সংসারে সংসারে অশান্তির ঝড় by হাফিজ মুহাম্মদ
শাহরিন
ও জামাল দম্পতি। দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। ছেলে দুটি নবম
শ্রেণি এবং মেয়েটি চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। শাহরিনের স্বামী থাকেন
মধ্যপ্রাচ্যে। মাস শেষে টাকা পাঠান। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ মিটিয়ে
ভালোভাবে সংসার চলে যায়। কিন্তু অগত্যা এ দম্পতির সংসারে নেমে আসে কালো
ছায়া। শাহরিনের স্বামী তাকে প্রতিমাসে টাকা দিলেও তার কোনো হিসাব রাখতেন
না। নিজ স্ত্রীর কাছে জানতেও চাইতেন না কোথায় কি খরচ করেছে। মনে করতেন
ছেলেমেয়েদের খরচ মিটিয়ে যে টাকা-পয়সা উদ্বৃত থাকে তা তার ব্যাংক একাউন্টে
জমা রয়েছে। ওদিকে হঠাৎ স্ত্রী শাহরিন তার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন।
সারাদিনের কাজ শেষে যখন একটু সময় পান তখন স্ত্রীকে ফোন দিলে তেমন একটা পাত্তা দেন না। কথা বলতেও যেন অনাগ্রহ। এক পর্যায়ে শাহরিন তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনেন। একসময় টাকার প্রয়োজন ছাড়া শাহরিন তার স্বামীকে ফোন দিতেন না। বিষয়টা জামালের কাছে খটকা লাগতে থাকে। সন্দেহ করতে থাকেন স্ত্রীর পরিবর্তনে। কিন্তু স্ত্রীকেও তিনি বুঝতে দিতেন না। শাহরিনের হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ হিসেবে তিনি আবিষ্কার করেন অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেমে জড়ানো। তিনি মজেছেন সিয়াম নামে এক তরুণের প্রেমে। শাহরিনের এ প্রেমের সূত্রপাতটা তার মোবাইলে রঙ নম্বরের ফোন দিয়ে।
প্রথমে শাহরিন কথা বলতে না চাইলেও একসময় কথা বলতে শুরু করেন। রাতভর কথা বলতে থাকলেও পরিবারকে জানাতেন স্বামীর সঙ্গে কথা বলি। নিয়মিত কথা বলতে বলতে তার জালে একসময় বিদ্ধ হন তিনি। প্রেমে হাবুডাবু খেতে থাকেন নিজের থেকে কম বয়সী তরুণটির। এদিকে সিয়ামও ধীরে ধীরে শাহরিনের সবকিছু জেনে নেয়। তার একাউন্টে জমানো টাকা থেকে নিজের দুর্বলতা সবকিছু। একসময় সিয়াম শাহরিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন। দুজনে দেখা করেন, মেলামেশা করেন। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখেন প্রতিমুহূর্ত। এদিকে শাহরিন তার সন্তানদের প্রতিও নজর কমিয়ে দেন। ঠিকভাবে খোঁজখবর রাখেন না। শুধু টাকা দিয়েই দায়সারা। জামাল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি দেশে চলে আসেন। স্ত্রীর একাউন্টে ২৫ লাখ টাকা জমা ছিল বলে জানতেন জামাল। কিন্তু এখন তার একাউন্ট দেখছেন ফাঁকা।
এ বিষয়ে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে বিভিন্ন ছুতা দিয়ে এক পর্যায়ে শাহরিন জানিয়ে দেন জামালের সঙ্গে তিনি আর সংসার করবেন না। জামাল টাকার মায়া বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ের কথা ভেবে স্ত্রীকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আসলে জামাল দেশে আসার আগেই শাহরিন সিয়ামের সঙ্গে কাজী অফিসের মাধ্যমে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার আগে থেকেই শারীরিক মেলামেশা করতেন। যেটা গোপনই ছিল। মাঝেমধ্যে সিয়ামের বাড়িতে বেড়াতেও যেতেন। সিয়ামের পরিবার শাহরিনকে ছেলের কুমারী পুত্রবধূ বলে জানতেন। এদিকে শাহরিনের মা-বাবার তো চিন্তার শেষ নেই। বংশের সম্মান, নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা। তার পরিবার নানাভাবে বুঝাতে থাকেন। কিছুতে কিছু হয় না। শেষমেশ তিন সন্তান রেখেই সিয়ামের হাত ধরে পালিয়ে যান শাহরিন। এদিকে সিয়াম তার বাবার নিম্নবিত্ত সংসারে শাহরিনকে বোঝা না বানিয়ে রেখে পাঠিয়ে দেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে। এদিকে জামাল তার সন্তানসহ পড়েন অথৈ সাগরে।
শুধু জামাল আর শাহরিন দম্পতির সংসার নয়। এরকম অনেক পরিবার ভাঙা কিংবা ফাটল ধরার ঘটনা শোনা যায় চারপাশে। এর অধিকাংশ কারণ হচ্ছে মোবাইল ফোন। যোগাযোগের অন্যতম এ ডিভাইসটির সুযোগে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হন। অনেকে আবার শিকার করেন। আর তাতে যোগ দিয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মোবাইল ফোন আমাদের যোগাযোগ বছর-মাস থেকে সেকেন্ডে নিয়ে এসেছে। অপরদিকে এর অপব্যবহার সমাজে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণেই সমাজে পরিবারে ভাঙন শুরু হয়েছে। এটা কখনো স্বামী-স্ত্রীর একজনের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া, কখনো বাসার একমাত্র ছেলে-মেয়েটি অন্য ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া অথবা মোবাইলে সারাদিন পড়ে থাকা। অন্যদিকে আলেমরা বলছেন, মোবাইল ফোন যোগাযোগ অনেক কাছাকাছি করেছে। পাশাপাশি এর ভিন্নদিকও দেখা যায়। এটা নৈতিকতার মারাত্মক অবক্ষয় ঘটিয়েছে। সংসারে ফাটল ধরিয়েছে। তরুণ-তরুণীদের মাঝে অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে আজকাল সংসার ভাঙছে। মোবাইলে অপরিচিতদের সঙ্গে কথোপকথন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই-মেইলের মাধ্যমে সহজেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছে। অপরিচিতদের সঙ্গে নিজের নেতিবাচক জিনিসগুলো শেয়ার করে অন্যের ফাঁদে পড়ে যায় এবং সেই ফাঁদটা যদি কোনো খারাপ পাত্র হয় তাহলে বিষয়টি আরো বিপজ্জনক হয়। মোবাইল বা ফেসবুক কালচারের কু-প্রভাব, এসবে অন্যের ঘাটতিগুলো বেশি দেখা, গুণগুলো না দেখায় এসব মাধ্যম আমাদের বিপদগামী করে। এসব করতে গিয়ে কষ্টগুলো বেড়ে যায়, হতাশা বেড়ে যায়। ফলে অ্যাডজাস্টমেন্টে সমস্যা শুরু হয়। পারিবারিক অশান্তি, কলহ বেড়ে যায়। যার পরিণতি চূড়ান্ত পর্যায় বিবাহ বিচ্ছেদ, হত্যাসহ নানা দুর্ঘটনা। মোবাইল ফোনের কারণে যে, আমাদের পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে তা ফুটে উঠেছে খোদ আমাদের প্রেসিডেন্টের কথায়। ৪ঠা এপ্রিল খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) তৃতীয় সমাবর্তনে তিনি বলেন, এখন মোবাইল ফোন নিয়ে সবাই ব্যস্ত।
এ কারণে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তি উন্নয়নের সহায়ক। তবে এই প্রযুক্তি যেন সর্বনাশের কারণ না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন সেদিন তিনি। ইতিবাচক পরিবর্তন ও মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানোর মধ্যেই প্রযুক্তির সার্থকতা নিহিত বলে প্রেসিডেন্ট মনে করেন।
পাঁচবছর আগের ঘটনা। এইচএসসি পড়ুয়া ঝুমা বেগম। তিন ভাই বিদেশে থাকায় ঘরের মোবাইল ফোন তার কাছেই থাকতো। হঠাৎ একদিন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। আমিনুল নামে একজন ভাইয়ের বন্ধু পরিচয়ে কথা বলেন। এরপর নিয়মিত কথা হতো। একসময় তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন প্রেমের সম্পর্কে। এক পর্যায়ে বিবাহ হয় আমিনুল-ঝুমার। কিন্তু আমিনুলের যে বউ-ছেলে রয়েছে তা আর জানতে পারেনি ঝুমা। কী করবেন ভেবে না পেয়ে বাবার সংসারে বসেই সম্পর্ক চালিয়ে নেন। কিন্তু দুই বছর যেতেই আমিনুল ঝুমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। একটি মেয়ে সন্তান আসে তাদের সংসারে। আরো দুই বছর অপেক্ষা করে মেয়ের জীবন এবং নিজের মোহরানার টাকা আদায়ে কোর্টে মামলা করেন। বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
সমাপ্তি ঘটে তাদের সংসারের। এরকম বহু ঘটনা শুনতে পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত। গবেষকদের দাবি, মাঝরাতে অতিরিক্ত সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কমে যাচ্ছে। যার ফলে সম্পর্ক টিকছে না। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২৪ হাজার ইউরোপিয়ান দম্পতিকে নিয়ে এই গবেষণা করেছেন। গবেষণায় তারা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের ব্যবহার ও বৈবাহিক জীবনের তুষ্টির মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি ধরতে পেরেছেন বলে দাবি করেছেন। সামপ্রতিক আরেক এক গবেষণায় একটি বিষয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আর তা হচ্ছে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টিকে হালকা করে দিচ্ছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। এ ছাড়াও পরস্পরের কাছ থেকে চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে না।
