বিতর্কপ্রিয় বাঙালি
তেল দুই প্রকার: এক প্রকারের তেল মাথায় দেয়, আরেকটি খায়। বিতর্কও এক প্রকারের তেল: কোনোটা লাগে মাথা খাটানোর কাজে, কোনোটা লাগে অকাজের ঝগড়ায়। এই দুই তেল ছাড়া বাঙালির জীবন চলেই না। বিতর্কের তেল না মাখালে কোনো ইস্যুই জনমনে সাড়া তোলে না, চিন্তার চাকা ঠিকমতো ঘোরে না। এ বছর আমরা বহু রকম বিতর্কেই মেতে ছিলাম। রাজনীতির পাড়ায় অবিরত বিতর্কের তির বর্ষিত হয়েছে, মিডিয়া সেগুলোকে আচ্ছামতো শাণ দিয়ে আরও ধারালো করেছে। অনলাইন থেকে অফলাইন—সবখানেই বিতর্কে মজে যাওয়ার মজারু মানুষের ঘাটতিও ছিল না। তর্ক ছাড়া টেলিভিশন থেকে চায়ের দোকান, ফেসবুক থেকে উজবুক, কাউকেই চাঙা করা যায় না। অথচ যেখানে সবচেয়ে বেশি তর্ক হওয়া উচিত, সেই সংসদ বিতর্কহীন। রাজনৈতিক মঞ্চে যে তর্ক চলে তার সম্পর্কে কবি জীবনানন্দ দাশ তো বলেই রেখেছেন, ‘অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই’। ২০১৫ সালের এসব বিতর্কের বেশির ভাগই আসলে অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। এ রকম কিছু বিতর্কের নমুনা:
আইএস আছে আইএস নেই
গত বছরগুলোতে বিশেষত সরকারি মহল থেকে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, জঙ্গিবাদকে ঠেকানোর জন্যই সরকারের হাতকে শক্তিশালী করা দরকার। কঠোর আইন, নিরাপত্তা কার্যক্রমের বিস্তার, গ্রেপ্তার, গণমাধ্যম ও অনলাইন নজরদারির মাধ্যমে হাত শক্তিশালী করা চলতে থাকল। সেই হাত কতটা শক্তিশালী হলো বলা কঠিন, তবে যে জঙ্গিবাদ জুজু ভয় হয়ে ছিল, সেটা সত্যিই শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল। চীনারা ড্রাগন পূজা করত। তো ভক্তের অতি ডাকাডাকিতে ড্রাগন দেখা দিল। তার ভয়াল মূর্তি, মুখের অগ্নিবর্ষণ দেখে ভক্তের যে অবস্থা, জঙ্গি জঙ্গি করতে আমাদেরও বুঝি সে দশাই হয়েছে। তাই যেই জঙ্গিরা স্বরূপে দেখা দিল, অমনি সরকারের মুখপাত্ররা ‘আইএস’ নেই বলতে থাকলেন। একের পর এক নাশকতা ও হত্যার ঘটনা ঘটেই চলল। র্যাব-পুলিশের হাতে সন্দেহভাজন ‘আইএস’ ‘জেএমবি’ ধরা পড়ায়ও বিরতি চলল না। কিন্তু সরকারের এই অস্বীকারের গূঢ় কারণ হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার-সমর্থক অনেকেই ফেসবুক ও গণমাধ্যমে জঙ্গিদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে থাকলেন। আইএস আছে কি নেই সেই প্রশ্নটা আন্তর্জাতিক মাত্রাও অর্জন করে ফেলল। বিতর্ক জমে উঠল বটে, কিন্তু জনগণ নিরাপদ ও নির্ভয় হলো না।
বিদেশি-ব্লগার-প্রকাশক-পুলিশ হত্যার দায়
এ বছরের ফেব্রুয়ারির বইমেলার প্রাঙ্গণে অভিজিৎ হত্যা থেকে শুরু হয়ে প্রকাশক-লেখক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার কোনো কূলকিনারা না হলেও এ নিয়ে বিতর্কের হাওয়া গরম হয়। জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিসহ বিদেশিদের ওপর হামলা কারা করেছে, সে নিয়ে সরকারি ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে আঙুল তুলল। সেই আঙুলের ইশারা মেনে সমর্থকেরাও বিতর্কের মাঠে ধুলা ওড়াল। বিতর্ক যত ছড়ায়, জনমনে ততই সম্ভব-অসম্ভব সব গুজব ও ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’ আছর করে। এতে করে সত্যের সন্ধান আরও কঠিনই হলো। সত্যের অভাব সাহসের অভাব সৃষ্টি করে। তথ্য–প্রমাণ ছাড়াই বিরোধী পক্ষকে অভিযুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়েও বিতর্কের ধোঁয়া উড়ল। ফলে অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাস আরও জোরদার হলো।
ফেসবুক বন্ধ ও নজরদারি
