বিদ্যুতের ভূত তাড়াবে কে? by ডক্টর তুহিন মালিক

বাংলাদেশের মতো গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকারটি মানবাধিকারের পর্যায়ে না পড়লেও ন্যায্য মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের রয়েছে। সে কারণে এটি সরকারের অন্যতম একটি জনগুরুত্বপূর্ণর্ সেবা খাত হিসেবেও বিবেচিত।
কিন্তু জনগণের এ সেবাটি এ দেশে বহু আগেই বাণিজ্যে রূপ লাভ করেছে। এ খাতে সীমাহীন দুর্নীতি আর পুকুরচুরি-সমুদ্রচুরি বন্ধ হওয়া তো দূরে থাক, এই দুর্নীতির টাকা জোগান দিতে নিয়মিত গরিব জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে। একদিকে আইন অবজ্ঞা করে গণশুনানির নামে চলছে প্রহসন, অন্যদিকে প্রতিবাদ করলেই পিটুনির নামে চলছে নির্যাতন!
ডেসকো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে তাদের লোকসানকেই দায়ী করছে। অথচ ডেসকোর আত্মস্বীকৃত লোকসানের পরিমাণ মাত্র ১৪ কোটি টাকা। স্লাববিহীন ছয় মাসের বাড়তি উপার্জিত ৭০ কোটি টাকা এ হিসাবে বাদ দেখানো হয়েছে। এই টাকা হিসাবে ধরা হলে ৫৬ কোটি টাকা লাভ থাকে ডেসকোর। অর্থাৎ ডেসকো তাহলে একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান। আসলেও তা-ই। কিন্তু ডেসকো বলছে, তারা নিজেরা একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো না হলে তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নাকি বাস্তবায়নই করা যাবে না। আর এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডও গত বছর একটি খাত থেকে ২০০ কোটি টাকা উপার্জনের বিষয়টি একেবারেই গোপন করে নিজেদের লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাহির করছে। কিন্তু বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন টিম বলছে অন্য কথা। এ টিম প্রমাণ দিয়ে বলছে, তাদের নিজেদের উত্থাপিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী এ সংস্থাটিও একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের উচ্চ মহলের চাপে পড়ে হয়তো বিতরণ কম্পানিগুলো এসব মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যেকোনো মূল্যে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায়।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ছয় টাকা ২০ পয়সা থেকে ছয় টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত হতে পারে। এর আগেও যেমন বলা হতো, লোডশেডিং কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়, এবারও সেই একই কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য গ্রাহকদের, লোডশেডিং কমছে না। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, তা নিয়ে জনজীবন পর্যুদস্ত, তার ওপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া আর কিছু নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যাহত করবে। শুধু আমদানি-রপ্তানিমুখী শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সাধারণ ব্যবসায়ীরা এবং নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষেরও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে কষ্ট হবে। এসব দিক সরকার কেন বিবেচনায় নেয় না, তা বোধগম্য নয়। এর আগেরবার মূল্যবৃদ্ধির সময় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গর্বের সঙ্গে বলেছিল- এটাই হবে এ সরকারের আমলে শেষ মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু এ ঘোষণার মাত্র তিন মাসের মাথায় আবার কেন তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে?
গত সাড়ে চার বছরে বিদ্যুৎ খাত সরকারের সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত খাত হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। কুইক রেন্টাল সিস্টেমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুঘলকি পরিকল্পনায় শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। সেই সঙ্গে কুইক রেন্টালের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশ। একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পেছনে চাহিদা পূরণের চেয়ে কারো কারো পকেটপূর্তির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলেই অভিযোগ রয়েছে বেশি।
জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সরকার ভর্তুকির দোহাই দিচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লসের নামে যে অপচয় ও চুরি হচ্ছে, তা বন্ধ করতে পারলেও ভর্তুকি অনেকাংশে কমে যেত।
এখনো দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। ভুক্তভোগী অসহায় জনগণ তাদের ক্ষোভ আর প্রতিবাদ দেখাবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে সরকার পুলিশ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে ডাকা হরতাল সফল করে তুলেছে, আর অন্যদিকে একই দলের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে পুলিশ দিয়ে কেন পিটুনি দেওয়া হলো তা বোধগম্য নয়। বছর বছর যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরি, অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে; বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে তা সুকৌশলে গ্রাহকদের কাঁধে চাপানো হচ্ছে। কুইক রেন্টালের নামে সরকারি ইনডেমনিটিপ্রাপ্ত লুটপাট আর ভতুর্কির কণ্ঠ রোধ করা গেলে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। যে বর্ধিত মূল্যে কোনো কাজ হয় না, লোডশেডিং হ্রাস পায় না, যখন-তখন আবার মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্ন আসে এবং তা বাড়ানো হয়। এ নিষ্ঠুর খেলা কি বন্ধ হওয়ার নয়। জনগণের কষ্ট, সামর্থ্য, ভোগান্তি তো জনগণের নির্বাচিত সরকারই দেখবে। গণতান্ত্রিক সরকার তো কোনো দখলদার সরকার নয়। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনেই সরকারের সৃষ্টি হয়। তাই জনগণের ইচ্ছা, শক্তি-সামর্থ্যের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার কোনো অবস্থান নিলে, তা গণতান্ত্রিক হবে না কখনোই। সরকার ও জনগণ একে অন্যের শক্তি হিসেবে কাজ করুক- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.