প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৮২ সালে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্যোগের মুখোমুখি। মনে হয়, সমাজ যেন আজ ঋণের টাকায় এবং ধার করা সময়ের ওপর বেঁচে আছে। আর এই দুটোই হয়তো যেকোনো মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে।’
বাংলাদেশে এমন এক সময় ছিল, যখন ঋণ পাওয়াই ছিল প্রধান লক্ষ্য। পরিচয় ছিল পরনির্ভর একটি দেশ হিসেবে। স্বাধীনতার পর থেকে এরশাদের শাসনামলের প্রায় পুরোটা সময়েই উন্নয়ন বাজেটের বড় অংশই ছিল বৈদেশিক ঋণ। এমনকি রাজস্ব বাজেটেও ঢুকে পড়েছিল বৈদেশিক ঋণ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান ওই একই লেখায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, আমদানি নীতিমালা, খাদ্যনীতি ইত্যাদি সবকিছুই ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন, টোকিও এবং রিয়াদের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং আমাদের সরকারকে বসে থাকতে হয় ঐ রাজধানীগুলোর দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর।’
১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের নেওয়া বৈদেশিক ঋণ ছিল মোট জাতীয় উত্পাদনের (জিডিপি) প্রায় ছয় শতাংশ। এর বিপরীতে সে সময় রপ্তানি আয় ছিল জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশের সামান্য বেশি, আর প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স ছিল আরও কম, প্রায় দুই শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ সে সময় ছিল অনেকটাই পরনির্ভর, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার ক্ষেত্রে। তখন প্রতিবছর প্যারিসে সাহায্যদাতাদের বৈঠক হতো। কোন সরকার কতখানি সফল, তা মাপা হতো সেখানে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার পরিমাণের ওপর।
মূলত স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সংকট বাংলাদেশকে দীর্ঘসময় ধরে সাহায্যনির্ভর করে রেখেছে। ১৯৭২ ও ’৭৩ সালের খরার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বড় ধরনের বন্যা হয়। এ কারণে খাদ্যপণ্যে যেমন বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছিল, তেমনি ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। তেলের মূল্যে বড় ধরনের সংকট হয় আবার ১৯৭৯ সালে। এ সময় আবার পাটের বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক পণ্যের প্রসার বাড়লে বাণিজ্য খাতে আরেক দফা বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। সেসব সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ছিল অনেক বেশি রক্ষণশীল। ফলে ’৭০-এর দশকে বাংলাদেশ ছিল পুরোপুরিই সাহায্যনির্ভর একটি দেশ।
’৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। এ সময় বাণিজ্য খাতে নানা ধরনের সংস্কার করা হয়। আবার আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প থেকে রপ্তানিনির্ভর শিল্পের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে বাংলাদেশ। তবে এই প্রক্রিয়া গতি পায় ’৯০-এর দশকে এসে। এ সময় সরকার পরিবর্তন হলেও রপ্তানিনির্ভর অর্থনৈতিক কৌশল থেকে কেউই সরে যায়নি। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সংস্কারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য নানা ধরনের বাজারসুবিধা দেয়। এর ফলে বাণিজ্যনির্ভরতা বাড়তে থাকে। বলা যায়, ’৯০-এর দশকে সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশের দিকে যে যাত্রা শুরু করেছিল, পরবর্তী দশকে এসে তা পুরোপুরি সংহত হয়েছে।
সেই বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে দেখা দেয় অনেক পার্থক্য। এখন দেশটির বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স প্রায় নয় শতাংশ। অর্থাৎ ঋণ গৌণ হয়ে পড়েছে, উঠে এসেছে বাণিজ্য।
সবমিলিয়ে বলা যায়, ঋণনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে। ঋণ পাওয়া এখন বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য নয়, বরং বাজারসুবিধা পাওয়াই প্রধান লক্ষ্য। এই বাজারসুবিধা পেতে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন আর সাহায্য পাওয়ার ওপর নির্ভর নেই, এখন বিবেচ্য বিষয় অন্য কিছু। চ্যালেঞ্জ এখন বাণিজ্যসুবিধা পাওয়া।
আর এ কারণেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান ২০০২ সালে ‘বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামে আরেকটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমানে আমরা সাহায্যনির্ভর অর্থনীতি নয়, বরং এক ধরনের বাণিজ্যনির্ভরতার মধ্যে অবস্থান করছি। এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি ও বিপুল গরিব জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা নিয়েই আমাদের অর্থনৈতিক ভাগ্য ক্রমবর্ধমান হারে নির্ভরশীল হয়ে উঠছে কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের রপ্তানি খাতে অভিঘাত সৃষ্টি করছে তার ওপর। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ দেশে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক খাতে সাহায্য কর্মসূচি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।’
বাংলাদেশে এমন এক সময় ছিল, যখন ঋণ পাওয়াই ছিল প্রধান লক্ষ্য। পরিচয় ছিল পরনির্ভর একটি দেশ হিসেবে। স্বাধীনতার পর থেকে এরশাদের শাসনামলের প্রায় পুরোটা সময়েই উন্নয়ন বাজেটের বড় অংশই ছিল বৈদেশিক ঋণ। এমনকি রাজস্ব বাজেটেও ঢুকে পড়েছিল বৈদেশিক ঋণ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান ওই একই লেখায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, আমদানি নীতিমালা, খাদ্যনীতি ইত্যাদি সবকিছুই ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন, টোকিও এবং রিয়াদের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং আমাদের সরকারকে বসে থাকতে হয় ঐ রাজধানীগুলোর দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর।’
১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের নেওয়া বৈদেশিক ঋণ ছিল মোট জাতীয় উত্পাদনের (জিডিপি) প্রায় ছয় শতাংশ। এর বিপরীতে সে সময় রপ্তানি আয় ছিল জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশের সামান্য বেশি, আর প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স ছিল আরও কম, প্রায় দুই শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ সে সময় ছিল অনেকটাই পরনির্ভর, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার ক্ষেত্রে। তখন প্রতিবছর প্যারিসে সাহায্যদাতাদের বৈঠক হতো। কোন সরকার কতখানি সফল, তা মাপা হতো সেখানে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার পরিমাণের ওপর।
মূলত স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সংকট বাংলাদেশকে দীর্ঘসময় ধরে সাহায্যনির্ভর করে রেখেছে। ১৯৭২ ও ’৭৩ সালের খরার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বড় ধরনের বন্যা হয়। এ কারণে খাদ্যপণ্যে যেমন বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছিল, তেমনি ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। তেলের মূল্যে বড় ধরনের সংকট হয় আবার ১৯৭৯ সালে। এ সময় আবার পাটের বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক পণ্যের প্রসার বাড়লে বাণিজ্য খাতে আরেক দফা বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। সেসব সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ছিল অনেক বেশি রক্ষণশীল। ফলে ’৭০-এর দশকে বাংলাদেশ ছিল পুরোপুরিই সাহায্যনির্ভর একটি দেশ।
’৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। এ সময় বাণিজ্য খাতে নানা ধরনের সংস্কার করা হয়। আবার আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প থেকে রপ্তানিনির্ভর শিল্পের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে বাংলাদেশ। তবে এই প্রক্রিয়া গতি পায় ’৯০-এর দশকে এসে। এ সময় সরকার পরিবর্তন হলেও রপ্তানিনির্ভর অর্থনৈতিক কৌশল থেকে কেউই সরে যায়নি। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সংস্কারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য নানা ধরনের বাজারসুবিধা দেয়। এর ফলে বাণিজ্যনির্ভরতা বাড়তে থাকে। বলা যায়, ’৯০-এর দশকে সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশের দিকে যে যাত্রা শুরু করেছিল, পরবর্তী দশকে এসে তা পুরোপুরি সংহত হয়েছে।
সেই বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে দেখা দেয় অনেক পার্থক্য। এখন দেশটির বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স প্রায় নয় শতাংশ। অর্থাৎ ঋণ গৌণ হয়ে পড়েছে, উঠে এসেছে বাণিজ্য।
সবমিলিয়ে বলা যায়, ঋণনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে। ঋণ পাওয়া এখন বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য নয়, বরং বাজারসুবিধা পাওয়াই প্রধান লক্ষ্য। এই বাজারসুবিধা পেতে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন আর সাহায্য পাওয়ার ওপর নির্ভর নেই, এখন বিবেচ্য বিষয় অন্য কিছু। চ্যালেঞ্জ এখন বাণিজ্যসুবিধা পাওয়া।
আর এ কারণেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান ২০০২ সালে ‘বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামে আরেকটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমানে আমরা সাহায্যনির্ভর অর্থনীতি নয়, বরং এক ধরনের বাণিজ্যনির্ভরতার মধ্যে অবস্থান করছি। এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি ও বিপুল গরিব জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা নিয়েই আমাদের অর্থনৈতিক ভাগ্য ক্রমবর্ধমান হারে নির্ভরশীল হয়ে উঠছে কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের রপ্তানি খাতে অভিঘাত সৃষ্টি করছে তার ওপর। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ দেশে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক খাতে সাহায্য কর্মসূচি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।’
No comments