একারণে সম্পর্ক ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার কোনো অংশে কম নয় বরং ইউরোপ থেকে আরো বেশি বলে জানিয়েছেন আমাদের দেশের সমাজ বিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, আধুনিক যুগে মানুষ একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করছে না। আরেকদিকে কেউ কাউকে বাধা দিতে পারছে না। মোবাইল ফোন আমাদের কাজ সহজ করেছে। মোবাইল ফোনটা আজকাল ভিন্নদিকে যাচ্ছে। এখানে কথা বলার বাইরেও মোবাইলে ফেসবুক, ইউটিউবসহ আরো একাধিক সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বেড়ে গেছে। ইদানীং এ কারণে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে বাবা-মা ছোটবেলা থেকে সন্তানদের যে মানুষ করবে সে মানসিকতা এখন নেই। তারা যে শাসন করবে, সেটা তারা করতে পারছে না। এখন বাবা-মা’রাই নোংরা পথে চলে যাচ্ছে। তাহলে সন্তানরা তো যাবেই। তিনি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, আমার বিবেক যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমি যা মনে চায় তাই করতে পারি। মোবাইল ফোনে যে অন্যায়গুলো হচ্ছে এটার কোনো শাস্তিও দেয়া হচ্ছে না। পরিবারের ভাঙন কীভাবে ঠেকাবে যদি তারা এর অপব্যবহার করে। তিনি মোবাইলের কারণে সংসার ভাঙার তিনটি মূল কারণ উল্লেখ করে বলেন, মানুষের বিবেক, ছেলেমেয়েদের নৈতিক শাসন না করা এবং মোবাইল ফোন দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করা।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ভারপ্রাপ্ত খতিব মাওলানা মহিউদ্দিন কাশেম বলেন, যেকোনো প্রযুক্তির অপব্যবহার ইসলামে অবৈধ। আর এ অপব্যবহার হলে সংসার ভাঙাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হবে। এখন মোবাইলে শুধু সংসার ভাঙছেই না, নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফোনে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা দিয়েছে। এটা ভালোর জন্য ব্যবহার না করে আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণী থেকে যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এটা বন্ধ করতে হলে পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষায় জোর দিতে হবে। এবং সন্তানদের সঠিক জ্ঞান দিতে হবে।
সারাদিনের কাজ শেষে যখন একটু সময় পান তখন স্ত্রীকে ফোন দিলে তেমন একটা পাত্তা দেন না। কথা বলতেও যেন অনাগ্রহ। এক পর্যায়ে শাহরিন তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনেন। একসময় টাকার প্রয়োজন ছাড়া শাহরিন তার স্বামীকে ফোন দিতেন না। বিষয়টা জামালের কাছে খটকা লাগতে থাকে। সন্দেহ করতে থাকেন স্ত্রীর পরিবর্তনে। কিন্তু স্ত্রীকেও তিনি বুঝতে দিতেন না। শাহরিনের হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ হিসেবে তিনি আবিষ্কার করেন অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেমে জড়ানো। তিনি মজেছেন সিয়াম নামে এক তরুণের প্রেমে। শাহরিনের এ প্রেমের সূত্রপাতটা তার মোবাইলে রঙ নম্বরের ফোন দিয়ে।
প্রথমে শাহরিন কথা বলতে না চাইলেও একসময় কথা বলতে শুরু করেন। রাতভর কথা বলতে থাকলেও পরিবারকে জানাতেন স্বামীর সঙ্গে কথা বলি। নিয়মিত কথা বলতে বলতে তার জালে একসময় বিদ্ধ হন তিনি। প্রেমে হাবুডাবু খেতে থাকেন নিজের থেকে কম বয়সী তরুণটির। এদিকে সিয়ামও ধীরে ধীরে শাহরিনের সবকিছু জেনে নেয়। তার একাউন্টে জমানো টাকা থেকে নিজের দুর্বলতা সবকিছু। একসময় সিয়াম শাহরিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন। দুজনে দেখা করেন, মেলামেশা করেন। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখেন প্রতিমুহূর্ত। এদিকে শাহরিন তার সন্তানদের প্রতিও নজর কমিয়ে দেন। ঠিকভাবে খোঁজখবর রাখেন না। শুধু টাকা দিয়েই দায়সারা। জামাল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি দেশে চলে আসেন। স্ত্রীর একাউন্টে ২৫ লাখ টাকা জমা ছিল বলে জানতেন জামাল। কিন্তু এখন তার একাউন্ট দেখছেন ফাঁকা।
এ বিষয়ে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে বিভিন্ন ছুতা দিয়ে এক পর্যায়ে শাহরিন জানিয়ে দেন জামালের সঙ্গে তিনি আর সংসার করবেন না। জামাল টাকার মায়া বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ের কথা ভেবে স্ত্রীকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আসলে জামাল দেশে আসার আগেই শাহরিন সিয়ামের সঙ্গে কাজী অফিসের মাধ্যমে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার আগে থেকেই শারীরিক মেলামেশা করতেন। যেটা গোপনই ছিল। মাঝেমধ্যে সিয়ামের বাড়িতে বেড়াতেও যেতেন। সিয়ামের পরিবার শাহরিনকে ছেলের কুমারী পুত্রবধূ বলে জানতেন। এদিকে শাহরিনের মা-বাবার তো চিন্তার শেষ নেই। বংশের সম্মান, নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা। তার পরিবার নানাভাবে বুঝাতে থাকেন। কিছুতে কিছু হয় না। শেষমেশ তিন সন্তান রেখেই সিয়ামের হাত ধরে পালিয়ে যান শাহরিন। এদিকে সিয়াম তার বাবার নিম্নবিত্ত সংসারে শাহরিনকে বোঝা না বানিয়ে রেখে পাঠিয়ে দেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে। এদিকে জামাল তার সন্তানসহ পড়েন অথৈ সাগরে।
শুধু জামাল আর শাহরিন দম্পতির সংসার নয়। এরকম অনেক পরিবার ভাঙা কিংবা ফাটল ধরার ঘটনা শোনা যায় চারপাশে। এর অধিকাংশ কারণ হচ্ছে মোবাইল ফোন। যোগাযোগের অন্যতম এ ডিভাইসটির সুযোগে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হন। অনেকে আবার শিকার করেন। আর তাতে যোগ দিয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মোবাইল ফোন আমাদের যোগাযোগ বছর-মাস থেকে সেকেন্ডে নিয়ে এসেছে। অপরদিকে এর অপব্যবহার সমাজে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণেই সমাজে পরিবারে ভাঙন শুরু হয়েছে। এটা কখনো স্বামী-স্ত্রীর একজনের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া, কখনো বাসার একমাত্র ছেলে-মেয়েটি অন্য ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া অথবা মোবাইলে সারাদিন পড়ে থাকা। অন্যদিকে আলেমরা বলছেন, মোবাইল ফোন যোগাযোগ অনেক কাছাকাছি করেছে। পাশাপাশি এর ভিন্নদিকও দেখা যায়। এটা নৈতিকতার মারাত্মক অবক্ষয় ঘটিয়েছে। সংসারে ফাটল ধরিয়েছে। তরুণ-তরুণীদের মাঝে অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে আজকাল সংসার ভাঙছে। মোবাইলে অপরিচিতদের সঙ্গে কথোপকথন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই-মেইলের মাধ্যমে সহজেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছে। অপরিচিতদের সঙ্গে নিজের নেতিবাচক জিনিসগুলো শেয়ার করে অন্যের ফাঁদে পড়ে যায় এবং সেই ফাঁদটা যদি কোনো খারাপ পাত্র হয় তাহলে বিষয়টি আরো বিপজ্জনক হয়। মোবাইল বা ফেসবুক কালচারের কু-প্রভাব, এসবে অন্যের ঘাটতিগুলো বেশি দেখা, গুণগুলো না দেখায় এসব মাধ্যম আমাদের বিপদগামী করে। এসব করতে গিয়ে কষ্টগুলো বেড়ে যায়, হতাশা বেড়ে যায়। ফলে অ্যাডজাস্টমেন্টে সমস্যা শুরু হয়। পারিবারিক অশান্তি, কলহ বেড়ে যায়। যার পরিণতি চূড়ান্ত পর্যায় বিবাহ বিচ্ছেদ, হত্যাসহ নানা দুর্ঘটনা। মোবাইল ফোনের কারণে যে, আমাদের পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে তা ফুটে উঠেছে খোদ আমাদের প্রেসিডেন্টের কথায়। ৪ঠা এপ্রিল খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) তৃতীয় সমাবর্তনে তিনি বলেন, এখন মোবাইল ফোন নিয়ে সবাই ব্যস্ত।
এ কারণে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তি উন্নয়নের সহায়ক। তবে এই প্রযুক্তি যেন সর্বনাশের কারণ না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন সেদিন তিনি। ইতিবাচক পরিবর্তন ও মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানোর মধ্যেই প্রযুক্তির সার্থকতা নিহিত বলে প্রেসিডেন্ট মনে করেন।
পাঁচবছর আগের ঘটনা। এইচএসসি পড়ুয়া ঝুমা বেগম। তিন ভাই বিদেশে থাকায় ঘরের মোবাইল ফোন তার কাছেই থাকতো। হঠাৎ একদিন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। আমিনুল নামে একজন ভাইয়ের বন্ধু পরিচয়ে কথা বলেন। এরপর নিয়মিত কথা হতো। একসময় তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন প্রেমের সম্পর্কে। এক পর্যায়ে বিবাহ হয় আমিনুল-ঝুমার। কিন্তু আমিনুলের যে বউ-ছেলে রয়েছে তা আর জানতে পারেনি ঝুমা। কী করবেন ভেবে না পেয়ে বাবার সংসারে বসেই সম্পর্ক চালিয়ে নেন। কিন্তু দুই বছর যেতেই আমিনুল ঝুমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। একটি মেয়ে সন্তান আসে তাদের সংসারে। আরো দুই বছর অপেক্ষা করে মেয়ের জীবন এবং নিজের মোহরানার টাকা আদায়ে কোর্টে মামলা করেন। বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
সমাপ্তি ঘটে তাদের সংসারের। এরকম বহু ঘটনা শুনতে পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত। গবেষকদের দাবি, মাঝরাতে অতিরিক্ত সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কমে যাচ্ছে। যার ফলে সম্পর্ক টিকছে না। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২৪ হাজার ইউরোপিয়ান দম্পতিকে নিয়ে এই গবেষণা করেছেন। গবেষণায় তারা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের ব্যবহার ও বৈবাহিক জীবনের তুষ্টির মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি ধরতে পেরেছেন বলে দাবি করেছেন। সামপ্রতিক আরেক এক গবেষণায় একটি বিষয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আর তা হচ্ছে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টিকে হালকা করে দিচ্ছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। এ ছাড়াও পরস্পরের কাছ থেকে চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে না।
একারণে সম্পর্ক ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার কোনো অংশে কম নয় বরং ইউরোপ থেকে আরো বেশি বলে জানিয়েছেন আমাদের দেশের সমাজ বিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, আধুনিক যুগে মানুষ একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করছে না। আরেকদিকে কেউ কাউকে বাধা দিতে পারছে না। মোবাইল ফোন আমাদের কাজ সহজ করেছে। মোবাইল ফোনটা আজকাল ভিন্নদিকে যাচ্ছে। এখানে কথা বলার বাইরেও মোবাইলে ফেসবুক, ইউটিউবসহ আরো একাধিক সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বেড়ে গেছে। ইদানীং এ কারণে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে বাবা-মা ছোটবেলা থেকে সন্তানদের যে মানুষ করবে সে মানসিকতা এখন নেই। তারা যে শাসন করবে, সেটা তারা করতে পারছে না। এখন বাবা-মা’রাই নোংরা পথে চলে যাচ্ছে। তাহলে সন্তানরা তো যাবেই। তিনি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, আমার বিবেক যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমি যা মনে চায় তাই করতে পারি। মোবাইল ফোনে যে অন্যায়গুলো হচ্ছে এটার কোনো শাস্তিও দেয়া হচ্ছে না। পরিবারের ভাঙন কীভাবে ঠেকাবে যদি তারা এর অপব্যবহার করে। তিনি মোবাইলের কারণে সংসার ভাঙার তিনটি মূল কারণ উল্লেখ করে বলেন, মানুষের বিবেক, ছেলেমেয়েদের নৈতিক শাসন না করা এবং মোবাইল ফোন দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করা।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ভারপ্রাপ্ত খতিব মাওলানা মহিউদ্দিন কাশেম বলেন, যেকোনো প্রযুক্তির অপব্যবহার ইসলামে অবৈধ। আর এ অপব্যবহার হলে সংসার ভাঙাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হবে। এখন মোবাইলে শুধু সংসার ভাঙছেই না, নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফোনে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা দিয়েছে। এটা ভালোর জন্য ব্যবহার না করে আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণী থেকে যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এটা বন্ধ করতে হলে পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষায় জোর দিতে হবে। এবং সন্তানদের সঠিক জ্ঞান দিতে হবে।
No comments