হত্যা-নাশকতার প্রেক্ষাপটে কয়েকবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার ঘটনা বিপুল বিতর্কের জন্ম দেয়। বছরের গোড়ায় তিন দিনের জন্য পাঁচটি ভয়েস ও মেসেজিং সেবা বন্ধ করা হয়। কিন্তু বড় করে বিতর্ক শুরু হয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত ১৮ নভেম্বর থেকে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ ইন্টারনেটে যোগাযোগের বেশ কিছু মাধ্যম বন্ধ করার পর। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এর সমালোচনায় মুখর হয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশে নিরাপত্তার অজুহাতে ফেসবুক বন্ধ হয় না এমন যুক্তি জনপ্রিয়তা পায়। ফেসবুক বন্ধ থাকা অবস্থায় বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা হলে বন্ধের পক্ষে যুক্তি আরও সমালোচিত হয়। কেবল সরকার বনাম সংখ্যাগরিষ্ঠ ফেসবুক ব্যবহারকারীই নয়, সরকার বনাম ফেসবুক কর্তৃপক্ষের মধ্যেও চিঠিতে ও সামনাসামনি বিতর্ক চলে। টানা ২২ দিন ফেসবুক বন্ধ থাকার পর অবশেষ ফেসবুক খোলে বটে, কিন্তু মত প্রকাশে ভয় ও জড়তা পেয়ে বসে অনেককেই।
সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা
সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এ জানা গেল, এক দশকে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়ার অর্ধেক তথা ১০৬টিতে নেমে এসেছে। এ তথ্যে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মন্তব্য করেন, ‘সুন্দরবনের বাঘ ভারতে বেড়াতে গেছে।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যখন ওই বাঘগুলো ফিরে আসবে, তখন সংখ্যা বাড়বে।’ (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০১৫) তাঁর এ মন্তব্য বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষত সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল এবং দুর্ঘটনায় তেল ও কয়লাডুবিতে বনের ক্ষতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীর বক্তব্য বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। বন ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী কীভাবে এ রকম কল্পনাপ্রসূত ও দায়িত্বহীন মন্তব্য করেন, সেই প্রশ্নও ওঠে। বাঘ-বিতর্ক আরও চাঙা করে সুন্দরবনের কাছে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের পক্ষে-বিপক্ষের বিতর্ককে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে সব সময়ই বিতর্ক জারি ছিল। এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘বলা হয় এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে...।’ সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সমালোচনা উঠতে থাকে। তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত আসতে থাকে। যখন এক বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, যখন একের পর এক নাশকতা ও হামলায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তখন সেসব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা না করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কেন? স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয় স্তরে মতৈক্য না থাকার ফলে বারবার এমন প্রসঙ্গগুলো বিতর্ক-যুদ্ধে বারুদের সরবরাহ করছে।
বিতর্কপ্রিয় অসতর্ক বাঙালি
নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বই তর্কপ্রিয় ভারতীয়। বাংলাদেশিরা এ ক্ষেত্রে এক কাঠি সরেস। জাতীয় কোনো বিষয়েই আমরা একমত হতে পারি না। তবে ওপরের বিতর্কগুলোর বিষয় ও যুক্তিই বলে দেয়, এগুলো অসতর্ক মনের কথা। রাজনীতিবিদ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অসতর্কতায় অহেতুক ও নিষ্ফল বিতর্কে যে কত সময় চলে যায়! অভিধান বলে, সতর্ক মানে হলো তর্কের সহিত। আমরা সতর্ক বটে, কিন্তু যুক্তির সহিত তর্ক করি কি না, এ প্রশ্ন করতে হবে নিজেদের। তর্ক আর কুতর্কের মধ্যেও পার্থক্য করা জরুরি। কেননা এ-জাতীয় কুতর্ক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবিশ্বাস আর দূরত্ব বাড়াতেই থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব বিতর্কে রাজনৈতিক মতাদর্শের ঝাঁেজর কাছে সত্য, যুক্তি ও ন্যায় পরাজিত হয়। মতবাদের বিতর্কে তখন হেরে যায় মানুষ।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
আইএস আছে আইএস নেই
গত বছরগুলোতে বিশেষত সরকারি মহল থেকে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, জঙ্গিবাদকে ঠেকানোর জন্যই সরকারের হাতকে শক্তিশালী করা দরকার। কঠোর আইন, নিরাপত্তা কার্যক্রমের বিস্তার, গ্রেপ্তার, গণমাধ্যম ও অনলাইন নজরদারির মাধ্যমে হাত শক্তিশালী করা চলতে থাকল। সেই হাত কতটা শক্তিশালী হলো বলা কঠিন, তবে যে জঙ্গিবাদ জুজু ভয় হয়ে ছিল, সেটা সত্যিই শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল। চীনারা ড্রাগন পূজা করত। তো ভক্তের অতি ডাকাডাকিতে ড্রাগন দেখা দিল। তার ভয়াল মূর্তি, মুখের অগ্নিবর্ষণ দেখে ভক্তের যে অবস্থা, জঙ্গি জঙ্গি করতে আমাদেরও বুঝি সে দশাই হয়েছে। তাই যেই জঙ্গিরা স্বরূপে দেখা দিল, অমনি সরকারের মুখপাত্ররা ‘আইএস’ নেই বলতে থাকলেন। একের পর এক নাশকতা ও হত্যার ঘটনা ঘটেই চলল। র্যাব-পুলিশের হাতে সন্দেহভাজন ‘আইএস’ ‘জেএমবি’ ধরা পড়ায়ও বিরতি চলল না। কিন্তু সরকারের এই অস্বীকারের গূঢ় কারণ হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার-সমর্থক অনেকেই ফেসবুক ও গণমাধ্যমে জঙ্গিদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে থাকলেন। আইএস আছে কি নেই সেই প্রশ্নটা আন্তর্জাতিক মাত্রাও অর্জন করে ফেলল। বিতর্ক জমে উঠল বটে, কিন্তু জনগণ নিরাপদ ও নির্ভয় হলো না।
বিদেশি-ব্লগার-প্রকাশক-পুলিশ হত্যার দায়
এ বছরের ফেব্রুয়ারির বইমেলার প্রাঙ্গণে অভিজিৎ হত্যা থেকে শুরু হয়ে প্রকাশক-লেখক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার কোনো কূলকিনারা না হলেও এ নিয়ে বিতর্কের হাওয়া গরম হয়। জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিসহ বিদেশিদের ওপর হামলা কারা করেছে, সে নিয়ে সরকারি ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে আঙুল তুলল। সেই আঙুলের ইশারা মেনে সমর্থকেরাও বিতর্কের মাঠে ধুলা ওড়াল। বিতর্ক যত ছড়ায়, জনমনে ততই সম্ভব-অসম্ভব সব গুজব ও ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’ আছর করে। এতে করে সত্যের সন্ধান আরও কঠিনই হলো। সত্যের অভাব সাহসের অভাব সৃষ্টি করে। তথ্য–প্রমাণ ছাড়াই বিরোধী পক্ষকে অভিযুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়েও বিতর্কের ধোঁয়া উড়ল। ফলে অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাস আরও জোরদার হলো।
ফেসবুক বন্ধ ও নজরদারি
হত্যা-নাশকতার প্রেক্ষাপটে কয়েকবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার ঘটনা বিপুল বিতর্কের জন্ম দেয়। বছরের গোড়ায় তিন দিনের জন্য পাঁচটি ভয়েস ও মেসেজিং সেবা বন্ধ করা হয়। কিন্তু বড় করে বিতর্ক শুরু হয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত ১৮ নভেম্বর থেকে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ ইন্টারনেটে যোগাযোগের বেশ কিছু মাধ্যম বন্ধ করার পর। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এর সমালোচনায় মুখর হয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশে নিরাপত্তার অজুহাতে ফেসবুক বন্ধ হয় না এমন যুক্তি জনপ্রিয়তা পায়। ফেসবুক বন্ধ থাকা অবস্থায় বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা হলে বন্ধের পক্ষে যুক্তি আরও সমালোচিত হয়। কেবল সরকার বনাম সংখ্যাগরিষ্ঠ ফেসবুক ব্যবহারকারীই নয়, সরকার বনাম ফেসবুক কর্তৃপক্ষের মধ্যেও চিঠিতে ও সামনাসামনি বিতর্ক চলে। টানা ২২ দিন ফেসবুক বন্ধ থাকার পর অবশেষ ফেসবুক খোলে বটে, কিন্তু মত প্রকাশে ভয় ও জড়তা পেয়ে বসে অনেককেই।
সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা
সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এ জানা গেল, এক দশকে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়ার অর্ধেক তথা ১০৬টিতে নেমে এসেছে। এ তথ্যে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মন্তব্য করেন, ‘সুন্দরবনের বাঘ ভারতে বেড়াতে গেছে।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যখন ওই বাঘগুলো ফিরে আসবে, তখন সংখ্যা বাড়বে।’ (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০১৫) তাঁর এ মন্তব্য বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষত সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল এবং দুর্ঘটনায় তেল ও কয়লাডুবিতে বনের ক্ষতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীর বক্তব্য বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। বন ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী কীভাবে এ রকম কল্পনাপ্রসূত ও দায়িত্বহীন মন্তব্য করেন, সেই প্রশ্নও ওঠে। বাঘ-বিতর্ক আরও চাঙা করে সুন্দরবনের কাছে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের পক্ষে-বিপক্ষের বিতর্ককে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে সব সময়ই বিতর্ক জারি ছিল। এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘বলা হয় এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে...।’ সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সমালোচনা উঠতে থাকে। তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত আসতে থাকে। যখন এক বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, যখন একের পর এক নাশকতা ও হামলায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তখন সেসব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা না করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কেন? স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয় স্তরে মতৈক্য না থাকার ফলে বারবার এমন প্রসঙ্গগুলো বিতর্ক-যুদ্ধে বারুদের সরবরাহ করছে।
বিতর্কপ্রিয় অসতর্ক বাঙালি
নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বই তর্কপ্রিয় ভারতীয়। বাংলাদেশিরা এ ক্ষেত্রে এক কাঠি সরেস। জাতীয় কোনো বিষয়েই আমরা একমত হতে পারি না। তবে ওপরের বিতর্কগুলোর বিষয় ও যুক্তিই বলে দেয়, এগুলো অসতর্ক মনের কথা। রাজনীতিবিদ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অসতর্কতায় অহেতুক ও নিষ্ফল বিতর্কে যে কত সময় চলে যায়! অভিধান বলে, সতর্ক মানে হলো তর্কের সহিত। আমরা সতর্ক বটে, কিন্তু যুক্তির সহিত তর্ক করি কি না, এ প্রশ্ন করতে হবে নিজেদের। তর্ক আর কুতর্কের মধ্যেও পার্থক্য করা জরুরি। কেননা এ-জাতীয় কুতর্ক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবিশ্বাস আর দূরত্ব বাড়াতেই থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব বিতর্কে রাজনৈতিক মতাদর্শের ঝাঁেজর কাছে সত্য, যুক্তি ও ন্যায় পরাজিত হয়। মতবাদের বিতর্কে তখন হেরে যায় মানুষ।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments