ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি by গাজীউল হক
একপাশে হাসপাতালের বর্জ্য, অন্যপাশে নালার পূতিগন্ধযুক্ত কালো পানি। এ দুইয়ের মাঝখানে চৌচালা টিনশেডের একটি বাড়ি। বাড়ির ঘরের ভেতরের প্রথমেই বৈঠকখানা। সেটা পেরিয়ে ভেতরে আরও একটি কক্ষ। তার লাগোয়া আরও ছোট-বড় তিনটি কক্ষ। একেবারেই জরাজীর্ণ। টিনের চালও ফুটো। আর সম্মুখভাগে রয়েছে চায়ের দোকান। শীত মৌসুম এলে এখানে পিঠা তৈরি হয়। শহরের বাসিন্দারা চাদর মুড়ি দিয়ে সেখানে যায়। আর বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি ঢুকে পড়ে। শহরবাসীর কাছে বাড়িটি বেশ পরিচিত। বলছিলাম, কুমিল্লা তথা উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজ্ঞ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ির কথা, যিনি একাধারে ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা-সংগ্রামে সামনে থেকে লড়াই করেছেন। সেই ভাষাসৈনিকের বাড়িটির আজ বেহাল দশা। জরাজীর্ণ ওই বাড়ি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়েই এর অবস্থান। প্রতিবছর বিশেষ কিছু দিনে সেখানে মোমবাতি জ্বলে। সংস্কৃতিকর্মীরা বাড়িটির সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করেন। এরপর আর সেটি এগোয় না। দিনে দিনে সেই বাড়ি এখন বিলীন হওয়ার পথে।
ওই দুর্দশা থেকে রক্ষা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। শনিবার ওই বাড়ি পরিদর্শন করতে যান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তিনি এর চারদিক ঘুরে হতাশ হন। এরপর বৈঠকখানায় বসে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন।
একপর্যায়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি উন্নয়নকর্মী আরোমা দত্তকে মন্ত্রী প্রশ্ন করলেন, এত দিন তুমি উদ্যোগ নিলে না?
সঙ্গে থাকা নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘তুই (আরমা দত্ত) ক্লিয়ার করে বল।’
কবি নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী বললেন, ‘কিছু করা উচিত।’
নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার বললেন, ‘রাজধানী ঢাকায় তাঁর নামে একটি সড়কের নামও হয়নি। বছর দুয়েক আগে আনিসুজ্জামান স্যার ঢাকা সিটি করপোরেশন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার কাছে আবেদনও করেন। এর পরও দুই দফা মেয়রকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এবার আরমা দত্ত মুখ খুললেন। বললেন, ‘এখানে ১৫ শতক জায়গা রয়েছে। জাল দলিল করে জনৈক ব্যক্তি ওই জায়গার মালিক দাবি করেন। এরপর সেটা নিয়ে মামলা হয়। ১৩ বছর ধরে ওই মামলা স্থগিত রয়েছে। এ জায়গাটিই আমাদের একমাত্র সম্বল। এখানে উঁচু দালান করে এর প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর করতে চাই। বাকিগুলো নিজেদের কাজে ব্যবহার করব।’
জবাবে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।’
পাঠক, আসুন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে কয়েকটি কথা শুনি। ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুতে তিনি শিক্ষকতার মহান পেশা বেছে নেন। এরপর বাবা জগবন্ধু দত্তের আগ্রহে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ওকালতি করতে গিয়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর নিপীড়নের কথা শুনে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি রাজনীতির ময়দানে ছিলেন বিপ্লবের অতন্দ্রপ্রহরী। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে করেছেন প্রতিবাদ- প্রতিরোধ। তিনি অবিভক্ত বাংলার বিধানসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ এই দিনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় গৃহবন্দী ছিলেন। এরপর সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এই বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর ছেলে দিলীপ দত্তকে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। এরপর আর তাঁদের হদিস মেলেনি। তাঁর নামে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়। ১৬০ আসনের ওই ছাত্রাবাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্ররা থাকছেন। তিনি স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। তিনি ‘কমরেড ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’ নামে পরিচিত ছিলেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শহীদ হয়েছেন ৩৯ বছর আগে। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তাঁর বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এ নিয়ে বহুবার কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি সংসদ পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেন। পাঁচ দফার দাবিগুলো ছিল: অবিলম্বে বাড়ির আইনি জটিলতা নিরসন, বাড়িটির সংরক্ষণ ও সংস্কার, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন, তাঁর নামে হাসপাতাল স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপন করা। সংসদের আহ্বায়ক প্রদীপ কুমার পাল ও সদস্যসচিব নাজমূল বারী চৌধুরী বলেন, ‘একসঙ্গে দুটি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ব্যক্তিত্বের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমান সরকার চাইলেই বাড়িটিকে রক্ষা করতে পারবে।’
কুমিল্লাবাসীর উৎকণ্ঠা, সরকারি উদ্যোগ না থাকলে বাড়িটি যেকোনো সময়ে বেহাত হয়ে যেতে পারে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ওই বাড়ি কেবল কুমিল্লাবাসীর কাছে পরিচিত নয়, অবিভক্ত বাংলার মানুষের কাছে এর নাম রয়েছে। কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মীদের বিশ্বাস, এবার কিছু একটা হবে। সেই কিছুর প্রতীক্ষায় রইলেন তারা।
ওই দুর্দশা থেকে রক্ষা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। শনিবার ওই বাড়ি পরিদর্শন করতে যান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তিনি এর চারদিক ঘুরে হতাশ হন। এরপর বৈঠকখানায় বসে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন।
একপর্যায়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি উন্নয়নকর্মী আরোমা দত্তকে মন্ত্রী প্রশ্ন করলেন, এত দিন তুমি উদ্যোগ নিলে না?
সঙ্গে থাকা নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘তুই (আরমা দত্ত) ক্লিয়ার করে বল।’
কবি নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী বললেন, ‘কিছু করা উচিত।’
নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার বললেন, ‘রাজধানী ঢাকায় তাঁর নামে একটি সড়কের নামও হয়নি। বছর দুয়েক আগে আনিসুজ্জামান স্যার ঢাকা সিটি করপোরেশন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার কাছে আবেদনও করেন। এর পরও দুই দফা মেয়রকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এবার আরমা দত্ত মুখ খুললেন। বললেন, ‘এখানে ১৫ শতক জায়গা রয়েছে। জাল দলিল করে জনৈক ব্যক্তি ওই জায়গার মালিক দাবি করেন। এরপর সেটা নিয়ে মামলা হয়। ১৩ বছর ধরে ওই মামলা স্থগিত রয়েছে। এ জায়গাটিই আমাদের একমাত্র সম্বল। এখানে উঁচু দালান করে এর প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর করতে চাই। বাকিগুলো নিজেদের কাজে ব্যবহার করব।’
জবাবে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।’
পাঠক, আসুন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে কয়েকটি কথা শুনি। ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুতে তিনি শিক্ষকতার মহান পেশা বেছে নেন। এরপর বাবা জগবন্ধু দত্তের আগ্রহে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ওকালতি করতে গিয়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর নিপীড়নের কথা শুনে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি রাজনীতির ময়দানে ছিলেন বিপ্লবের অতন্দ্রপ্রহরী। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে করেছেন প্রতিবাদ- প্রতিরোধ। তিনি অবিভক্ত বাংলার বিধানসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ এই দিনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় গৃহবন্দী ছিলেন। এরপর সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এই বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর ছেলে দিলীপ দত্তকে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। এরপর আর তাঁদের হদিস মেলেনি। তাঁর নামে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়। ১৬০ আসনের ওই ছাত্রাবাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্ররা থাকছেন। তিনি স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। তিনি ‘কমরেড ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’ নামে পরিচিত ছিলেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শহীদ হয়েছেন ৩৯ বছর আগে। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তাঁর বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এ নিয়ে বহুবার কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি সংসদ পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেন। পাঁচ দফার দাবিগুলো ছিল: অবিলম্বে বাড়ির আইনি জটিলতা নিরসন, বাড়িটির সংরক্ষণ ও সংস্কার, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন, তাঁর নামে হাসপাতাল স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপন করা। সংসদের আহ্বায়ক প্রদীপ কুমার পাল ও সদস্যসচিব নাজমূল বারী চৌধুরী বলেন, ‘একসঙ্গে দুটি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ব্যক্তিত্বের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমান সরকার চাইলেই বাড়িটিকে রক্ষা করতে পারবে।’
কুমিল্লাবাসীর উৎকণ্ঠা, সরকারি উদ্যোগ না থাকলে বাড়িটি যেকোনো সময়ে বেহাত হয়ে যেতে পারে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ওই বাড়ি কেবল কুমিল্লাবাসীর কাছে পরিচিত নয়, অবিভক্ত বাংলার মানুষের কাছে এর নাম রয়েছে। কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মীদের বিশ্বাস, এবার কিছু একটা হবে। সেই কিছুর প্রতীক্ষায় রইলেন তারা।
No comments