বিএনপির আন্দোলনে শুরু, নির্বাচনে শেষ
বছরের
শুরুতে ৫ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মুখোমুখি হয়
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ৫ই জানুয়ারিকে আওয়ামী লীগ অভিহিত করে গণতন্ত্র
মুক্তি দিবস হিসেবে। আর বিএনপি একে আখ্যায়িত করে গণতন্ত্রের হত্যা দিবস
হিসেবে। শুরু হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতাল।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অবরোধ-হরতাল মোকাবিলায় মাঠে নামার ঘোষণা
দেন। তবে, ঘোষণা অনুযায়ী মাঠে সক্রিয় ছিল না আওয়ামী লীগের তৃণমূল।
শুধুমাত্র ঢাকায় সভা-সমাবেশেই সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি দলের কার্যক্রম। সংলাপ ও
নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের টানা অবরোধ-হরতালের
মুখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা মূলত ঢাকাতেই
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সারা দেশে তৃণমূলে দলটির চেহারা ছিল ভিন্ন। বিএনপির
সহিংস আন্দোলন মোকাবিলায় জেলা-উপজেলায় দৃশ্যমান তেমন কোন সাংগঠনিক তৎপরতা
ছিল না। কেন্দ্র থেকে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় থেকে আন্দোলন
মোকাবিলায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে থাকার নির্দেশ দেয়া হলেও সংসদ
সদস্যদের পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। ফলে আন্দোলন
মোকাবিলায় অনেকটাই নিষপ্রাণ ছিল আওয়ামী লীগ। এছাড়া, বিএনপি-জামায়াতের
নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৪ দলের
নেতাদের সমন্বয়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হলেও দেশের
অধিকাংশ জেলা- উপজেলায় কমিটি গঠন হয়নি। ফলে, নেতাকর্মীরাও গড়ে তুলতে
পারেননি পাল্টা প্রতিরোধ। যে কারণে বছরজুড়েই পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভর হয়ে
পড়ে আওয়ামী লীগ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২০দলীয় জোটের অবরোধ ও হরতাল
অব্যাহত থাকলেও এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলন, বক্তব্য-বিবৃতি
ছাড়া আওয়ামী লীগের দলীয় তেমন কোন কর্মসূচি ছিল না। উপরন্তু নানা ঘটনা-রটনায়
আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতারা ছিলেন আলোচনা ও সমালোচনায়।
এছাড়া, দলের উপদেষ্টা, নেতা ও মন্ত্রীদের নানা বেফাঁস মন্তব্যের কারণে
বছরের প্রায় সময়ই আওয়ামী লীগ ও সরকারকে বিব্রত হতে হয়েছে।
এদিকে বছরজুড়েই আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল অব্যাহত। এতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে নিয়মিত। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশজুড়ে ছিলেন বেপরোয়া। তুচ্ছ কারণে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, সংঘাত ও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন তারা নিয়মিতই। রাজধানী থেকে তৃণমূল সবখানেই ছিল একই অবস্থা। নিজেদের মধ্যে নিয়মিতই সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ছিল বেপরোয়া। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও রক্ত ঝরেছে নিয়মিত। ঘটেছে হতাহতের ঘটনাও। ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দলীয় পদ-পদবি নিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে বিদায়ী বছরে রক্তক্ষরণ হয়েছে আওয়ামী লীগে। রাজধানী থেকে তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন নিজ দলের নেতাকর্মীরা।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষে অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। বিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্বের জের ধরে সারা দেশে ১শ’র বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন হাজারের বেশি নেতাকর্মী। এমনকি শোকের মাস আগস্টেও থেমে থাকেনি সংঘাত ও সংঘর্ষ। আগস্টেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সহিংস ঘটনার ধারাবাহিকতা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেননি আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ মাসেও সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বেশক’জন নেতাকর্মী নিজ দলেরই প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। দ্বন্দ্ব ও কোন্দল নিরসনে বিগত বছরে দলের তরফে বার বার উদ্যোগ নেয়া হলেও দলীয় কোন্দল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও খুনোখুনি নিরসন করা যায়নি কিছুতেই। তবে, নিজেদের দলীয় কোন্দল ও দ্বন্দ্বের জের ধরে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে-এমন বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা। সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাগুলোকে তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন।
এদিকে বছরজুড়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও তাদের সন্তানদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং শীর্ষ নেতাদের অযাচিত বক্তব্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন সময়ে তারা এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্যও রাখেন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা একটি মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০০৯ সালের ২৫শে মে হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি। ২০১০ সালের ২৭শে অক্টোবর সাজার রায় বাতিল করেন হাইকোর্ট। দুদক এর বিরুদ্ধে আপিল করলে গত ১৪ই জুন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে এ বিষয়ে হাইকোর্টে পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন। এতে করে সংবিধান অনুযায়ী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর পদে থাকা বৈধ কি-না এ প্রশ্ন দেখা দেয়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জড়িয়ে পড়েন ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পচা ও পোকায় খাওয়া ‘গম’ কেলেঙ্কারিতে। এছাড়া, মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পিনু খানের পুত্র বখতিয়ার আলম রনির আলোচিত জোড়া খুনের ঘটনাও আলোচিত ছিল বছরজুড়ে। নিজেদের দলের শীর্ষ নেতাদের এহেন কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। শোকের মাস আগস্টে সরকারের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)কে জড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিমের একটি মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা- সমালোচনার ঝড় তোলে। তিনি বলেন, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এর দুদিন পর দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও প্রায় একই বক্তব্য দেন। এমন ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনা- সমালোচনার ঝড় উঠে। সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে। তবে, জাসদকে নিয়ে এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ শীর্ষ নেতারা।
২০১৫ সালে আলোচনায় ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনসহ ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই কাউন্সিল সম্পন্নের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শীর্ষ নেতারা। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তারা আশা করেছিলেন ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল। এ লক্ষ্যে সারা দেশের সাংগঠনিক জেলাগুলোর কাউন্সিল সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয় সরকারি দল। নেতারা জানিয়েছিলেন সারা দেশের কাউন্সিল সম্পন্ন করে ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে, বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগের অর্ধেকের বেশি জেলার কাউন্সিল সম্পন্ন হলেও সেই আকাঙ্ক্ষিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আর হয়নি। এ জন্য পৌরসভা নির্বাচন ও সাংগঠনিক সকল জেলার কাউন্সিল না হওয়াই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের অনেকে।
বছরের শেষদিকে এসে পৌরসভা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয় সরকারের তরফে। এ লক্ষ্যে শুরু হয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া। ২৩৫ পৌরসভায় একক ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। জেলা, উপজেলা ও পৌরসভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে তৃণমূল থেকে নাম পাঠানো হয় কেন্দ্রে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেনি। অভিযোগ ছিল বিভিন্ন পৌরসভায় স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীদের প্রভাব ও প্রত্যক্ষ মদতে জেলা- উপজেলার নেতারা নিজেদের পছন্দের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এছাড়া, মনোনয়ন নিয়ে অর্থ বাণিজ্যের পাশাপাশি স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। ২৩৫ পৌরসভায় একক প্রার্থী বাছাইয়ের পর দেখা যায় বিভিন্ন পৌরসভায় অনেক প্রার্থী মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচয়ে পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও বিদ্রোহীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের হুমকিসহ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয় তাদের। কারণ দর্শাও নোটিশের পাশাপাশি কোন কোন পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারও করা হয়। এতকিছুর পরও দমিয়ে রাখা যায়নি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী পৌর নির্বাচনে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে ছিলেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ দু’ভাগে ভাগ হলেও বিদায়ী বছরে হয়নি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি। চলতি বছরের ২৭শে ডিসেম্বর সম্মেলন হওয়ার পর ৩ বছর পার করলো মহানগর আওয়ামী লীগের পুরনো কমিটি। বছরের শুরু থেকেই মহানগর কমিটি হচ্ছে, হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু এর প্রতিফলন দেখা যায়নি বাস্তবে। ফলে, সারা বছরই হতাশা কাজ করেছে মহানগর কমিটির নেতা এবং থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনে। বিভিন্ন সময়ে নেতাকর্মীরা হতাশা প্রকাশ করে জানান, কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলীয় কোন্দল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যে কারণে রাজধানীর দলীয় কার্যক্রমও বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এদিকে বছরজুড়েই আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল অব্যাহত। এতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে নিয়মিত। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশজুড়ে ছিলেন বেপরোয়া। তুচ্ছ কারণে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, সংঘাত ও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন তারা নিয়মিতই। রাজধানী থেকে তৃণমূল সবখানেই ছিল একই অবস্থা। নিজেদের মধ্যে নিয়মিতই সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ছিল বেপরোয়া। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও রক্ত ঝরেছে নিয়মিত। ঘটেছে হতাহতের ঘটনাও। ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দলীয় পদ-পদবি নিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে বিদায়ী বছরে রক্তক্ষরণ হয়েছে আওয়ামী লীগে। রাজধানী থেকে তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন নিজ দলের নেতাকর্মীরা।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষে অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। বিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্বের জের ধরে সারা দেশে ১শ’র বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন হাজারের বেশি নেতাকর্মী। এমনকি শোকের মাস আগস্টেও থেমে থাকেনি সংঘাত ও সংঘর্ষ। আগস্টেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সহিংস ঘটনার ধারাবাহিকতা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেননি আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ মাসেও সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বেশক’জন নেতাকর্মী নিজ দলেরই প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। দ্বন্দ্ব ও কোন্দল নিরসনে বিগত বছরে দলের তরফে বার বার উদ্যোগ নেয়া হলেও দলীয় কোন্দল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও খুনোখুনি নিরসন করা যায়নি কিছুতেই। তবে, নিজেদের দলীয় কোন্দল ও দ্বন্দ্বের জের ধরে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে-এমন বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা। সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাগুলোকে তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন।
