বিএনপি হেরেছে, আওয়ামী লীগও জেতেনি by হায়দার আকবর খান রনো
সহিংসতা
ও অত্যন্ত ভীতিকর রাজনৈতিক ঘটনাবলি দিয়ে বছর শুরু হলেও ২০১৫ সালের শেষ
প্রান্তে এসে রাজনীতি সুস্থ ধারায় না এলেও কিছুটা ভীতিমুক্ত হয়েছে। ২০১৪
সালের ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দুই প্রধান
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
ঘোষণা করেছিল। সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলেছিল ‘গণতন্ত্র বিজয় দিবস’।
অন্যদিকে বিএনপি এই দিনটিকে কালো দিবস হিসেবে পালন করার কথা বলেছিল।
বিএনপিকে কর্মসূচি পালন করতে দেয়নি সরকার। জনসভা করতে বাধা দিয়েছিল। এমনকি
খালেদা জিয়াকে নিজ অফিসে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, গেটের সামনে বালুর ট্রাক
দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে।
সরকারের আচরণে গণতান্ত্রিক নীতিবোধ কাজ করেনি। কিন্তু তার পাল্টা বিএনপি অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দিয়ে ভয়াবহ পেট্রলবোমার সন্ত্রাস চালিয়ে গিয়েছিল প্রায় তিন মাস পর্যন্ত। এই তিন মাসে সারা দেশে ৭০ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন (সূত্র: ৩ এপ্রিল, প্রথম আলোয় প্রকাশিত বদিউল আলম মজুমদারের নিবন্ধ)। পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো কার্যকর ফল আনতে পারে না, সেটা শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া, তারেক জিয়াসহ বিএনপির নেতৃত্বের উপলব্ধিতে এসেছে বলে মনে হয়।
বিএনপির এই সন্ত্রাসী পদ্ধতিকে উৎসাহিত করেছিল একই জোটভুক্ত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী। সন্ত্রাসী কাজে জামায়াতের কর্মীরাই বেশি অংশ নিয়েছিলেন। জামায়াতের অবশ্য নিজস্ব স্বতন্ত্র এজেন্ডা ছিল। দলটির প্রবীণ নেতারা সবাই যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। ইতিমধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরও হয়েছে। সর্বশেষ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়াকে ভন্ডুল করার জন্য জামায়াত সহিংসতার পথ নিয়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাস দিয়ে সরকারকেও ক্ষমতাচ্যুত করা যায়নি, বিচারপ্রক্রিয়া ও অপরাধীদের ফাঁসি বন্ধ করাও যায়নি। আন্তর্জাতিক চাপ কিন্তু ছিল। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মহলও ফাঁসি কার্যকর না করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশ, তুরস্ক—এসব দেশেরও চাপ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তার সঙ্গে চাপকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে লাভ কিছুই করতে পারেনি, কিন্তু পরোক্ষভাবে উপকার করেছে সরকারেরই। রাজনীতির খেলায় বিএনপি হেরে গেছে। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ যে জিতেছে এমনটাও বলা যাবে না। দলটি যত বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, তত বেশি তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে র্যাব, পুলিশ ও দলীয় মাস্তানদের ওপর। আসলে পরাজিত হয়েছে ‘গণতন্ত্র’।
বিএনপি বাসে ও বাসযাত্রীদের গায়ে আগুন লাগাতে গিয়ে নিজের কপালে এমনই আগুন লাগিয়েছে যে এখন দলটিকে রক্ষা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের বাইরে কিছু বাম দল এবং কতিপয় উদারপন্থী রাজনীতিবিদ থাকলেও তাঁরা এখনো তেমন বড় ধরনের শক্তি হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একক একাধিপত্য বিরাজ করছে। কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে রাজনীতি জমে না, গণতন্ত্রও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে সেই চিত্রটাই দেখা যাচ্ছে।
প্রচারমাধ্যম, রাজপথ ও বিলবোর্ড দেখলে মনে হবে দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া বুঝি আর কোনো দলই নেই। তার মানে এই নয় যে দলটি ভীষণ জনপ্রিয়। তবে, বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। এই বছরই ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল। আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া ইত্যাদি যা প্রত্যক্ষ করা গেল তাতে নির্বাচনের ওপরই সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে গেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। তারপরও যদি সেই ক্ষেত্রেও এমন কারচুপি করা হয়, তাহলে তো গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই শঙ্কিত হতে হয়। এখন পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা চলছে, তাতে প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে (২৩ ডিসেম্বর) উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দৈনিকটির একই সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভোটারদের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রবল সন্দেহ-সংশয় রয়েছে।...ভোটারদের এই অংশটি উদাহরণ টানছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয়, এরপর উপজেলা ও সর্বশেষ তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের।’
বিপদের দিক হচ্ছে এই যে সরকার জনগণের ওপর নির্ভর করার চেয়ে প্রশাসন ও র্যাব-পুলিশের ওপর নির্ভর করে বেশি। এতে বিশেষ করে র্যাব-পুলিশ একধরনের আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় দেখা গেল র্যাবের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য ভাড়াটে খুনিতে পরিণত হয়েছেন। প্রশাসন ও র্যাব-পুলিশ ছাড়াও সরকারকে নির্ভর করতে হয় দলীয় মাস্তানদের ওপরও। যারা ভোটকেন্দ্র দখল করবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা ওখানেই থেমে থাকবে। এরপর তারা জমি দখল, সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাক্স দখল ও নারী দখলের জন্যও তৎপর হবে। হচ্ছেও তা–ই। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, মাস্তানদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটেছে এবং নিজ দলের মধ্যে খুনোখুনিও বেড়ে গেছে। লুটের ভাগ অথবা প্রতিপত্তির লড়াইয়ে ছাত্রলীগের-যুবলীগের নিজের মধ্যে সংঘর্ষ ও খুনোখুনির সংখ্যা ব্যাপক। এমনই এক বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল মাতৃগর্ভের কন্যাসন্তানও। এ রকম অরাজক পরিস্থিতি যেন সর্বকালের রেকর্ড ও সব রকম মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। খালেদা জিয়ার আমলে ক্লিন হার্ট অপারেশনের সময় যৌথ বাহিনীর ক্যাম্পে যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন বা নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন, তাঁদের হত্যাকারী ও নির্যাতনকারীদের রক্ষার্থে দায়মুক্তির আইন পাস করা হয়েছিল। অত্যন্ত অন্যায় ও গণতন্ত্রবিরোধী কাজ করেছিলেন তিনি। এখন অবশ্য দায়মুক্তির দরকার হচ্ছে না। হত্যার ঘটনাকেই স্রেফ অস্বীকার করা হচ্ছে। গুপ্তহত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার নতুন নতুন পদ্ধতি বের হচ্ছে। এই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ায় তিনটি যুবকের লাশ পাওয়া গেল। পুলিশ বলল, গণপিটুনিতে মারা গেছে। পুলিশেরই দেওয়া মেডিকেল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, তিন যুবকের গায়ে মোট ৫৬টি বুলেট পাওয়া গেছে। জনগণ কি অস্ত্র ব্যবহার করেছিল?
একদিকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সন্ত্রাস (যা এখন আর দেখা যাচ্ছে না), অপর দিকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত শিক্তপ্রয়োগ ও কঠোরতা—সব মিলিয়ে যখন খুবই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি, তখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৌলবাদী জঙ্গি সন্ত্রাস। এটাই এখন সবচেয়ে বড় বিপদ বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এ বছরই পাঁচজন মুক্তবুদ্ধির লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। এই পর্যন্ত একটি হত্যারও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি। আশিকুর রহমান বাবুকে যারা প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে হত্যা করেছিল, তাদের দুজনকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছিল দুজন সাহসী ব্যক্তি, যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গ বলে অবজ্ঞা করি। সেই হত্যার বিচারকার্য এখনো শুরু হয়নি। সরকারের নির্লিপ্ত ভাব দেখে অবাকই হতে হয়। দীপন হত্যার পর সরকারের ভূমিকা নিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীও ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিশিষ্ট লেখক ও পদার্থবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তো সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, সরকারের জন্য কোনো দুর্বোধ্য সমীকরণ কাজ করছে নাকি। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। আমি অবশ্য অতদূর সন্দেহ করতে চাই না। কিন্তু মনে হয় সরকার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্য যতটা আগ্রহী, মৌলবাদীদের নির্মূল করার ব্যাপারে ততটা তৎপর নয়। বরং মৌলবাদীদের ভাবাদর্শের কাছে ক্রমাগত আত্মসমর্পণের বহু দৃষ্টান্ত আছে।
