গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয় ওদের
কোটা
সংস্কার আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছে। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ
সম্মেলন করে মামলা প্রত্যাহারে দুইদিনের নতুন আলটিমেটাম দেয়ার পর
আন্দোলনকারীদের অন্যতম তিন নেতাকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তুলে নেয়ার ঘটনায়
আন্দোলনকারীদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে
দেয়া হলেও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন তারা। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে
সংবাদ সম্মেলন করে আগামী দুইদিনের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও মামলা
প্রত্যাহার না হলে ফের আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন নেতারা। এর কিছুক্ষণ পর
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটক থেকে বাংলাদেশ ছাত্র
অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর, মোহাম্মদ রাশেদ খান ও
ফারুক হাসানকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।
মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেয়ার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। তাদের গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ- কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত ৮ই এপ্রিল শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন টানা চারদিন চলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। পরের দিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ৫ শর্তে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের শর্ত ছিল।
এই কয়েকদিনে এই দুই শর্তের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গতকাল বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে নেতারা নতুন আলটিমেটাম দেন। এর পর পরই তিন নেতাকে তুলে নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ তথ্য ছড়িয়ে দেন তারা। নেতাদের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকেন। এদিকে ছাত্রলীগের নেতারা ফেসবুকে তিন নেতাকে তুলে নেয়ার বিষয়টি ‘গুজব’ বলে প্রচারণা চালান। তারা শিক্ষার্থীদের জড়ো হতে নিষেধ করেন। দুই ঘণ্টা পর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পান তিন নেতা। এরপর বিকাল সাড়ে তিনটার পর ঢাবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি। সেখানে বক্তৃতা করেন পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়ক বনি ইয়ামিন, নুরুল হক নূর, রাশেদ খান ও ফারুক হাসান।
বনি ইয়ামিন বলেন, বেলা পৌনে ১টার দিকে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন দুপুরের খাবার খেতে রিকশায় করে চানখাঁরপুল যাচ্ছিলাম। মোট তিনটা রিকশা ছিলো। প্রথম রিকশায় ছিলেন রাশেদ, নূর ও ফারুক। শেষের রিকশায় ছিলেন বনি ইয়ামিন। খেতে যাওয়ার জন্য রিকশায় করে পরে তারা আহত শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য মেডিকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম রিকশাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আসলে পেছন থেকে তিনটা মোটরসাইকেল ওই রিকশার গতিরোধ করে। পরে পেছন থেকে একটি সাদা রঙের হাইএস মডেলের মাইক্রোবাস আসে। মোটরসাইকেল ও গাড়ি থেকে ৭-৮ জন নেমে ওই তিনজনকে রিকশা থেকে নেমে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, তিনি রিকশা থেকে নেমে মোবাইলে গাড়িতে তুলে নেয়ার ভিডিও ধারণ করেন। এবং বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাসপাতালের ফটকের বিপরীত পাশে খাবার দোকানের কর্মচারী সোহেলও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে রিকশায় বসা তিনটি ছেলেকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। এ সময় কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম সমন্বয়ক নূর বলেন, আজকে আমরা ন্যায়ের জন্য আন্দোলন করতে এসে সারা বাংলার ছাত্র সমাজের যৌক্তিক দাবি কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে এসে হত্যার হুমকি পাচ্ছি। পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে অনেকে দেখেছে বলে ফিরে এসেছি। না হলে ফিরে আসতাম কিনা, এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারতাম কিনা সেটা নিয়ে আমরা সন্দিহান ছিলাম। তাই আপনাদের বলবো এই ন্যায় আন্দোলনের সৈনিকদের ওপর যখন অত্যাচার হবে তখন আপনারা আপনাদের কলম দিয়ে তা তুলে ধরুন। সাংবাদিকরা একটি জাতির বিবেক। আপনারা যদি কিছু লুকায়িত রাখেন এই দেশের মানুষ কিছু জানবে না। তাই আপনাদের বারবার আহ্বান জানাবো, আপনারা আপনাদের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সঠিক সত্যটি তুলে ধরবেন, কখনো সত্য তুলে ধরতে কার্পণ্য করবেন না। আমরা আজকে সকালে সংবাদ সম্মেলনের পর অসুস্থ ভাইবোনদের দেখতে ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছিলাম। আমাদের প্ল্যান ছিল তাদের দেখে আমরা চানখাঁরপুলে খেতে যাবো। কিন্তু আমরা ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের ফটকে যাওয়ার পর পরই কিছু লোক ঘিরে ধরে। অনেকের হাতে দেখেছি রিভলবার। তারা আমাদের একজনকে টেনেটুনে বলে আমরা ডিবির লোক গাড়িতে উঠ। আমরা পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে আমাদের সুযোগ না দিয়ে ধাক্কা মেরে গাড়িতে উঠিয়েছে। গুলিস্তান যাওয়ার পর গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হয়। এর আগে আমাকে হেলমেট দিয়ে আটকানো হয়। আমি হয়তো ভেবেছিলাম এটাই আমার শেষ। মুসলমান ধর্ম অনুযায়ী আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিই। ভেবেছিলাম আজকে হয়তো শেষ। তিনি বলেন, আমরা সবসময় সরকারের সঙ্গে সমাঝোতা চেয়েছি। সরকারের কথা শুনেছি। তাদের ডাকে সচিবালয়ে গিয়েছি।
