রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো
একটি রাষ্ট্র, তার ভৌগোলিক আকার ও জনসংখ্যা যা-ই হোক, একটি মস্ত বড়
জিনিস। মানবদেহের মতো তারও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। শুধু হাত আর পা থাকলেই
একজন মানুষকে সুস্থ মানুষ বলা যায় না। তার চোখ, কান, হৃদ্যন্ত্র, কিডনি,
লিভার প্রভৃতি ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তার ওপর নির্ভর করছে মানুষটি
সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক কি না। দেহযন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন,
রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষেত্রেও তা-ই। শুধু নির্বাহী বিভাগ নয়, আইন বিভাগ, বিচার
বিভাগসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান
যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করলে সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র নড়বড়ে ও দুর্বল হয়ে
যায়।
সাত বছর যাবৎ বাংলাদেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে, এটা একটা ইতিবাচক দিক। যেভাবেই নির্বাচিত হোক, একটি সংবিধানসম্মত সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও বাস্তবায়িত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন ফোরামে অংশ নিচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা উঠছে কেন? গত দুই বছরে পত্রপত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই অপরিণত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংশোধনে বাস্তবসম্মত ও বলিষ্ঠ কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিনির্মাণে শুধু সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে তা নয়, সরকারের বাইরের রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
রাষ্ট্র পরিচালনা করে প্রধানত নির্বাহী বিভাগ, যার অধীনে থাকে প্রশাসন। প্রশাসন পরিচালিত হয় স্থায়ী আমলাতন্ত্র দ্বারা। কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নাম শুনলেই আজকাল অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করেন। তাঁদের মতামতকে ফেলে দেওয়ার জন্য শক্তিশালী যুক্তি এখনো পর্যন্ত দুর্লভ। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ শীর্ষক রচনায় বলেছেন, ‘যেহেতু রাষ্ট্রের আবির্ভাব শ্রেণি বিরোধকে সংহত করার প্রয়োজন থেকে, সেই সঙ্গে তার উদ্ভব হয় শ্রেণি বিরোধের মধ্যেই, সেই জন্য রাষ্ট্র হলো সাধারণত সবচেয়ে শক্তিশালী ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেণির রাষ্ট্র; এই শ্রেণি রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাজনীতির ক্ষেত্রেও আধিপত্যকারী শ্রেণি হয়ে ওঠে; এবং তার ফলে দুর্বল ও নিপীড়িত শ্রেণির দমন এবং তার শোষণে নতুন হাতিয়ার লাভ করে। এভাবে প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র ছিল প্রধানত ক্রীতদাস দমনের জন্য দাস-মালিকদের রাষ্ট্র, যেমন সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল ভূমিদাস কৃষকদের বশে রাখার জন্য অভিজাতদের সংস্থা। বর্তমানে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হচ্ছে পুঁজি কর্তৃক মজুরি শ্রম শোষণের হাতিয়ার।...অধিকাংশ রাষ্ট্রেই দেখা যায়, নাগরিকদের অধিকার নির্ধারিত হয় ধনসম্পত্তির অনুপাতে,...রাষ্ট্র হচ্ছে বিত্তহীন শ্রেণির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিত্তশীল শ্রেণির একটি সংগঠন।’
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। যদিও সব গণতান্ত্রিক দেশেই পার্লামেন্টকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। যদিও তার সেই ক্ষমতাও নির্বাহী বিভাগের আমলাদের মাধ্যমেই প্রয়োগ হয়ে থাকে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে নির্বাহী বিভাগ যদি অন্যায় করে, ভুল করে অথবা থাকে তার দুর্বলতা, তার প্রতিবিধান করবে কে? আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগের ওপর নজরদারির জন্য বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিচার বিভাগ রয়েছে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকটির সঙ্গে যদি রাষ্ট্র অবিচার করে, বিচার বিভাগ দুর্বলের পক্ষে রায় দিয়ে রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে থাকে। তা ছাড়া রাষ্ট্রে রয়েছে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যেমন নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। যেমন মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন। এসবই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অতি আবশ্যকীয় অংশ। এগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা কাজ এবং প্রতিটিই অন্যগুলোর সঙ্গে যুক্ত, যেমন মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী না করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাধারণ নাগরিকেরা ন্যায়বিচার ও সুশাসন আশা করতে পারে না।