মৌলবাদী সন্ত্রাস আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিদেশি হত্যা, শিয়া মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ, শিয়া-সুন্নি বিরোধ লাগানোর চেষ্টা (যা বাংলাদেশে কখনোই ছিল না), তাজিয়া মিছিলে বোমা, খ্রিষ্টান যাজককে গলা কেটে হত্যা প্রচেষ্টা, মন্দির প্রাঙ্গণে বোমাবাজি ও হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে সত্যিই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এর সঙ্গে বিদেশি চক্র জড়িত থাকা খুবই স্বাভাবিক। সরকার অবশ্য বারবার বলছে, বাংলাদেশে আইএস নেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী একবার এ কথাও বলেছেন যে আইএস আছে বললে নাকি ‘ওরা হামলে পড়বে’। ওরা কারা, স্পষ্ট করে না বললেও ইঙ্গিতটা অস্পষ্ট নয়। ওরা মানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী শক্তি। তাহলে দুর্ভাবনাটা আরও বেশি।
ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করার উপায় কী? একমাত্র জনগণের ঐক্য ও গণতন্ত্রই পারে সব জাতীয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতাকে মোকাবিলা করতে। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে অন্ধকারের শক্তি বল পায়, বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
এ বছরই পরপর কয়েকটি শিশুহত্যার নির্মম কাহিনি যখন প্রকাশ হচ্ছিল, তখন (আগস্ট মাসে) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছিলেন, ‘আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে শিশু নির্যাতন হচ্ছে।’ এবং ‘রাজনৈতিক আশ্রয় থাকলে আইন তাকে স্পর্শ করে না।’
আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য যে ধর্মীয় মৌলবাদ ও চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে, এটা কোনো অজানা বিষয় নয়। ২০১৫ সালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, গণতন্ত্রকে যত বিস্তৃত করা যাবে, সন্ত্রাস ও মৌলবাদী আশঙ্কাকে তত দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হবে। আশা করি, আগামী বছরে সবারই শুভবুদ্ধির উদয় হবে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতা পরাভূত হবে।
২০১৫ সালে আমাদের অর্জনও কম ছিল না। আমরা মুস্তাফিজের মতো ক্রিকেটার পেয়েছি। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে নাম করেছেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা ১৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন। কৃষকেরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন অবিশ্বাস্য হারে। সব মিলে আমাদের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ধনবৈষম্যও বেড়েছে আতঙ্কজনক হারে।
আমাদের সব অর্জন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকে এবং মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতাকে এখনই নির্মূল না করা যায়। তবে আমি আশাবাদী, আগামী বছরের মধ্যে আমরা উভয় ক্ষেত্রেই বিজয় অর্জন করতে পারব। কারণ, আমি জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রাখি। রবীন্দ্রনাথই তো বলে গেছেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
সরকারের আচরণে গণতান্ত্রিক নীতিবোধ কাজ করেনি। কিন্তু তার পাল্টা বিএনপি অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দিয়ে ভয়াবহ পেট্রলবোমার সন্ত্রাস চালিয়ে গিয়েছিল প্রায় তিন মাস পর্যন্ত। এই তিন মাসে সারা দেশে ৭০ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন (সূত্র: ৩ এপ্রিল, প্রথম আলোয় প্রকাশিত বদিউল আলম মজুমদারের নিবন্ধ)। পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো কার্যকর ফল আনতে পারে না, সেটা শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া, তারেক জিয়াসহ বিএনপির নেতৃত্বের উপলব্ধিতে এসেছে বলে মনে হয়।
বিএনপির এই সন্ত্রাসী পদ্ধতিকে উৎসাহিত করেছিল একই জোটভুক্ত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী। সন্ত্রাসী কাজে জামায়াতের কর্মীরাই বেশি অংশ নিয়েছিলেন। জামায়াতের অবশ্য নিজস্ব স্বতন্ত্র এজেন্ডা ছিল। দলটির প্রবীণ নেতারা সবাই যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। ইতিমধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরও হয়েছে। সর্বশেষ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়াকে ভন্ডুল করার জন্য জামায়াত সহিংসতার পথ নিয়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাস দিয়ে সরকারকেও ক্ষমতাচ্যুত করা যায়নি, বিচারপ্রক্রিয়া ও অপরাধীদের ফাঁসি বন্ধ করাও যায়নি। আন্তর্জাতিক চাপ কিন্তু ছিল। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মহলও ফাঁসি কার্যকর না করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশ, তুরস্ক—এসব দেশেরও চাপ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তার সঙ্গে চাপকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে লাভ কিছুই করতে পারেনি, কিন্তু পরোক্ষভাবে উপকার করেছে সরকারেরই। রাজনীতির খেলায় বিএনপি হেরে গেছে। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ যে জিতেছে এমনটাও বলা যাবে না। দলটি যত বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, তত বেশি তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে র্যাব, পুলিশ ও দলীয় মাস্তানদের ওপর। আসলে পরাজিত হয়েছে ‘গণতন্ত্র’।
বিএনপি বাসে ও বাসযাত্রীদের গায়ে আগুন লাগাতে গিয়ে নিজের কপালে এমনই আগুন লাগিয়েছে যে এখন দলটিকে রক্ষা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের বাইরে কিছু বাম দল এবং কতিপয় উদারপন্থী রাজনীতিবিদ থাকলেও তাঁরা এখনো তেমন বড় ধরনের শক্তি হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একক একাধিপত্য বিরাজ করছে। কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে রাজনীতি জমে না, গণতন্ত্রও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে সেই চিত্রটাই দেখা যাচ্ছে।
প্রচারমাধ্যম, রাজপথ ও বিলবোর্ড দেখলে মনে হবে দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া বুঝি আর কোনো দলই নেই। তার মানে এই নয় যে দলটি ভীষণ জনপ্রিয়। তবে, বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। এই বছরই ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল। আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া ইত্যাদি যা প্রত্যক্ষ করা গেল তাতে নির্বাচনের ওপরই সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে গেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। তারপরও যদি সেই ক্ষেত্রেও এমন কারচুপি করা হয়, তাহলে তো গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই শঙ্কিত হতে হয়। এখন পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা চলছে, তাতে প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে (২৩ ডিসেম্বর) উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দৈনিকটির একই সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভোটারদের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রবল সন্দেহ-সংশয় রয়েছে।...ভোটারদের এই অংশটি উদাহরণ টানছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয়, এরপর উপজেলা ও সর্বশেষ তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের।’
বিপদের দিক হচ্ছে এই যে সরকার জনগণের ওপর নির্ভর করার চেয়ে প্রশাসন ও র্যাব-পুলিশের ওপর নির্ভর করে বেশি। এতে বিশেষ করে র্যাব-পুলিশ একধরনের আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় দেখা গেল র্যাবের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য ভাড়াটে খুনিতে পরিণত হয়েছেন। প্রশাসন ও র্যাব-পুলিশ ছাড়াও সরকারকে নির্ভর করতে হয় দলীয় মাস্তানদের ওপরও। যারা ভোটকেন্দ্র দখল করবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা ওখানেই থেমে থাকবে। এরপর তারা জমি দখল, সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাক্স দখল ও নারী দখলের জন্যও তৎপর হবে। হচ্ছেও তা–ই। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, মাস্তানদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটেছে এবং নিজ দলের মধ্যে খুনোখুনিও বেড়ে গেছে। লুটের ভাগ অথবা প্রতিপত্তির লড়াইয়ে ছাত্রলীগের-যুবলীগের নিজের মধ্যে সংঘর্ষ ও খুনোখুনির সংখ্যা ব্যাপক। এমনই এক বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল মাতৃগর্ভের কন্যাসন্তানও। এ রকম অরাজক পরিস্থিতি যেন সর্বকালের রেকর্ড ও সব রকম মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। খালেদা জিয়ার আমলে ক্লিন হার্ট অপারেশনের সময় যৌথ বাহিনীর ক্যাম্পে যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন বা নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন, তাঁদের হত্যাকারী ও নির্যাতনকারীদের রক্ষার্থে দায়মুক্তির আইন পাস করা হয়েছিল। অত্যন্ত অন্যায় ও গণতন্ত্রবিরোধী কাজ করেছিলেন তিনি। এখন অবশ্য দায়মুক্তির দরকার হচ্ছে না। হত্যার ঘটনাকেই স্রেফ অস্বীকার করা হচ্ছে। গুপ্তহত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার নতুন নতুন পদ্ধতি বের হচ্ছে। এই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ায় তিনটি যুবকের লাশ পাওয়া গেল। পুলিশ বলল, গণপিটুনিতে মারা গেছে। পুলিশেরই দেওয়া মেডিকেল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, তিন যুবকের গায়ে মোট ৫৬টি বুলেট পাওয়া গেছে। জনগণ কি অস্ত্র ব্যবহার করেছিল?
একদিকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সন্ত্রাস (যা এখন আর দেখা যাচ্ছে না), অপর দিকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত শিক্তপ্রয়োগ ও কঠোরতা—সব মিলিয়ে যখন খুবই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি, তখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৌলবাদী জঙ্গি সন্ত্রাস। এটাই এখন সবচেয়ে বড় বিপদ বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এ বছরই পাঁচজন মুক্তবুদ্ধির লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। এই পর্যন্ত একটি হত্যারও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি। আশিকুর রহমান বাবুকে যারা প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে হত্যা করেছিল, তাদের দুজনকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছিল দুজন সাহসী ব্যক্তি, যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গ বলে অবজ্ঞা করি। সেই হত্যার বিচারকার্য এখনো শুরু হয়নি। সরকারের নির্লিপ্ত ভাব দেখে অবাকই হতে হয়। দীপন হত্যার পর সরকারের ভূমিকা নিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীও ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিশিষ্ট লেখক ও পদার্থবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তো সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, সরকারের জন্য কোনো দুর্বোধ্য সমীকরণ কাজ করছে নাকি। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। আমি অবশ্য অতদূর সন্দেহ করতে চাই না। কিন্তু মনে হয় সরকার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্য যতটা আগ্রহী, মৌলবাদীদের নির্মূল করার ব্যাপারে ততটা তৎপর নয়। বরং মৌলবাদীদের ভাবাদর্শের কাছে ক্রমাগত আত্মসমর্পণের বহু দৃষ্টান্ত আছে।
মৌলবাদী সন্ত্রাস আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিদেশি হত্যা, শিয়া মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ, শিয়া-সুন্নি বিরোধ লাগানোর চেষ্টা (যা বাংলাদেশে কখনোই ছিল না), তাজিয়া মিছিলে বোমা, খ্রিষ্টান যাজককে গলা কেটে হত্যা প্রচেষ্টা, মন্দির প্রাঙ্গণে বোমাবাজি ও হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে সত্যিই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এর সঙ্গে বিদেশি চক্র জড়িত থাকা খুবই স্বাভাবিক। সরকার অবশ্য বারবার বলছে, বাংলাদেশে আইএস নেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী একবার এ কথাও বলেছেন যে আইএস আছে বললে নাকি ‘ওরা হামলে পড়বে’। ওরা কারা, স্পষ্ট করে না বললেও ইঙ্গিতটা অস্পষ্ট নয়। ওরা মানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী শক্তি। তাহলে দুর্ভাবনাটা আরও বেশি।
ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করার উপায় কী? একমাত্র জনগণের ঐক্য ও গণতন্ত্রই পারে সব জাতীয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতাকে মোকাবিলা করতে। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে অন্ধকারের শক্তি বল পায়, বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
এ বছরই পরপর কয়েকটি শিশুহত্যার নির্মম কাহিনি যখন প্রকাশ হচ্ছিল, তখন (আগস্ট মাসে) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছিলেন, ‘আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে শিশু নির্যাতন হচ্ছে।’ এবং ‘রাজনৈতিক আশ্রয় থাকলে আইন তাকে স্পর্শ করে না।’
আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য যে ধর্মীয় মৌলবাদ ও চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে, এটা কোনো অজানা বিষয় নয়। ২০১৫ সালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, গণতন্ত্রকে যত বিস্তৃত করা যাবে, সন্ত্রাস ও মৌলবাদী আশঙ্কাকে তত দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হবে। আশা করি, আগামী বছরে সবারই শুভবুদ্ধির উদয় হবে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতা পরাভূত হবে।
২০১৫ সালে আমাদের অর্জনও কম ছিল না। আমরা মুস্তাফিজের মতো ক্রিকেটার পেয়েছি। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে নাম করেছেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা ১৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন। কৃষকেরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন অবিশ্বাস্য হারে। সব মিলে আমাদের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ধনবৈষম্যও বেড়েছে আতঙ্কজনক হারে।
আমাদের সব অর্জন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকে এবং মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতাকে এখনই নির্মূল না করা যায়। তবে আমি আশাবাদী, আগামী বছরের মধ্যে আমরা উভয় ক্ষেত্রেই বিজয় অর্জন করতে পারব। কারণ, আমি জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রাখি। রবীন্দ্রনাথই তো বলে গেছেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments