পৌরসভা নির্বাচন ও জনরায় by আসিফ নজরুল
নির্বাচন
এলে আমাদের মধ্যে উৎসবের আমেজ চলে আসে। সঙ্গে থাকে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর
জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচনে সব দল অংশ নিল কি না, নির্বাচনের আগে সবার জন্য
সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলো কি না, নির্বাচনের প্রচারণা ঠিকমতো চালানো
গেল কি না—এসব উৎকণ্ঠা থাকে প্রায় সব নির্বাচনে।
আমাদের দেশে এখন নির্বাচনের দিনও শুরু হয় নানা প্রশ্ন নিয়ে। যেমন ভোট দেওয়া গেল কি না, জাল ভোট পড়ল কি না, ভোটারের ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচিত হলেন কি না। প্রশ্ন থাকে নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ঠিক ভূমিকা পালন করল কি না, তা নিয়েও। নির্বাচন হলে আমরা নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজ এসব প্রশ্নে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে একসময় নিরস্ত হই।
কিন্তু গোটা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন, তা-ই থেকে যায় অনেকটা অনালোচিত। প্রশ্নটি হচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে উল্টো সরকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল চেহারা হারিয়ে যাচ্ছে কি না? সংবিধান অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটাই লক্ষ্য থাকে আদতে। তা হচ্ছে জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে শাসনভার অর্পণ করা। তবে আদৌ নির্বাচিত ব্যক্তিরা ঠিকভাবে নির্বাচিত হলেন কি না, তাঁরা জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি কি না, সাংবিধানিক গণতন্ত্র এতে রক্ষা হলো কি না—এসব প্রশ্ন যেন ক্রমেই পরিত্যাজ্য হতে চলেছে সমাজে।
২.
আগামীকাল হতে যাচ্ছে ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন। দলীয় প্রতীকে এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই নির্বাচন হতে পারে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তারও একটি পরীক্ষা। কিন্তু তা আসলে হবে কি না, সন্দেহ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের বহু কারণ ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি জোটের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন সরকারের সঙ্গে জোটে থাকা বেশ কয়েকটি দলের নেতারাও।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য দাবি করেছে যে তারা নিরপেক্ষ। আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছিলেন যে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতি নির্দয়, অন্যদের প্রতি সদয়। নির্বাচন কমিশনের কাছে এই অভিযোগই হয়ে ওঠে নিরপেক্ষতার মাপকাঠি! ক্ষমতাসীন দল এর আগে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি, অন্য সবাই তা করেছিল। তাহলে কি বলা যায় যে এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছিল?
আসলে শুধু কারও অভিযোগ বা অনুযোগ নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে কি হচ্ছে না, তার আলামত পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘটনায়, বিশেষ করে এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া বা নিষ্ক্রিয়তায়। নির্বাচনের আগেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমন কিছু করে বসেছে, তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয় যে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের পর্যাপ্ত তাগিদ, সদিচ্ছা বা সাহস নির্বাচন কমিশনের নেই।
৩.
