নারী লাঞ্ছনার সর্বগ্রাস by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

মাস ছয়েক আগে পত্রিকান্তরে ইভ টিজিং নিয়ে প্রথম লিখেছিলাম। তখন এই সামাজিক ব্যাধিটি এমন মহামারির রূপ লাভ না করলেও অদূর ভবিষ্যতে যে এটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে তার সব নমুনা কিন্তু তখন সুস্পষ্ট ছিল। আমরা সতর্ক করেছিলাম সময় থাকতে ব্যবস্থা নিতে। ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি হয়নি, আজ তা বিবেচ্য নয়।
এখন যা পুরো জাতির জন্য উদ্বেগের বিষয়, তা হলো সমস্যাটির তীব্রতা দিনে দিনে প্রশমিত হওয়ার বদলে বেড়েই চলেছে। ইভ টিজিংয়ের অপরাধে শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণীত হওয়ার পরেও এবং প্রণীত আইনে ইতিমধ্যে কয়েকজন অপরাধীর দণ্ডপ্রাপ্তি সত্ত্বেও। আইনে যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। হয়তো এ কারণে আগামী সংসদ অধিবেশনে এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে।
প্রবাসে অবস্থানকালীন হাতের কাছে সময়মতো প্রয়োজনীয় বইটি পাওয়া যায় না লাগসই উদাহরণ কিংবা উদ্ধৃতি সংগ্রহের জন্য। নেহায়েত স্মৃতির ওপর নির্ভর করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙ্তিটি উদ্ধৃত করি : 'পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী, বিশ্বময় দিয়েছে তারে ছড়ায়ে।'
কবি যে অনুষঙ্গে এমন আক্ষেপ করেছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান সামাজিক অবস্থার মিল না থাকলেও কেমন যেন মিলও দেখি। কী কারণে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধ, তার হেতু নির্ধারণ করতে গিয়ে সমাজপতিরা গলদঘর্ম হচ্ছেন। পারিবারিক জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজে অস্থিরতা, তরুণদের জন্য বিনোদন সুযোগের অবস্থার অভাব_এসব নানা কারণের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ হয়েছে সংগত কারণেই। তবে এসব কারণই যে একমাত্র কারণ নয়, কেন জানি মনে হয়। আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে একটি কারণ যে আছে তা নিশ্চিন্তে বলা যায়। সেই কারণটির কথা আমরা কেউ বলতে চাই না। কেমন যেন রাখ রাখ ঢাক ঢাক ভাব আমাদের মধ্যে। সে কারণটির কথা বলছি কিছু পরে। ইভ টিজিং শব্দটি প্রথম শোনা যায় ভারতের মুম্বাই নগরীতে। পাবলিক বাসে অফিসগামী এক নারী পুরুষ বাসযাত্রী দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা প্রতিবেদন আকারে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম ইভ টিজিং শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যে সাংবাদিক এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন, তিনি অবশ্যই কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন। কিন্তু প্রায় সমকালেই গোটা মহারাষ্ট্রের নারী নেতৃত্ব শব্দটির ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানান। তাদের আপত্তি ছিল 'ইভ' শব্দের ব্যবহারে ইভ আদি নারী যেমনি, তেমনি তিনি প্ররোচনাদাত্রীও। ইভের প্ররোচনায় এডাম নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন। সেই অনুষঙ্গে ইভের তো কিছু দায় আছেই। তাই টিজিং হলে ইভের গোত্রভুক্ত নারীর কিছুটা দায় থাকে বৈকি! ইভ টিজিং শব্দের প্রয়োগে এটাই প্রধান আপত্তি নারীবাদীদের এবং তাদের দাবি, এই শব্দের প্রয়োগ দ্বারা অপরাধের মাত্রা হালকা করে দেখানোর প্রয়াসও যে রয়েছে তাও বলা হয়।
আমরা বলি যখন সমস্যাটি সমাজের শান্তি বিঘি্নত করে তুলেছে, আত্মহননের পথে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে, খুনোখুনির মুখোমুখি করছে মানুষকে, তখন নামকরণের মাহাত্ম্য নিয়ে তর্ক 'পাত্রাধার তৈল, কী তেলাধার পাত্র'_জাতীয় সুলভ চটুল বিতর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। নারী নির্যাতন, ইভ টিজিং যা-ই বলি না কেন, অপরাধের মাত্রা কিন্তু কোনোভাবেই কমছে না।
আমরা বলি, ইভ টিজিংকে 'নারী লাঞ্ছনা' বললে নির্যাতনের মতো দৃশ্যমান কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয় না। ইভ টিজিং কিংবা নারী লাঞ্ছনার দায়ে যখন কোনো প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক গ্রেপ্তার হন, তখন শঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। এবং ভিকটিম যখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী হয়, তখন আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয় অভিশাপের পর্যায়ে চলে গেছে।
২৫ নভেম্বর প্রবাসে বসে যখন টেলিভিশনের খবরে জানা গেল, ফেনীর এক প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অপকীর্তির কথা, তখন নিজের অজ্ঞাতে মনে পড়ল, শেকসপিয়রের হ্যামলেট নাটকের বহুল উদ্ধৃত খেদোক্তি : সামথিং ইজ রটন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।
এবার মনে হয় এই অপরাধের চক্র (সাইকেল) পূরণ হলো। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অপকর্মের অভিযোগ শুনেছি। কলেজ শিক্ষকও দাঁড়িয়েছে অপরাধের কাঠগড়ায়। স্কুল-মাদ্রাসা-মক্তবের শিক্ষকরাও প্রতিনিধিত্ব করেছে এই অপরাধ সভায়! সাংস্কৃতিক কর্মী, আবৃত্তি শিল্পী-ববির প্রতিনিধিও দেখেছি এই অপরাধ চক্রে। হায় দুর্ভাগা দেশ, কোথায় চলেছ তুমি?
যে দেশ তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করল, সেই দেশে এত দ্রুত_মাত্র চার দশকের মধ্যে এমন অবক্ষয় কেউ কি কল্পনা করেছে?
অপরাধ কম-বেশি সব সমাজেই হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণও করা হয়। কিন্তু এখন তো মনে হয় কোনো রকম শাস্তিই নারী লাঞ্ছনার অপ্রতিরোধ্যতাকে রোধ করতে পারছে না।
যে কথাটির ইঙ্গিত শুরুতে দিয়েছিলাম। এবার তা খোলাসা করে বলি।
নারী লাঞ্ছনাকারীকে পত্রপত্রিকায় শুধুই বখাটে হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বখাটে বলে একটি শ্রেণীকে বোঝানো হয়। কিন্তু অপরাধীর আসল পরিচয় এখানে থাকে উহ্য।
আমাদের বিশ্বাস, সমাজের যেই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাস জন্মেছে যে অপরাধ করলেও আইন তার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না, তারাই এই অপরাধ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন অপ্রতিরোধ্যভাবে।
এরিস্টটল বলেছেন, মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। যত নিরপেক্ষতার কথা বলি না কেন, কোনো না কোনোভাবে আমরা কিছুটা হলেও রাজনৈতিক মতবাদকে বিশ্বাস করি। আমি না করলে আমার পিতা করেন, আমার সন্তান করেন কিংবা আমার ভাই, আত্মীয়স্বজন করেন।
অপরাধীর এই রাজনৈতিক চরিত্র, তা যত ক্ষীণ হোক, প্রকাশ করা হোক, তাহলে যে দলের সঙ্গে তার সংযুক্তির কথা জানা যাবে, সেই দলের নৈতিক দায়িত্ব হবে তার দায় নেওয়ার।
আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে বলেছেন, নারী লাঞ্ছনাকারীর বাবা-মাকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে, তা যদি সমর্থনযোগ্য হয়, তাহলে নারী লাঞ্ছনাকারী দুর্জনের বন্ধু-বান্ধবরা কেন শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হবে না?
চন্দন কাঠের সংস্পর্শে পাশের অন্যান্য গাছ যেমন সুগন্ধযুক্ত হয়, ভালো বন্ধু-বান্ধবের স্পর্শে বখাটেও ভালো হতে পারে।
তবে এর উল্টোটা ঘটার আশঙ্কাই থাকে বেশি।
===================================
একজন এস এ জালাল ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভাণ্ডার  গল্প- স্বপ্নের মধ্যে কারাগারে  গল্পিতিহাস- কাঁথা সিলাই হইসে, নিশ্চিন্ত  ‘এখন প্রাধান্য পাচ্ছে রম্যলেখা'  অকথিত যোদ্ধা  কানকুনের জলবায়ু সম্মেলন, বাংলাদেশের মমতাজ বেগম এবং আমার কিছু কথা  নাপাম বোমা যা পারেনি, চ্যালেঞ্জার ও আব্রাম্‌স্‌ ট্যাংক কি তা পারবে?  ঠাকুর ঘরে কে রে...!  ষড়যন্ত্র নয়, ক্ষুধা ও বঞ্চনাই আন্দোলনের ইন্ধন  বাহাত্তরের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা কোথায়?  ড.ইউনূসের দুঃখবোধ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা  গীতাঞ্জলি ও চার্লস এন্ড্রুজ  গল্প- তেঁতুল  একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা  গল্প- বট মানে গরুর ভুঁড়ি  গল্প- কিশলয়ের জন্মমৃত্যু  গল্প- মাকড়সা  দুর্নীতি প্রতিরোধে আশার আলো  জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে  ঢাকা নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন  মারিও বার্গাস য়োসার নোবেল ভাষণ- পঠন ও কাহিনীর নান্দীপাঠ  লন্ডন পুলিশ জলকামানও নিল না  রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের দায়বদ্ধতা  পোশাক শিল্পে অস্থিরতার উৎস-সন্ধান সূত্র  বাতাসের শব্দ  গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফখরুজ্জামান চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.