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে সম্ভাব্য ক্ষতি ডেকে আনার কাজটি সরকার কেন করতে যাবে? তা করার কথা নির্বাচন কমিশনের। সে ক্ষমতা সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে। জেলা প্রশাসক হোন, পুলিশ সুপার হোন বা কোনো জনপ্রতিনিধিই হোন, তাঁরা যখন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবেন? নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা হোন বা যেকোনো ক্ষমতাবান হোন, নির্বাচনকেন্দ্রে বসে ব্যালট পেপারে কারও পক্ষে যদি সিল মারতে থাকেন, তাঁকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তা যখন তারা করে না, তখন তারা জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বিশ্বাসঘাতক মানুষকে দিয়ে ভালো রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
রাষ্ট্র চলে যে অর্থে, রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, তাঁদের আরামদায়ক বাড়ি-গাড়ির ব্যয়, তার প্রতিটি পয়সাই জনগণের; সরকারি দলের তহবিল থেকে আসে না। ওই অর্থের অপব্যবহার করার অধিকার রাষ্ট্রের কারও নেই। এবং সরকারি অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, তা তদারকের জন্য রয়েছেন মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ। অতি গুরুদায়িত্ব তাঁর। তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সংবিধান বলে দিয়েছে:
‘মহা হিসাব নিরীক্ষক প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব এবং সকল আদালত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি হিসাব নিরীক্ষা করিবেন এবং অনুরূপ হিসাব সম্পর্কে রিপোর্ট দান করিবেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি কিংবা সেই প্রয়োজনে তাঁহার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তির দখলভুক্ত সকল নথি, বহি, রসিদ, দলিল, নগদ অর্থ, স্ট্যাম্প, জামিন, ভান্ডার বা অন্য প্রকার সরকারি সম্পত্তি পরীক্ষার অধিকারী হইবেন।’
সরকারি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা তাঁরা করছেনও। মহা হিসাব নিরীক্ষক তাঁর বার্ষিক রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি সেটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংসদে পাঠিয়ে দেন। সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, যা সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কমিটি, ওই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়। ব্রিটেন, ভারতসহ পৃথিবীর সংসদীয় গণতান্ত্রিক সব দেশেই মহা হিসাব নিরীক্ষকের রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। সাধারণত পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হন বিরোধী দলের নেতা। কমিটিতে কোনো মন্ত্রী থাকেন না। মহা হিসাব নিরীক্ষকের অফিস ঠিকমতো কাজ করলে সরকারি অফিসে চুরি, অপচয়, দুর্নীতি প্রভৃতি যথেষ্ট পরিমাণে কমে যেতে পারে। কিন্তু বহু শিক্ষিত মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, মহা হিসাব নিরীক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে শুধু নয়, তাঁর পদটি সম্পর্কেই তাঁদের ধারণা নেই। মহা হিসাব নিরীক্ষক এবং সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি অন্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো যদি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করত, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ বারো আনা কমে যেত।
আমাদের সংবিধান বলেছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে’ এবং ‘কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্মকমিশন। এই কমিশনের প্রধানতম দায়িত্ব হলো ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদিগকে মনোনয়নের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনা’ করা। সংবিধান এ কথা বলেনি যে পরীক্ষার্থীদের ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস করিবার অধিকারও তাহাদের থাকিবে’। রাষ্ট্রে একটি দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভূমিকাই প্রধান। সরকারি দলের নিম্ন মেধার ও অযোগ্য ক্যাডারদের নিয়োগ দিলে একসময় প্রশাসন ভেঙে পড়বে। আমরা এখনো পর্যন্ত যা দেখে এসেছি, তাতে বলা যায়, দলীয়করণের কারণে যোগ্যতর ও মেধাবীদের অনেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছেন না। গরিব-মেধাবী তরুণেরা হতাশ। রাষ্ট্রীয় নিয়োগে বিপুল অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন হয়। এই প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে একসময় রাষ্ট্র দুর্বল এমনকি অকার্যকর হয়ে পড়বে।
দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন আগে ছিল না। বর্তমানে এ দুটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। দুদক সম্পর্কে সাবেক এক চেয়ারম্যান নিজেই বলেছিলেন, এটি ‘নখদন্তহীন বাঘ’। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সদিচ্ছা ছাড়া দুদকের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করা অসম্ভব। যদিও গত তিন-চার বছরে বেশ কয়েকজন ক্ষমতাশালীকে তাদের অফিসে তলব করেছে এবং অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু যেভাবে দুদক এখন কাজ করছে, এই গতিতে চললে দেশে দুর্নীতি বাড়বে ছাড়া কমার সম্ভাবনা কম।
মানবাধিকার কমিশনের মিডিয়া প্রচার ছাড়া সাবলীল ভূমিকা এখনো দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। অথচ অসহায় ও দুর্বলের প্রধান সহায়ক হওয়ার কথা মানবাধিকার কমিশন। বরং বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলো দুর্বলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কাজ করছে। আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলের পাশে মিডিয়া ছাড়া দাঁড়ানোর কেউ নেই। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সংখ্যালঘু নৃজাতি, নারী এবং শিশুর ওপর প্রবলের আঘাতকে প্রত্যাঘাত করার জন্য যেসব সংস্থা দায়বদ্ধ, তাদের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। বিরোধী নেতা-কর্মীর অপহরণ, গুম, হত্যা প্রভৃতির সঙ্গে রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে তাঁদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের কথা, সেগুলোর ওপর মানুষের আস্থার সৃষ্টি হয়নি। সবচেয়ে বেদনাদায়ক যা তা হলো নাগরিক সমাজের যেসব সংগঠন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার, সেগুলোর কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে খুবই কঠোরভাবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, দুর্নীতি ও মানবাধিকার নিয়ে দেশে ও বিদেশে সমালোচনা ও উদ্বেগের ঘাটতি নেই। গত দুই-আড়াই বছরে তার মাত্রা বেড়েছে। সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে বাধাহীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব। আশা করি নতুন বছরে জাতীয় এজেন্ডায় এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
সাত বছর যাবৎ বাংলাদেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে, এটা একটা ইতিবাচক দিক। যেভাবেই নির্বাচিত হোক, একটি সংবিধানসম্মত সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও বাস্তবায়িত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন ফোরামে অংশ নিচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা উঠছে কেন? গত দুই বছরে পত্রপত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই অপরিণত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংশোধনে বাস্তবসম্মত ও বলিষ্ঠ কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিনির্মাণে শুধু সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে তা নয়, সরকারের বাইরের রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
রাষ্ট্র পরিচালনা করে প্রধানত নির্বাহী বিভাগ, যার অধীনে থাকে প্রশাসন। প্রশাসন পরিচালিত হয় স্থায়ী আমলাতন্ত্র দ্বারা। কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নাম শুনলেই আজকাল অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করেন। তাঁদের মতামতকে ফেলে দেওয়ার জন্য শক্তিশালী যুক্তি এখনো পর্যন্ত দুর্লভ। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ শীর্ষক রচনায় বলেছেন, ‘যেহেতু রাষ্ট্রের আবির্ভাব শ্রেণি বিরোধকে সংহত করার প্রয়োজন থেকে, সেই সঙ্গে তার উদ্ভব হয় শ্রেণি বিরোধের মধ্যেই, সেই জন্য রাষ্ট্র হলো সাধারণত সবচেয়ে শক্তিশালী ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেণির রাষ্ট্র; এই শ্রেণি রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাজনীতির ক্ষেত্রেও আধিপত্যকারী শ্রেণি হয়ে ওঠে; এবং তার ফলে দুর্বল ও নিপীড়িত শ্রেণির দমন এবং তার শোষণে নতুন হাতিয়ার লাভ করে। এভাবে প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র ছিল প্রধানত ক্রীতদাস দমনের জন্য দাস-মালিকদের রাষ্ট্র, যেমন সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল ভূমিদাস কৃষকদের বশে রাখার জন্য অভিজাতদের সংস্থা। বর্তমানে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হচ্ছে পুঁজি কর্তৃক মজুরি শ্রম শোষণের হাতিয়ার।...অধিকাংশ রাষ্ট্রেই দেখা যায়, নাগরিকদের অধিকার নির্ধারিত হয় ধনসম্পত্তির অনুপাতে,...রাষ্ট্র হচ্ছে বিত্তহীন শ্রেণির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিত্তশীল শ্রেণির একটি সংগঠন।’
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। যদিও সব গণতান্ত্রিক দেশেই পার্লামেন্টকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। যদিও তার সেই ক্ষমতাও নির্বাহী বিভাগের আমলাদের মাধ্যমেই প্রয়োগ হয়ে থাকে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে নির্বাহী বিভাগ যদি অন্যায় করে, ভুল করে অথবা থাকে তার দুর্বলতা, তার প্রতিবিধান করবে কে? আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগের ওপর নজরদারির জন্য বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিচার বিভাগ রয়েছে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকটির সঙ্গে যদি রাষ্ট্র অবিচার করে, বিচার বিভাগ দুর্বলের পক্ষে রায় দিয়ে রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে থাকে। তা ছাড়া রাষ্ট্রে রয়েছে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যেমন নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। যেমন মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন। এসবই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অতি আবশ্যকীয় অংশ। এগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা কাজ এবং প্রতিটিই অন্যগুলোর সঙ্গে যুক্ত, যেমন মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী না করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাধারণ নাগরিকেরা ন্যায়বিচার ও সুশাসন আশা করতে পারে না।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে সম্ভাব্য ক্ষতি ডেকে আনার কাজটি সরকার কেন করতে যাবে? তা করার কথা নির্বাচন কমিশনের। সে ক্ষমতা সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে। জেলা প্রশাসক হোন, পুলিশ সুপার হোন বা কোনো জনপ্রতিনিধিই হোন, তাঁরা যখন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবেন? নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা হোন বা যেকোনো ক্ষমতাবান হোন, নির্বাচনকেন্দ্রে বসে ব্যালট পেপারে কারও পক্ষে যদি সিল মারতে থাকেন, তাঁকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তা যখন তারা করে না, তখন তারা জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বিশ্বাসঘাতক মানুষকে দিয়ে ভালো রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
রাষ্ট্র চলে যে অর্থে, রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, তাঁদের আরামদায়ক বাড়ি-গাড়ির ব্যয়, তার প্রতিটি পয়সাই জনগণের; সরকারি দলের তহবিল থেকে আসে না। ওই অর্থের অপব্যবহার করার অধিকার রাষ্ট্রের কারও নেই। এবং সরকারি অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, তা তদারকের জন্য রয়েছেন মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ। অতি গুরুদায়িত্ব তাঁর। তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সংবিধান বলে দিয়েছে:
‘মহা হিসাব নিরীক্ষক প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব এবং সকল আদালত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি হিসাব নিরীক্ষা করিবেন এবং অনুরূপ হিসাব সম্পর্কে রিপোর্ট দান করিবেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি কিংবা সেই প্রয়োজনে তাঁহার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তির দখলভুক্ত সকল নথি, বহি, রসিদ, দলিল, নগদ অর্থ, স্ট্যাম্প, জামিন, ভান্ডার বা অন্য প্রকার সরকারি সম্পত্তি পরীক্ষার অধিকারী হইবেন।’
সরকারি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা তাঁরা করছেনও। মহা হিসাব নিরীক্ষক তাঁর বার্ষিক রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি সেটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংসদে পাঠিয়ে দেন। সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, যা সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কমিটি, ওই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়। ব্রিটেন, ভারতসহ পৃথিবীর সংসদীয় গণতান্ত্রিক সব দেশেই মহা হিসাব নিরীক্ষকের রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। সাধারণত পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হন বিরোধী দলের নেতা। কমিটিতে কোনো মন্ত্রী থাকেন না। মহা হিসাব নিরীক্ষকের অফিস ঠিকমতো কাজ করলে সরকারি অফিসে চুরি, অপচয়, দুর্নীতি প্রভৃতি যথেষ্ট পরিমাণে কমে যেতে পারে। কিন্তু বহু শিক্ষিত মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, মহা হিসাব নিরীক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে শুধু নয়, তাঁর পদটি সম্পর্কেই তাঁদের ধারণা নেই। মহা হিসাব নিরীক্ষক এবং সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি অন্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো যদি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করত, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ বারো আনা কমে যেত।
আমাদের সংবিধান বলেছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে’ এবং ‘কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্মকমিশন। এই কমিশনের প্রধানতম দায়িত্ব হলো ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদিগকে মনোনয়নের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনা’ করা। সংবিধান এ কথা বলেনি যে পরীক্ষার্থীদের ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস করিবার অধিকারও তাহাদের থাকিবে’। রাষ্ট্রে একটি দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভূমিকাই প্রধান। সরকারি দলের নিম্ন মেধার ও অযোগ্য ক্যাডারদের নিয়োগ দিলে একসময় প্রশাসন ভেঙে পড়বে। আমরা এখনো পর্যন্ত যা দেখে এসেছি, তাতে বলা যায়, দলীয়করণের কারণে যোগ্যতর ও মেধাবীদের অনেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছেন না। গরিব-মেধাবী তরুণেরা হতাশ। রাষ্ট্রীয় নিয়োগে বিপুল অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন হয়। এই প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে একসময় রাষ্ট্র দুর্বল এমনকি অকার্যকর হয়ে পড়বে।
দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন আগে ছিল না। বর্তমানে এ দুটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। দুদক সম্পর্কে সাবেক এক চেয়ারম্যান নিজেই বলেছিলেন, এটি ‘নখদন্তহীন বাঘ’। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সদিচ্ছা ছাড়া দুদকের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করা অসম্ভব। যদিও গত তিন-চার বছরে বেশ কয়েকজন ক্ষমতাশালীকে তাদের অফিসে তলব করেছে এবং অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু যেভাবে দুদক এখন কাজ করছে, এই গতিতে চললে দেশে দুর্নীতি বাড়বে ছাড়া কমার সম্ভাবনা কম।
মানবাধিকার কমিশনের মিডিয়া প্রচার ছাড়া সাবলীল ভূমিকা এখনো দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। অথচ অসহায় ও দুর্বলের প্রধান সহায়ক হওয়ার কথা মানবাধিকার কমিশন। বরং বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলো দুর্বলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কাজ করছে। আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলের পাশে মিডিয়া ছাড়া দাঁড়ানোর কেউ নেই। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সংখ্যালঘু নৃজাতি, নারী এবং শিশুর ওপর প্রবলের আঘাতকে প্রত্যাঘাত করার জন্য যেসব সংস্থা দায়বদ্ধ, তাদের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। বিরোধী নেতা-কর্মীর অপহরণ, গুম, হত্যা প্রভৃতির সঙ্গে রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে তাঁদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের কথা, সেগুলোর ওপর মানুষের আস্থার সৃষ্টি হয়নি। সবচেয়ে বেদনাদায়ক যা তা হলো নাগরিক সমাজের যেসব সংগঠন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার, সেগুলোর কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে খুবই কঠোরভাবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, দুর্নীতি ও মানবাধিকার নিয়ে দেশে ও বিদেশে সমালোচনা ও উদ্বেগের ঘাটতি নেই। গত দুই-আড়াই বছরে তার মাত্রা বেড়েছে। সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে বাধাহীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব। আশা করি নতুন বছরে জাতীয় এজেন্ডায় এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments