতে পারবে না। ওপর থেকে নিচে এটা নামবেই। এটা দুই দেশের ব্যাপার। আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করব।'
ভারতের সঙ্গে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বিগত সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমরা তো উদ্যোগ নিয়ে একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এর আগে যারা ছিল, তারা তো এটাও পারেনি। তারা কেন পারেনি, তার জবাব দিতে হবে।' তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় সরকারের জন্য এক রকম ভালো হয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তারা (বিএনপি) চুক্তি হলেই বলত, দেশ বেচে দিয়েছি।'
দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিরোধী দল জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করছে_এ অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এখন তাদের একটাই লক্ষ্য, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তদন্তের মাধ্যমে তাদের দুর্নীতির বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে। এর জন্য বিচার করতেই হবে। ব্যক্তিবিশেষকে খাতির করার কিছু নেই।'
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে সরকারের দৃঢ়তা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেন না হয়, সে জন্য বিরোধী দল সোচ্চার। তবে এ বিচার হবেই। চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে যখন যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পাওয়া যাবে, তখনই তার বিচার হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে দেশে শান্তি আসবে না। গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ পাবে না।' বর্তমান সরকারের দুই বছর ৯ মাস এবং বিগত জোট সরকারের এই সময়ের তুলনা করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'তখন দেশ জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। প্রতিনিয়ত দেশে বোমাবাজি হতো। আমাদের সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য দেশে কোথাও কোনো জঙ্গিবাদ ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটেনি। দেশকে জঙ্গিবাদের বদনাম থেকে ঘোচাতে পেরেছি, এটাকে আমরা বড় সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করতে চাই।'
রাস্তাঘাটের বেহাল দশার জন্য আবারও বিগত সরকারকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, '২০০১ সালে যখন নির্বাচনী প্রচারণায় নামি, তখন প্রতিটি রাস্তা ছিল সুন্দর ও ঝকঝকে। সব রাস্তা দিয়ে পানির মতো যাতায়াত করা গেছে। কিন্তু ২০০৮ সালে যখন নির্বাচনী প্রচারণায় নামি, তখন সব রাস্তা চরম খারাপ। আগের সরকার কাজ করেনি বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ক্ষমতায় এসে পদক্ষেপ শুরু করেছি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার বাজেট করেছি। বর্ষার কারণে এখন কাজ করা যাচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে ভালোভাবে কাজ শুরু হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা নজর দিচ্ছি। আমরা যখনই যেখানে সমস্যা দেখছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি। তার পরও এটা নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি। বাস্তব অবস্থাটা কেউ উপলব্ধি করে না।'
দলের নেতা-কর্মীদের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'জানি, বর্তমানে অনেক সমস্যা রয়েছে। তবে এর একটিও আমাদের সৃষ্টি করা নয়, আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো পেয়েছি। তার পরও আমরা সব সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বসে নেই।'
No comments