এদিকে বছরজুড়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও তাদের সন্তানদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং শীর্ষ নেতাদের অযাচিত বক্তব্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন সময়ে তারা এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্যও রাখেন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা একটি মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০০৯ সালের ২৫শে মে হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি। ২০১০ সালের ২৭শে অক্টোবর সাজার রায় বাতিল করেন হাইকোর্ট। দুদক এর বিরুদ্ধে আপিল করলে গত ১৪ই জুন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে এ বিষয়ে হাইকোর্টে পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন। এতে করে সংবিধান অনুযায়ী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর পদে থাকা বৈধ কি-না এ প্রশ্ন দেখা দেয়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জড়িয়ে পড়েন ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পচা ও পোকায় খাওয়া ‘গম’ কেলেঙ্কারিতে। এছাড়া, মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পিনু খানের পুত্র বখতিয়ার আলম রনির আলোচিত জোড়া খুনের ঘটনাও আলোচিত ছিল বছরজুড়ে। নিজেদের দলের শীর্ষ নেতাদের এহেন কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। শোকের মাস আগস্টে সরকারের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)কে জড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিমের একটি মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা- সমালোচনার ঝড় তোলে। তিনি বলেন, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এর দুদিন পর দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও প্রায় একই বক্তব্য দেন। এমন ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনা- সমালোচনার ঝড় উঠে। সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে। তবে, জাসদকে নিয়ে এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ শীর্ষ নেতারা।
২০১৫ সালে আলোচনায় ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনসহ ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই কাউন্সিল সম্পন্নের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শীর্ষ নেতারা। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তারা আশা করেছিলেন ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল। এ লক্ষ্যে সারা দেশের সাংগঠনিক জেলাগুলোর কাউন্সিল সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয় সরকারি দল। নেতারা জানিয়েছিলেন সারা দেশের কাউন্সিল সম্পন্ন করে ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে, বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগের অর্ধেকের বেশি জেলার কাউন্সিল সম্পন্ন হলেও সেই আকাঙ্ক্ষিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আর হয়নি। এ জন্য পৌরসভা নির্বাচন ও সাংগঠনিক সকল জেলার কাউন্সিল না হওয়াই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের অনেকে।
বছরের শেষদিকে এসে পৌরসভা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয় সরকারের তরফে। এ লক্ষ্যে শুরু হয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া। ২৩৫ পৌরসভায় একক ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। জেলা, উপজেলা ও পৌরসভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে তৃণমূল থেকে নাম পাঠানো হয় কেন্দ্রে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেনি। অভিযোগ ছিল বিভিন্ন পৌরসভায় স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীদের প্রভাব ও প্রত্যক্ষ মদতে জেলা- উপজেলার নেতারা নিজেদের পছন্দের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এছাড়া, মনোনয়ন নিয়ে অর্থ বাণিজ্যের পাশাপাশি স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। ২৩৫ পৌরসভায় একক প্রার্থী বাছাইয়ের পর দেখা যায় বিভিন্ন পৌরসভায় অনেক প্রার্থী মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচয়ে পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও বিদ্রোহীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের হুমকিসহ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয় তাদের। কারণ দর্শাও নোটিশের পাশাপাশি কোন কোন পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারও করা হয়। এতকিছুর পরও দমিয়ে রাখা যায়নি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী পৌর নির্বাচনে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে ছিলেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ দু’ভাগে ভাগ হলেও বিদায়ী বছরে হয়নি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি। চলতি বছরের ২৭শে ডিসেম্বর সম্মেলন হওয়ার পর ৩ বছর পার করলো মহানগর আওয়ামী লীগের পুরনো কমিটি। বছরের শুরু থেকেই মহানগর কমিটি হচ্ছে, হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু এর প্রতিফলন দেখা যায়নি বাস্তবে। ফলে, সারা বছরই হতাশা কাজ করেছে মহানগর কমিটির নেতা এবং থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনে। বিভিন্ন সময়ে নেতাকর্মীরা হতাশা প্রকাশ করে জানান, কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলীয় কোন্দল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যে কারণে রাজধানীর দলীয় কার্যক্রমও বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
No comments