আমাদের দাবি দাওয়া যেহেতু প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। আমরা সেটাকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করেছি। তারপরও আমাদের বারবার হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। গুম করার হুমকি দেয়া হচ্ছে এবং আজকে যে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুবই নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের চোখ বাঁধা ছিল। আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ি। চোখ খুলে দেখি আমরা ডিবির কার্যালয়ে। ওখানে আমাদের বললো তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। আমাদের ভিডিও ফুটেজ দেখানো হবে। আমাদের ওপর নাকি হামলার আশঙ্কা ছিল। এই জন্য তারা নিয়ে এসেছে। আমাদের ভিডিও ফুটেজ কোনো কিছু দেখায়নি। বলছে তোমরা এখন চলে যাও। তোমাদেরকে ডাকলে আবার আসবা। তবে আমাদের কোনো ভিডিও দেখায় নাই। নূর আরো বলেন, সারা বাংলার ছাত্র সমাজকে জানিয়ে দিতে চাই। আমরা শুধু নিজের জন্য এই আন্দোলন করিনি। তোমাদের সকলের জন্য নিজের জীবনকে হত্যার সম্মুখীন করে এই আন্দোলনে এসেছি। এজন্য আমাদের ওপর বারবার নির্যাতন নেমে আসছে। তোমরা যদি সোচ্চার না হও। আর কেউ তোমাদের হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না। আর কোনো সুষ্ঠু বিবেক বুদ্ধির ন্যায়বান মানুষ, মানুষের ন্যায় অধিকারের হয়ে কথা বলবে না। জাতির বিবেক মরে যাবে। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার মানুষ থাকবে না। জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বলবো শুধু আমি না। যখনই কোনো অন্যায় হবে। তখনই তোমরা গর্জে উঠো।
আমি আজকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে দেখেছিলাম শত শত লোক। কেউ তো বলে নাই কেন আপনারা এই ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। বলেছিলাম ভাই আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। অথচ আমরা তো সবার স্বার্থের জন্য এই আন্দোলন করেছিলাম। আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাশেদ খাঁন বলেন, আমাকে না হয় মেরে ফেলল, আমার আব্বা কি অন্যায় করেছে। তার ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে কি সে অন্যায় করেছে। তার ছেলে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলায় কি সে অন্যায় করেছে। আজকে জাতির কাছে আমি এ বিচার দিলাম। আমাকে না হয় মেরে ফেলল আমার আব্বাকে কেন থানায় নেওয়া হয়েছে। আমার আব্বাকে কেন পুলিশ গালিগালাজ করলো। যা-তা বলল। আমার আব্বা কান্না করতে করতে ফোন দিচ্ছে। কেন আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা কি অন্যায় করেছি। আপনারা এই নিউজটা তুলে ধরেন। আমার আব্বাকে গালিগালাজ করা হয়েছে। সে কান্না করছে। তিনি বলেন, আমাদের চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একই সাথে আমার আব্বাকে গ্রাম থেকে বলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই বলে তাকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে। এবং তাকে ওইখানকার ওসি বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করছে। এবং তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা হয় সে জামায়াত-শিবির করে এবং তার ছেলে শিবির করে। আমার আব্বাকে আটকে রাখা হয়। আমার আব্বা কোনো অন্যায় করেনি। সে একজন দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হইনি। আমি একটি ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে এসেছি। আমি একজন সাধারণ ছাত্র। আমি কি সাধারণ ছাত্র হিসেবে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পারি না। আজ আমার কোনো পোস্ট নেই। আমি কোনো রাজনীতি করি না। এজন্য কি আমাকে ট্যাগ দেয়া হবে। আমার আব্বাকে থানায় আটকে রাখা হবে। তাকে কি গালিগালাজ করা হবে। আজকে আমাদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা নেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় হামলা করবে। তাদের গ্রেপ্তার করবে। আজকে যেমন আমার আব্বাকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। যুগ্ম সমন্বয়ক ফারুক হোসেন বলেন, আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সবার হাতে রিভলবার ছিল। আমাদের কাছে তথ্য চাইলে আমরা তাদের সঙ্গে গিয়ে তথ্য দিয়ে আসতাম। কিন্তু এভাবে চোখ বন্ধ করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কেন?
সংবাদ সম্মেলনের পরে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এর আগে সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় কমিটি। সেখানে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আন্দোলনে অংশ নেয়া যে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে আগামী দু’দিনের মধ্যে সেগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এ সময়ের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার না হলে ফের আন্দোলনে নামবে বলে জানিয়েছেন তারা। আন্দোলনকারীরা বলেন, আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে একটি কুচক্রী মহল জামায়াত-শিবির পরিচয় দিতে উঠেপড়ে লেগেছে, যা পুরোপুরি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
নেতারা বলেন, ‘এ ধরনের সংবাদ প্রচার করা হলে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমরা যদি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি, পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। তারা ইতিবাচক পেয়েছে বলেই আমাদের আন্দোলনে কোনো বাধা দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীও আমাদের দাবি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আমাদের ভিন্ন পরিচয় দিয়ে আন্দোলন ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে।’ সংগঠনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। এবং আমি মহসীন হলে ছাত্রলীগের সহসভাপতি। আমি সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। কেউ যদি আমাকে সন্দেহ করে থাকেন, তাহলে আমার পরিবারে খবর নিতে পারেন।’ সংবাদ সম্মেলন থেকে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাকে বিকেল ৫টার মধ্যে প্রকাশিত সংবাদ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে সময় বেঁধে দেয় আন্দোলনকারীরা। পরে পত্রিকাটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্ষমা চেয়ে সংবাদ প্রত্যাহার করে নেয়।
মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেয়ার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। তাদের গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ- কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত ৮ই এপ্রিল শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন টানা চারদিন চলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। পরের দিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ৫ শর্তে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের শর্ত ছিল।
এই কয়েকদিনে এই দুই শর্তের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গতকাল বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে নেতারা নতুন আলটিমেটাম দেন। এর পর পরই তিন নেতাকে তুলে নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ তথ্য ছড়িয়ে দেন তারা। নেতাদের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকেন। এদিকে ছাত্রলীগের নেতারা ফেসবুকে তিন নেতাকে তুলে নেয়ার বিষয়টি ‘গুজব’ বলে প্রচারণা চালান। তারা শিক্ষার্থীদের জড়ো হতে নিষেধ করেন। দুই ঘণ্টা পর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পান তিন নেতা। এরপর বিকাল সাড়ে তিনটার পর ঢাবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি। সেখানে বক্তৃতা করেন পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়ক বনি ইয়ামিন, নুরুল হক নূর, রাশেদ খান ও ফারুক হাসান।
বনি ইয়ামিন বলেন, বেলা পৌনে ১টার দিকে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন দুপুরের খাবার খেতে রিকশায় করে চানখাঁরপুল যাচ্ছিলাম। মোট তিনটা রিকশা ছিলো। প্রথম রিকশায় ছিলেন রাশেদ, নূর ও ফারুক। শেষের রিকশায় ছিলেন বনি ইয়ামিন। খেতে যাওয়ার জন্য রিকশায় করে পরে তারা আহত শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য মেডিকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম রিকশাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আসলে পেছন থেকে তিনটা মোটরসাইকেল ওই রিকশার গতিরোধ করে। পরে পেছন থেকে একটি সাদা রঙের হাইএস মডেলের মাইক্রোবাস আসে। মোটরসাইকেল ও গাড়ি থেকে ৭-৮ জন নেমে ওই তিনজনকে রিকশা থেকে নেমে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, তিনি রিকশা থেকে নেমে মোবাইলে