অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির ভূমিকা by এম সাখাওয়াত হোসেন

৩০ ডিসেম্বর ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের বহু পৌরসভা, বিশেষ করে দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল। অবশ্য এ জায়গাগুলো সব নির্বাচনের সময়ই অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি উত্তপ্ত থাকে। এখন পর্যন্ত সংঘর্ষ যা হয়েছে, তা বিগত ২০১১ সালের পৌরসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা বিগত নির্বাচন থেকে নিম্নগামী, যা ভোটারদের শঙ্কিত করে তুলেছে।
ওপরের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিদিনের পত্রিকা খুললেই দেখা যায়। মারাত্মক কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে চৌদ্দগ্রামে দুই পক্ষের সংঘাতের কারণে শুধু উভয় পক্ষের সমর্থকেরা আহতই হননি, বরং জাতীয় মহাসড়ক বন্ধ করে গাড়ি পোড়ানো ও দোকান ভাঙচুরের মহা উৎসব লেগেছিল। সাভারে সরকার-মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকেরা প্রতিপক্ষ বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন চলাকালে হামলা করেছেন বলে পত্রপত্রিকায় তথ্য প্রকাশ। পটুয়াখালীতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির নেতা আলতাফ হোসেনের গাড়িবহরে প্রতিপক্ষের হামলা, গাড়ি ভাঙচুর এবং ২০ জনের ওপরে আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম, নাটোর, চাঁদপুর, লক্ষ্ণীপুর, পাবনা, নেত্রকোনা, সরিষাবাড়ীতে। নড়িয়ায় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীর ওপর হামলা করেছেন একই দলের বিদ্রোহী পার্থীর সমর্থকেরা। নির্বাচনের তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে আচরণবিধি লঙ্ঘন। সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রথম বড় ঘটনা ঘটেছিল ফুলপুর পৌরসভায় দুই মন্ত্রীর উপস্থিতি এবং একজন মন্ত্রীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ দিয়ে। অবশ্য স্থানীয় তদন্তে ওই দুই মন্ত্রী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে প্রমাণিত না হওয়ায় ইসি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অথচ নির্বাচনী আচরণবিধির ২২ অনুচ্ছেদ এবং এর শর্তাংশ পাঠে প্রতীয়মান হয় যে দুই মন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিই যথেষ্ট ছিল। একজন স্থানীয় মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তাঁর সঙ্গে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন দলীয় মেয়র পদপ্রার্থী—এমনই সংবাদ প্রকাশিত হয় পত্রপত্রিকায়।
এমতাবস্থায় নির্বাচনী পরিবেশ যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অনুকূলে থাকছে না, তা তাদের কিছু বক্তব্য থেকেই প্রতীয়মান। একপর্যায়ে একজন কমিশনার সরকারপ্রধানের হস্তক্ষেপের আকুতি জানিয়ে একধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
সংবিধান মোতাবেক নির্বাচনের দায়দায়িত্ব একমাত্র ইসির, তা হোক না সংবিধানের আওতায় পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণোদিত আইন দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সংবিধানের ১১৯ ধারা মতে, নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন পরিচালনার জন্য। বস্তুতপক্ষে নির্বাচন কমিশনকে যতখানি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা অন্য কোনো সাংবিধানিক অথবা আইন দ্বারা গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়নি। কাজেই কমিশনকে কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। যেসব জায়গায় হানাহানি হয়েছে, সেসব জায়গায় নির্বাচন স্থগিত করে নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের প্রার্থিতা বাতিল করার মতো পদক্ষেপ নির্বাচন কমিশন নিতে পারে বা নেওয়া উচিত বলে মনে করি। এখনো সময় আছে, নির্বাচন কমিশন তাদের প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা দেখাতে পারে। কয়েকটি জায়গায় পৌরসভা বিধিমালার ধারা ৩২ অনুযায়ী প্রার্থিতা বাতিলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকে মনে করি, মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গে শক্ত অবস্থান থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গুরুতর বিধি ভঙ্গের মতো ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে আইন শুধু কাগজে–কলমেই থেকে যাবে।
যদিও সংবিধানে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য অনুষ্ঠিত করার মূল দায়িত্ব ইসির। তবে দশক দুয়েকের মধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রয়োজন শরিকদের পূর্ণ সহযোগিতা। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ শরিকদের মধ্যে সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সহযোগী ভূমিকা স্বীকৃত। এ ধরনের সহযোগিতা যেমন সহজে পাওয়া যায় না, তেমনি সহযোগিতা আদায় করার প্রচেষ্টা সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন কী কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে, তা অনেকটা উপলব্ধি করা গিয়েছিল বিগত উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। অতীতের অনিয়মগুলো আমলে নিয়ে শরিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারত। কিন্তু সেটি হয়নি। মূলত এ কারণে মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে আসছে এবং কমিশনকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।
বর্তমানে পৌরসভা নির্বাচনের একাংশ, বিশেষত মেয়র পদে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্তটিও অতি দ্রুত নেওয়া হয়েছে। ততোধিক ত্বরিতগতিতে নির্বাচন অায়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় শরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করা সম্ভব হয়নি, যে কারণে নির্বাচন কমিশনকে বেগ পেতে হচ্ছে। অপর দিকে রাজনৈতিক দলগুলোও প্রথম থেকেই আচরণবিধির খুব একটা তোয়াক্কা করেনি, যা দলের তরফ থেকেও দলীয় প্রার্থী ও সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় পরিচয়ে পরিবর্তন করার পেছনের জোরালো যুক্তি ছিল, এসব নির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর দলের কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তেমনটা শুধু দলের স্বার্থেই হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া বা প্রশাসনে সহযোগিতা করা হয় না, যা এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। নির্বাচনী আইন ও বিধির প্রতি সম্মান দেখানোর দায়িত্বও দলের এবং দলের প্রার্থীদের। কিন্তু আমাদের নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কমিশন রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা তো পায়ই না, বরং উল্টো নানা চাপের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়।
সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পেতে হলে ইসির সহযোগী হয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করার শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তা প্রয়োজন। এর প্রথম ধাপ রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রার্থী নির্বাচন। দলের প্রার্থী নির্বাচনের বাঁধাধরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বিশ্বের কয়েকটি দেশে আইন ও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সিংহভাগ দেশে এ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া প্রতিটি দলের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া বলেই স্বীকৃত। তবে উঠতি গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আইন দ্বারা কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি উত্থাপন করা হচ্ছে। তবে স্বীকৃত দুটি পদ্ধতি হচ্ছে—এক. দলের তৃণমূলে তৈরি তালিকা থেকে শীর্ষস্থানীয় বোর্ডের মাধ্যমে নির্ধারিত করা, তবে শর্ত থাকে যে তৃণমূল পর্যায়েও স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে গঠিত বোর্ড কর্তৃক ক্রম অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করা। দুই. তৃণমূল পর্যায়ে গোপন ভোটের মাধ্যমে প্যানেল তৈরি করা। সূত্রমতে, প্রথম প্রক্রিয়াটিও পুরোপুরিভাবে গ্রহণ না করার কারণে তথাকথিত ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’র জন্ম দেয়, যার উদাহরণ এই নির্বাচনে বিদ্যমান। পৌরসভা নির্বাচনে তথাকথিত বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বিপাকে দেশের দুই বৃহত্তর দল। এ কারণেও আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। নির্বাচনী পরিবেশ হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। এসব যেমন দলের কাঠামো ও নির্বাচনী পরিবেশের হিতে যায় না, তেমনি নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবশ্য একটি স্বীকৃত ধারায় প্রার্থী নির্বাচন করা উচিত, তা না হলে নতুন রাজনীতিবিদদের যেমন উত্থান হবে না, তেমনি মেধাবী তরুণদের রাজনীতিতে আকৃষ্ট করা যাবে না।
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মিডিয়া। ইসিকে হতে হবে মিডিয়াবান্ধব এবং সহযোগিতা নিতে হবে তাদের কাছ থেকেও। অতীতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া উভয়ই নির্বাচন কমিশনকে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছিল। নির্বাচনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে মিডিয়াকে অবাধ বিচরণ করতে দেওয়া উচিত। নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে প্রবেশ করার ওপর কড়াকড়ি আরোপ এবং ভোটের অগ্রগতি ও আইনশৃঙ্খলা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরার প্রক্রিয়াকে সীমিত করা অথবা রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। মিডিয়া, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে নির্বাচন কমিশনের চোখ-কান হিসেবে গণ্য করা হয়। অতীতে মিডিয়ার সহযোগিতা নির্বাচনের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। তাই মিডিয়াকে সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারে। তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, একটি বলিষ্ঠ, শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনই যে শুধু একটি সুষ্ঠু, অবাধ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে, তেমনটি নয়। কারণ, এর সহযোগী শরিকদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনের জন্য স্বাধীনচেতা ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিকল্প নেই।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.