জুতায় জুতায় ঢাকা ছিল খুনীদের কফিন
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রতি দেশবাসীর বুকে এতটা ঘৃণা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল যে, বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ আর আইনী প্রতিবন্ধকতার কারণে দীর্ঘ ৩৪ বছর মানুষ তা প্রকাশ করতে পারেনি। এবার তার বহির্প্রকাশ ঘটল।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বৃহস্পতিবার তাদের নিজ নিজ গ্রামে লাশ নিয়ে গেলে সৃষ্টি হয় তীব্র ৰোভের। অনেকেই এই পাপিষ্টদের লাশ তাদের গ্রামে দাফন করতে বাধা দেয়। কফিনে ছুড়ে মারে থুথু আর জুতা। এভাবেই মানুষ তাদের বুকের মধ্যে চেপে রাখা ঘৃণার বহির্প্রকাশ ঘটায়। পাঁচ খুনীর কফিন ঘিরে পুলিশ-র্যাবের কঠোর পাহারা থাকলেও তা বাদ সাধতে পারেনি সাধারণ মানুষের ঘৃণা প্রকাশের মাত্রাকে। মুহূর্তের মধ্যে দূর থেকে উড়ে এসে কফিনে পড়তে থাকে একের পর এক জুতা-স্যান্ডেল।নওগাঁ থেকে বিশ্বজিৎ মণি জানান, লে. কর্নেল (বরখাসত্ম) সৈয়দ ফারম্নক রহমানের লাশবাহী গাড়িটি নওগাঁ শহর থেকে মারমা মলিস্নকপুরে নিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থানে জড়ো হওয়া বিৰুব্ধ জনতা ঐ গাড়ি লৰ্য করে জুতা ছুড়া মারে এবং বঙ্গবন্ধুর ঘাতকের লাশ তাদের গ্রামে দাফন না করার জন্য প্রতিবাদ বিৰোভ করতে থাকে। অনেকে কফিন লৰ্য করে থুথু ছুড়ে মারে।
অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয় দুই মহিউদ্দিনের লাশবাহী গাড়ির বেলায়ও। পটুয়াখালী শহর থেকে লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স স্থানীয় পাগলা মোড়, চৌরাসত্মা ও শাখারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা হয়ে খুনীদের জন্মস্থান গলাচিপা উপজেলার রাঙ্গাবালী যাওয়ার পথে উত্তেজিত জনতা লাশবাহী গাড়িতে জুতা নিৰেপ করতে থাকে বলে পটুয়াখালী থেকে মোখলেছুর রহমান জানিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোপীনাথপুর থেকে ফিরে রিয়াজউদ্দিন জামি জানান, বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশিদ খানের কফিনটি ছিল প্রায় জুতায় ঢাকা। কফিন যখন বাসায় পেঁঁৗছে তখন লাশের স্বজনেরা জুতাগুলো সরিয়ে ফেলে।
চুয়াডাঙ্গা থেকে রাজিব হাসান কচি এবং গলাচিপা থেকে শংকর লাল দাশ জানান, প্রায় একই রকমের বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল মেজর (অব) বজলুল হুদার গ্রাম আলমডাঙ্গা উপজেলার হাট জোয়ালিয়ায় এবং গলাচিপার দুই খুনী মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) ও মহিউদ্দিন (ল্যান্সার)-এর লাশও গ্রহণ করতে চায়নি উপজেলার রাঙ্গাবালী গ্রামের মানুষ। তারাও খুনীদের প্রতি নানা মত প্রকাশ করে তীব্র ঘৃণা জানান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনী ল্যান্সার মহিউদ্দিন ও আর্টিলারি মহিউদ্দিনের লাশবাহী গাড়ি কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও পথে পথে চরম বিােভের মুখে পড়ে। ঢাকা থেকে আনার পথে বিভিন্ন পয়েন্টে হাজারো বিুব্ধ জনতা লাশবাহী গাড়িতে থুথু নিপে করে ও জুতা প্রদর্শন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিােভের মুখে পড়ে গলাচিপার হরিদেবপুর ফেরিঘাটে। বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটায় গ্রামের বাড়িতে নেয়ার উদ্দেশ্যে মেজর (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) ও লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহম্মেদের (আর্টিলারি) লাশবাহী দু'টি এ্যাম্বুলেন্স গলাচিপার হরিদেবপুর ফেরিঘাটে পেঁৗছে। তার আগে সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দসহ কয়েক হাজার মানুষ ফেরিঘাটের আশপাশে ও গলাচিপা-পটুয়াখালী সড়কের দু'পাশে অবস্থান নেয়। থেমে থেমে চলে বিুব্ধ মানুষের সেস্নাগান। ছোটখাটো কয়েকটি পথসভাও অনুষ্ঠিত হয়। এসব পথসভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল করিম, সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোসত্মফা টিটো, যুগ্ম সম্পাদক মজিবর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা নূরম্নল ইসলাম ধলা, বিআরডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এছাহাক আকনসহ নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। র্যাবও পুলিশ ভর্তি ১৬টি গাড়ি খুনীদের কফিনবাহী এ্যাম্বুলেন্স দু'টিকে কড়া প্রহরায় নিয়ে আসে। কিন্তু ফেরিঘাটের কাছে বটতলায় পৌঁছাতেই কফিনবাহী এ্যাম্বুলেন্স দু'টিকে ল্য করে শুরম্ন হয় বিুব্ধ জনতার থুথু নিপে ও জুতা প্রদর্শন। এক পর্যায়ে বিুব্ধ মানুষের চাপে ৩/৪ মিনিট গাড়ি দু'টি থমকে দাঁড়ালে মানুষ বৃষ্টির মতো থুথু নিপে করে। এ সময়ে বিুব্ধ মানুষের চাপ সামলাতে স্থানীয় প্রশাসনকেও হিমশিম খেতে হয়। ফেরিঘাটে এ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ দু'টি স্পিডবোটে তোলা হলে কয়েক শ' বিুব্ধ মানুষ নৌকা নিয়ে রামনাবাদ নদীতে নেমে পড়ে এবং নদীতেও চলে বিােভ প্রদর্শন। এর আগে গলাচিপা নিয়ে আসার পথে লেবুখালী ফেরিঘাট, দুমকি উপজেলার পাগলার মোড়, বাঁধঘাট, শাঁখারিয়া বাজার মোড়েও হাজারো জনতা বিােভ প্রদর্শন করে। এর আগে রাতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, সকালে দুই খুনীর লাশ গলাচিপা আনা হচ্ছে। এ খবরে ভোররাতেই বহু বিুব্ধ মানুষ গলাচিপা শহরের পথে নেমে আসে। লোকজন পৌরমঞ্চ ও আওয়ামী লীগ অফিসসহ আশপাশে অবস্থান নেয়। এরই এক পর্যায়ে শহরেও বিােভ মিছিল বের হয়।
এদিকে খুনীদের লাশ তাদের নিজ নিজ গ্রামে পেঁৗছার পর স্থানীয় জনগণ তীব্র ঘৃণুা আর প্রতিবাদ বিৰোভে ফেটে পড়ে। তারা এসব আত্মস্বীকৃত খুনীকে তাদের গ্রামের পবিত্র মাটিতে দাফন করতে বাধা দেয়। এ সময় পুলিশ-র্যাবকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
No comments