গাড়িতে তুলে নেয়ার ভিডিও ধারণ করেন। এবং বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাসপাতালের ফটকের বিপরীত পাশে খাবার দোকানের কর্মচারী সোহেলও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে রিকশায় বসা তিনটি ছেলেকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। এ সময় কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম সমন্বয়ক নূর বলেন, আজকে আমরা ন্যায়ের জন্য আন্দোলন করতে এসে সারা বাংলার ছাত্র সমাজের যৌক্তিক দাবি কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে এসে হত্যার হুমকি পাচ্ছি। পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে অনেকে দেখেছে বলে ফিরে এসেছি। না হলে ফিরে আসতাম কিনা, এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারতাম কিনা সেটা নিয়ে আমরা সন্দিহান ছিলাম। তাই আপনাদের বলবো এই ন্যায় আন্দোলনের সৈনিকদের ওপর যখন অত্যাচার হবে তখন আপনারা আপনাদের কলম দিয়ে তা তুলে ধরুন। সাংবাদিকরা একটি জাতির বিবেক। আপনারা যদি কিছু লুকায়িত রাখেন এই দেশের মানুষ কিছু জানবে না। তাই আপনাদের বারবার আহ্বান জানাবো, আপনারা আপনাদের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সঠিক সত্যটি তুলে ধরবেন, কখনো সত্য তুলে ধরতে কার্পণ্য করবেন না। আমরা আজকে সকালে সংবাদ সম্মেলনের পর অসুস্থ ভাইবোনদের দেখতে ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছিলাম। আমাদের প্ল্যান ছিল তাদের দেখে আমরা চানখাঁরপুলে খেতে যাবো। কিন্তু আমরা ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের ফটকে যাওয়ার পর পরই কিছু লোক ঘিরে ধরে। অনেকের হাতে দেখেছি রিভলবার। তারা আমাদের একজনকে টেনেটুনে বলে আমরা ডিবির লোক গাড়িতে উঠ। আমরা পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে আমাদের সুযোগ না দিয়ে ধাক্কা মেরে গাড়িতে উঠিয়েছে। গুলিস্তান যাওয়ার পর গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হয়। এর আগে আমাকে হেলমেট দিয়ে আটকানো হয়। আমি হয়তো ভেবেছিলাম এটাই আমার শেষ। মুসলমান ধর্ম অনুযায়ী আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিই। ভেবেছিলাম আজকে হয়তো শেষ। তিনি বলেন, আমরা সবসময় সরকারের সঙ্গে সমাঝোতা চেয়েছি। সরকারের কথা শুনেছি। তাদের ডাকে সচিবালয়ে গিয়েছি।
আমাদের দাবি দাওয়া যেহেতু প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। আমরা সেটাকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করেছি। তারপরও আমাদের বারবার হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। গুম করার হুমকি দেয়া হচ্ছে এবং আজকে যে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুবই নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের চোখ বাঁধা ছিল। আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ি। চোখ খুলে দেখি আমরা ডিবির কার্যালয়ে। ওখানে আমাদের বললো তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। আমাদের ভিডিও ফুটেজ দেখানো হবে। আমাদের ওপর নাকি হামলার আশঙ্কা ছিল। এই জন্য তারা নিয়ে এসেছে। আমাদের ভিডিও ফুটেজ কোনো কিছু দেখায়নি। বলছে তোমরা এখন চলে যাও। তোমাদেরকে ডাকলে আবার আসবা। তবে আমাদের কোনো ভিডিও দেখায় নাই। নূর আরো বলেন, সারা বাংলার ছাত্র সমাজকে জানিয়ে দিতে চাই। আমরা শুধু নিজের জন্য এই আন্দোলন করিনি। তোমাদের সকলের জন্য নিজের জীবনকে হত্যার সম্মুখীন করে এই আন্দোলনে এসেছি। এজন্য আমাদের ওপর বারবার নির্যাতন নেমে আসছে। তোমরা যদি সোচ্চার না হও। আর কেউ তোমাদের হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না। আর কোনো সুষ্ঠু বিবেক বুদ্ধির ন্যায়বান মানুষ, মানুষের ন্যায় অধিকারের হয়ে কথা বলবে না। জাতির বিবেক মরে যাবে। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার মানুষ থাকবে না। জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বলবো শুধু আমি না। যখনই কোনো অন্যায় হবে। তখনই তোমরা গর্জে উঠো।
আমি আজকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে দেখেছিলাম শত শত লোক। কেউ তো বলে নাই কেন আপনারা এই ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। বলেছিলাম ভাই আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। অথচ আমরা তো সবার স্বার্থের জন্য এই আন্দোলন করেছিলাম। আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাশেদ খাঁন বলেন, আমাকে না হয় মেরে ফেলল, আমার আব্বা কি অন্যায় করেছে। তার ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে কি সে অন্যায় করেছে। তার ছেলে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলায় কি সে অন্যায় করেছে। আজকে জাতির কাছে আমি এ বিচার দিলাম। আমাকে না হয় মেরে ফেলল আমার আব্বাকে কেন থানায় নেওয়া হয়েছে। আমার আব্বাকে কেন পুলিশ গালিগালাজ করলো। যা-তা বলল। আমার আব্বা কান্না করতে করতে ফোন দিচ্ছে। কেন আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা কি অন্যায় করেছি। আপনারা এই নিউজটা তুলে ধরেন। আমার আব্বাকে গালিগালাজ করা হয়েছে। সে কান্না করছে। তিনি বলেন, আমাদের চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একই সাথে আমার আব্বাকে গ্রাম থেকে বলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই বলে তাকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে। এবং তাকে ওইখানকার ওসি বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করছে। এবং তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা হয় সে জামায়াত-শিবির করে এবং তার ছেলে শিবির করে। আমার আব্বাকে আটকে রাখা হয়। আমার আব্বা কোনো অন্যায় করেনি। সে একজন দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হইনি। আমি একটি ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে এসেছি। আমি একজন সাধারণ ছাত্র। আমি কি সাধারণ ছাত্র হিসেবে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পারি না। আজ আমার কোনো পোস্ট নেই। আমি কোনো রাজনীতি করি না। এজন্য কি আমাকে ট্যাগ দেয়া হবে। আমার আব্বাকে থানায় আটকে রাখা হবে। তাকে কি গালিগালাজ করা হবে। আজকে আমাদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা নেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় হামলা করবে। তাদের গ্রেপ্তার করবে। আজকে যেমন আমার আব্বাকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। যুগ্ম সমন্বয়ক ফারুক হোসেন বলেন, আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সবার হাতে রিভলবার ছিল। আমাদের কাছে তথ্য চাইলে আমরা তাদের সঙ্গে গিয়ে তথ্য দিয়ে আসতাম। কিন্তু এভাবে চোখ বন্ধ করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কেন?
সংবাদ সম্মেলনের পরে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এর আগে সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় কমিটি। সেখানে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আন্দোলনে অংশ নেয়া যে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে আগামী দু’দিনের মধ্যে সেগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এ সময়ের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার না হলে ফের আন্দোলনে নামবে বলে জানিয়েছেন তারা। আন্দোলনকারীরা বলেন, আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে একটি কুচক্রী মহল জামায়াত-শিবির পরিচয় দিতে উঠেপড়ে লেগেছে, যা পুরোপুরি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
নেতারা বলেন, ‘এ ধরনের সংবাদ প্রচার করা হলে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমরা যদি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি, পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। তারা ইতিবাচক পেয়েছে বলেই আমাদের আন্দোলনে কোনো বাধা দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীও আমাদের দাবি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আমাদের ভিন্ন পরিচয় দিয়ে আন্দোলন ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে।’ সংগঠনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। এবং আমি মহসীন হলে ছাত্রলীগের সহসভাপতি। আমি সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। কেউ যদি আমাকে সন্দেহ করে থাকেন, তাহলে আমার পরিবারে খবর নিতে পারেন।’ সংবাদ সম্মেলন থেকে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাকে বিকেল ৫টার মধ্যে প্রকাশিত সংবাদ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে সময় বেঁধে দেয় আন্দোলনকারীরা। পরে পত্রিকাটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্ষমা চেয়ে সংবাদ প্রত্যাহার করে নেয়।
No comments