পৌরসভা নির্বাচন যে দলীয় প্রতীকে হবে বা দ্রুতই হবে—এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই গ্রহণ করে। এরপর নির্বাচন পেছানো ও সেনাবাহিনী মোতায়েনে বিরোধী দলগুলোর দাবি নাকচ করা, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তি প্রদানে অনীহা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা রোধে ব্যর্থতা, নিজস্ব সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা, নারী প্রার্থীদের অবমাননাকর প্রতীক বরাদ্দসহ নানা বিতর্কের জন্ম দেয় নির্বাচন কমিশন।
কমিশন যেসব প্রার্থিতা বাতিল করেছে, তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ফেনী, চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লাসহ কিছু এলাকায় বিএনপি জোটের মনোনীত প্রার্থীদের এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, তা–ও সমালোচিত হয়। ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়ে এবং পরে সেখানে সাংবাদিকদের বেশি সময় অবস্থান না করার নির্দেশ দিয়ে কারচুপিবান্ধব পরিবেশ উৎসাহিত করার দায়ে কমিশন সমালোচিত হয়।
নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন আখ্যায়িত করেছিল বিএনপি। এখন এরশাদও কমিশনের মেরুদণ্ড আছে কি না, তা প্রমাণ করার কথা বলছেন। কমিশনের মেরুদণ্ড নিয়ে সম্ভবত সন্দেহ আছে এডিসি, রিটার্নিং কর্মকর্তা, এসপি, ওসিদেরও। বিভিন্ন অনিয়ম রোধে ব্যর্থতার জন্য নির্বাচন কমিশনের নোটিশের জবাব দেননি তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে, কমিশনও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। একটিমাত্র ক্ষেত্রে সাতক্ষীরার কলারোয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, অথচ অনিয়মের সুবিধাভোগী সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রশ্ন রয়েছে তাদের সৎসাহস নিয়েও। নানা অভিযোগের ভিত্তিতে একপর্যায়ে ২৩ জন মন্ত্রী ও সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ ডিসেম্বর দুজন সাংসদকে সতর্ক করে দিয়েই দায় সেরেছে কমিশন। বিতর্ক রয়েছে যথেষ্ট লোকবল থাকা সত্ত্বেও ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৭৫টি পৌরসভায় নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্ব পালনের ভার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়েও। গত আট বছরের দলীয়করণের পর যেভাবে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সাজানো হয়েছে, তাতে প্রশাসনিক খবরদারিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় ও মামলা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।
৪.
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্ষমতার কোনো হাতবদল হয় না। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মতামত, মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই নির্বাচনের গুরুত্ব নিহিত রয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্রের মধ্যেই।
বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে একটি মাত্র সংসদ, একটি উচ্চ আদালত ও একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার থাকে বলে সেখানে স্থানীয় সরকারের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আগে কখনো এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে মূলত যেসব রাষ্ট্রের সংবিধানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত) এবং যেসব আগেকার সংবিধানের (১৯৩৫, ১৯৫৬ ও ১৯৬২) কিছু বিধান অনুসৃত হয়েছে, সেগুলোও মূলত যুক্তরাষ্ট্রীয় বা ফেডারেল ধারার সংবিধান। ফলে ১৯৭২ সালে এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থার দিকে জোর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তা দেওয়াও হয়েছিল। বাংলাদেশ সংবিধানে অনেকটা নজিরবিহীনভাবে স্থানীয় সরকার বিষয়ে একটি আলাদা চ্যাপ্টার বা অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে জোর দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের শর্ত ছিল এমন একটি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, যা অবশ্যই জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার আদতে কতটুকু শক্তিশালী, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের আমলে কিছু নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারকে বিভিন্নভাবে দুর্বল করা হয় কেন্দ্রীয় সরকার বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও প্রকাশ্যে অবহেলা করা হয় এর জনপ্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র নষ্ট করে। ১৯৯০ সালের পরও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকারকাঠামোতে নির্বাচন না করে সরকার–মনোনীত ব্যক্তিদের অধিষ্ঠিত করা হয়। নির্বাচন যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও কারচুপির আশ্রয় নেওয়া হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়ম নতুন মাত্রা লাভ করে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর। এর কয়েক মাস পরে প্রথম দুটি ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি জোটের বিজয়ের পর পরবর্তী ধাপগুলোতে ব্যাপক কারচুপি করে সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করা হয়। এরপর বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রকাশ্যে ব্যাপকভাবে কারচুপি করা হয়।
নির্বাচনের পরও চলে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন কৌশল। বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠিন মামলা দিয়ে তাঁদের বরখাস্ত করে সরকারদলীয় ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনা আগের যেকোনো আমলের চেয়ে অনেক বেশি হয় এখন। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরও বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের রায় নাকচ করে এভাবেই স্থানীয় প্রশাসনের জনপ্রতিনিধিত্ব ও জনভিত্তিকে আঘাত করা হয়। ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনের পরও যে সেরকমটি হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি?
৫.
আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনরায় প্রতিফলিত করা; বিভিন্ন কৌশলে একে নাকচ করা নয়। নির্বাচনে বিভিন্নভাবে জনগণের রায় বানচাল করার ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড নিয়েই প্রশ্ন উঠবে বিভিন্ন মহলে।
তাই আশা করি, অভাবিতভাবে হলেও আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে দ্রুত।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের দেশে এখন নির্বাচনের দিনও শুরু হয় নানা প্রশ্ন নিয়ে। যেমন ভোট দেওয়া গেল কি না, জাল ভোট পড়ল কি না, ভোটারের ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচিত হলেন কি না। প্রশ্ন থাকে নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ঠিক ভূমিকা পালন করল কি না, তা নিয়েও। নির্বাচন হলে আমরা নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজ এসব প্রশ্নে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে একসময় নিরস্ত হই।
কিন্তু গোটা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন, তা-ই থেকে যায় অনেকটা অনালোচিত। প্রশ্নটি হচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে উল্টো সরকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল চেহারা হারিয়ে যাচ্ছে কি না? সংবিধান অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটাই লক্ষ্য থাকে আদতে। তা হচ্ছে জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে শাসনভার অর্পণ করা। তবে আদৌ নির্বাচিত ব্যক্তিরা ঠিকভাবে নির্বাচিত হলেন কি না, তাঁরা জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি কি না, সাংবিধানিক গণতন্ত্র এতে রক্ষা হলো কি না—এসব প্রশ্ন যেন ক্রমেই পরিত্যাজ্য হতে চলেছে সমাজে।
২.
আগামীকাল হতে যাচ্ছে ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন। দলীয় প্রতীকে এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই নির্বাচন হতে পারে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তারও একটি পরীক্ষা। কিন্তু তা আসলে হবে কি না, সন্দেহ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের বহু কারণ ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি জোটের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন সরকারের সঙ্গে জোটে থাকা বেশ কয়েকটি দলের নেতারাও।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য দাবি করেছে যে তারা নিরপেক্ষ। আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছিলেন যে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতি নির্দয়, অন্যদের প্রতি সদয়। নির্বাচন কমিশনের কাছে এই অভিযোগই হয়ে ওঠে নিরপেক্ষতার মাপকাঠি! ক্ষমতাসীন দল এর আগে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি, অন্য সবাই তা করেছিল। তাহলে কি বলা যায় যে এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছিল?
আসলে শুধু কারও অভিযোগ বা অনুযোগ নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে কি হচ্ছে না, তার আলামত পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘটনায়, বিশেষ করে এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া বা নিষ্ক্রিয়তায়। নির্বাচনের আগেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমন কিছু করে বসেছে, তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয় যে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের পর্যাপ্ত তাগিদ, সদিচ্ছা বা সাহস নির্বাচন কমিশনের নেই।
৩.
পৌরসভা নির্বাচন যে দলীয় প্রতীকে হবে বা দ্রুতই হবে—এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই গ্রহণ করে। এরপর নির্বাচন পেছানো ও সেনাবাহিনী মোতায়েনে বিরোধী দলগুলোর দাবি নাকচ করা, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তি প্রদানে অনীহা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা রোধে ব্যর্থতা, নিজস্ব সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা, নারী প্রার্থীদের অবমাননাকর প্রতীক বরাদ্দসহ নানা বিতর্কের জন্ম দেয় নির্বাচন কমিশন।
কমিশন যেসব প্রার্থিতা বাতিল করেছে, তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ফেনী, চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লাসহ কিছু এলাকায় বিএনপি জোটের মনোনীত প্রার্থীদের এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, তা–ও সমালোচিত হয়। ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়ে এবং পরে সেখানে সাংবাদিকদের বেশি সময় অবস্থান না করার নির্দেশ দিয়ে কারচুপিবান্ধব পরিবেশ উৎসাহিত করার দায়ে কমিশন সমালোচিত হয়।
নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন আখ্যায়িত করেছিল বিএনপি। এখন এরশাদও কমিশনের মেরুদণ্ড আছে কি না, তা প্রমাণ করার কথা বলছেন। কমিশনের মেরুদণ্ড নিয়ে সম্ভবত সন্দেহ আছে এডিসি, রিটার্নিং কর্মকর্তা, এসপি, ওসিদেরও। বিভিন্ন অনিয়ম রোধে ব্যর্থতার জন্য নির্বাচন কমিশনের নোটিশের জবাব দেননি তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে, কমিশনও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। একটিমাত্র ক্ষেত্রে সাতক্ষীরার কলারোয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, অথচ অনিয়মের সুবিধাভোগী সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রশ্ন রয়েছে তাদের সৎসাহস নিয়েও। নানা অভিযোগের ভিত্তিতে একপর্যায়ে ২৩ জন মন্ত্রী ও সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ ডিসেম্বর দুজন সাংসদকে সতর্ক করে দিয়েই দায় সেরেছে কমিশন। বিতর্ক রয়েছে যথেষ্ট লোকবল থাকা সত্ত্বেও ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৭৫টি পৌরসভায় নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্ব পালনের ভার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়েও। গত আট বছরের দলীয়করণের পর যেভাবে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সাজানো হয়েছে, তাতে প্রশাসনিক খবরদারিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় ও মামলা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।
৪.
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্ষমতার কোনো হাতবদল হয় না। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মতামত, মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই নির্বাচনের গুরুত্ব নিহিত রয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্রের মধ্যেই।
বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে একটি মাত্র সংসদ, একটি উচ্চ আদালত ও একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার থাকে বলে সেখানে স্থানীয় সরকারের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আগে কখনো এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে মূলত যেসব রাষ্ট্রের সংবিধানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত) এবং যেসব আগেকার সংবিধানের (১৯৩৫, ১৯৫৬ ও ১৯৬২) কিছু বিধান অনুসৃত হয়েছে, সেগুলোও মূলত যুক্তরাষ্ট্রীয় বা ফেডারেল ধারার সংবিধান। ফলে ১৯৭২ সালে এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থার দিকে জোর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তা দেওয়াও হয়েছিল। বাংলাদেশ সংবিধানে অনেকটা নজিরবিহীনভাবে স্থানীয় সরকার বিষয়ে একটি আলাদা চ্যাপ্টার বা অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে জোর দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের শর্ত ছিল এমন একটি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, যা অবশ্যই জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার আদতে কতটুকু শক্তিশালী, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের আমলে কিছু নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারকে বিভিন্নভাবে দুর্বল করা হয় কেন্দ্রীয় সরকার বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও প্রকাশ্যে অবহেলা করা হয় এর জনপ্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র নষ্ট করে। ১৯৯০ সালের পরও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকারকাঠামোতে নির্বাচন না করে সরকার–মনোনীত ব্যক্তিদের অধিষ্ঠিত করা হয়। নির্বাচন যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও কারচুপির আশ্রয় নেওয়া হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়ম নতুন মাত্রা লাভ করে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর। এর কয়েক মাস পরে প্রথম দুটি ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি জোটের বিজয়ের পর পরবর্তী ধাপগুলোতে ব্যাপক কারচুপি করে সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করা হয়। এরপর বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রকাশ্যে ব্যাপকভাবে কারচুপি করা হয়।
নির্বাচনের পরও চলে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন কৌশল। বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠিন মামলা দিয়ে তাঁদের বরখাস্ত করে সরকারদলীয় ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনা আগের যেকোনো আমলের চেয়ে অনেক বেশি হয় এখন। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরও বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের রায় নাকচ করে এভাবেই স্থানীয় প্রশাসনের জনপ্রতিনিধিত্ব ও জনভিত্তিকে আঘাত করা হয়। ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনের পরও যে সেরকমটি হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি?
৫.
আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনরায় প্রতিফলিত করা; বিভিন্ন কৌশলে একে নাকচ করা নয়। নির্বাচনে বিভিন্নভাবে জনগণের রায় বানচাল করার ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড নিয়েই প্রশ্ন উঠবে বিভিন্ন মহলে।
তাই আশা করি, অভাবিতভাবে হলেও আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে দ্রুত।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments