নতুন বছরে মাঠ কি গরম হচ্ছে? by মলয় ভৌমিক
তখন মনে হয়েছিল বিএনপির নেতারা এটা কী বললেন? নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে না, তা প্রমাণের জন্যই বিএনপি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেবে—কোনো বড় দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মূল লক্ষ্য এমন হতে পারে? এখন দেখা যাচ্ছে বিএনপি সেই পথেই হাঁটছে এবং নির্বাচন কমিশনও যেন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পৌর নির্বাচনকে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের ওপর দাঁড় করানোর দিকে।
বিএনপি নেতারা এ কথা বলেছিলেন পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সময়ে। এরপর থেকে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সব পর্যায়ের নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, তাঁরা নির্বাচনে জয়লাভের চেয়ে নির্বাচনটি যে সুষ্ঠু হবে না, সেদিকেই বেশি জোর দিচ্ছেন। এর অর্থ হলো নির্বাচনের আগেই বিএনপি জেনে গেছে নির্বাচনটি কোনোভাবেই সুষ্ঠু হবে না। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিএনপি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কেন?
পৌরসভা নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ওপর ক্ষমতার রদবদল নির্ভর করে না। কিন্তু এই নির্বাচনের অব্যবস্থাকে পুঁজি করে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার সূচনা করা যেতে পারে। বিএনপি তাদের এই আকাঙ্ক্ষার কথা এখন প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করছে। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি, গতবারের মতো এবারও বছরের শুরুতেই জাতীয় রাজনীতির মাঠ গরম করতে চাইছে বিএনপি।
পৌরসভা নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর। এরপরই শুরু হচ্ছে নতুন বছর। জানুয়ারি হলো পৌষের শেষ আর মাঘের শুরুর মাস। মাঘের শীতে বাঘ কতটা কাঁপে তা জানা না গেলেও মানুষ যে কাঁপে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন দেখার বিষয় হলো, মানুষের হাড়কাঁপানো শীতের এই মাসে বিএনপি কতটা উত্তাপ ধরে রাখতে পারে। আগুন পোহানোর জন্য খড়কুটোর কিছুটা জোগান হয়তো দিয়ে বসতে পারে স্বয়ং নির্বাচন কমিশনই। কিন্তু কথা হলো বিএনপি নিজ উৎস থেকে কতটা জ্বালানি সরবরাহ করতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করছে উত্তাপ ছড়িয়ে দেওয়ার মাত্রা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে পেট্রল উন্নত মানের জ্বালানি হওয়া সত্ত্বেও গত বছরের ব্যর্থ-অভিজ্ঞতার পর এবার এই জ্বালানিটি সম্ভবত ব্যবহারের সুযোগ থাকছে না।
পৌরসভা নির্বাচনের গরম হাওয়াকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় দুর্বলতা বোধকরি বিএনপির দিশাহীনতা। আসলে বিএনপি ঠিক কী লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে চায় তা স্পষ্ট নয়। অবশ্য মোটা দাগে একটা লক্ষ্য তাদের আছে। সেটা হলো ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু কীভাবে, এ প্রশ্নেই রয়েছে অস্পষ্টতা। তারা একবার বলছে সরকার পতনের আন্দোলন করবে, আর একবার বলছে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাবে। আবার সে নির্বাচন মধ্যবর্তী নির্বাচন কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। তত্ত্বাবধায়ক না নির্দলীয়-নিরপেক্ষ—এ প্রশ্নের মীমাংসাও তারা করতে পারেনি। তাদের তরফ থেকে তুলে ধরা হয়নি সুস্পষ্ট কোনো রূপরেখাও। বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ কদিন আগে বললেন, তাঁদের আন্দোলন শুরু হবে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। এ বক্তব্যের মধ্যেও আছে ধোঁয়াশা। তিনি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের অপসারণের কথা বলছেন, নাকি কমিশনের সংস্কার দাবি করছেন, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কমিশনের ত্রুটিগুলো দূর করে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন অবশ্যই সময়ের দাবি। তবে এ দাবি যৌক্তিক করে তুলতে হলে সুস্পষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হবে। আমরা বিএনপির কর্মকাণ্ডে এ ধরনের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। তাদের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও এসব প্রশ্নে রয়েছে চরম বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি নিয়ে কতটা পথ হাঁটা যাবে, তা বিএনপিকে ভেবে দেখতে হবে।
পৌরসভা নির্বাচনে যদি ব্যাপক অনিয়ম হয়, তাহলে এই অনিয়মকে কেন্দ্র করে পরাজিত প্রার্থী এবং তঁাদের সমর্থকদের ক্ষোভ নিচ থেকে কতটা ওপরমুখী হবে তা কিন্তু পরীক্ষিত নয়। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় এ দেশের বড় দলগুলোর সব সিদ্ধান্তই হয় শীর্ষ থেকে নিম্নমুখী। তৃণমূলের কমিটিতে কারা থাকবেন, নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন কে, তা এ দেশে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়। আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ যেকোনো আন্দোলন কেন্দ্র বা রাজধানীতে গড়ে না উঠলে তা নিচের পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে না। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে বিএনপির রয়েছে বেশ দুর্বলতা। তারা ঢাকায় নেতা-কর্মীদের ব্যাপক হারে মাঠে নামাতে পারেনি। সম্ভবত এই দুর্বলতা ঢাকতেই বিএনপি নিজের শক্তির ওপর নির্ভর না করে হেফাজতের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ফল যা ঘটার তা–ই ঘটেছে। পুলিশের তাড়া খেয়ে হেফাজতের কর্মীরা সরে পড়তেই ঢাকার রাজপথ ফাঁকা হয়ে যায়। একই ধারাবাহিকতায় এবার বিজয় দিবসেও বিএনপির অনেক নেতাকে তঁাদের দলীয় শোভাযাত্রায় শামিল হতে দেখা যায়নি।
পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতে কোটিপতির সংখ্যা অনেক বেশি। এসব ব্যবসায়ী কোটিপতি নেতারা তাঁদের সম্পদ রক্ষার চেয়ে আন্দোলনের পথকে শ্রেয় ভাববেন, এমন মনে করার কারণ নেই। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী। দলের মনোনয়নবঞ্চিত এসব নেতা চটজলদি দলের পক্ষে মাঠে না-ও নামতে পারেন। এটা ঠিক, মাঠপর্যায়ে বিএনপির একটা বড় সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু কেবল সমর্থক দিয়ে যে আন্দোলন হয় না, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছে।
শরিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াত ছাড়া আন্দোলন-সংগ্রামে অন্য দলগুলোর তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। মাঠের আন্দোলনে বিএনপি বহুল অংশেই জামায়াত-শিবিরের ওপর নির্ভরশীল। সরকার পতনের আন্দোলনের চেয়ে যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষাই বর্তমানে জামাতের এক নম্বর এজেন্ডা। কিন্তু এ প্রশ্নে বিএনপির দোদুল্যমান অবস্থান জামায়াতকে যথেষ্ট পরিমাণেই নাখোশ করে। সম্ভবত এ কারণেই পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ২০-দলীয় জোট সভায় জামায়াত অনুপস্থিত ছিল। অনেকেই মনে করেন ভোটব্যাংক ও আন্দোলন—এই দুই ব্যাপারেই বিএনপির কাছে জামায়াতের কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া বিএনপিপন্থীদের সিংহভাগের মাথায় এখনো রয়েছে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ। কাজেই যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে বিএনপির এখন আর দ্বিমুখী অবস্থানের সুযোগ নেই। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর খালেদা জিয়া কর্তৃক বিস্ময়করভাবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন মূলত এই ভাবনারই ফল। ২২ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়া কেবল শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অসম্মানজনক উক্তিই করেননি, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন যথাযথ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান, সে দাবি জানিয়েছেন। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই বক্তব্য যে মূলত জামায়াতকে খুশি করার জন্য, সে ব্যাপারে আর সন্দেহ থাকছে না। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে বিএনপি তাদের এত দিনের দোদুল্যমান অবস্থানেরও ইতি টানল বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ইদানীং বারবার বলছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবে। সহিংস আন্দোলন যে দলের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনেনি, সম্ভবত এটা মাথায় রেখেই মির্জা ফখরুল এ কথা বলেছেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য যে প্রজ্ঞা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তা জামায়াতনির্ভর বিএনপির আছে কি না, বিএনপিকে ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির বর্তমান সুস্পষ্ট অবস্থানের পর জামায়াত-শিবির যে নতুন উদ্যমে সহিংস হয়ে উঠবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়।
পৌরসভা নির্বাচনের ‘অব্যবস্থা’কে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলা না গেলেও বিএনপি তার সংগঠনকে নড়বড়ে অবস্থান থেকে শক্ত অবস্থানে আনার একটা সুযোগ হয়তো সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু তারা যে পথে হাঁটছে তাতে মনে হয় না ওই সুযোগকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আছে। মোটকথা, লেখকের প্রশ্নে এককেন্দ্রিক কোনো অবস্থানে তাদের এখনো দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতারাও নির্বাচনী মাঠে নেই। সাধারণের আকাঙ্ক্ষাকে তারা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেনি। এ অবস্থায় তারা বরং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ‘সংখ্যাতত্ত্ব’ নিয়ে নতুনরূপে হাজির হলো। নতুন এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য কী এবং এতে শীতের এই মাঠ কি সত্যি সত্যি গরম হবে, নাকি আরও বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন হবে, তা জানার জন্য আমাদের হয়তো আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নাট্যকার।
বিএনপি নেতারা এ কথা বলেছিলেন পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সময়ে। এরপর থেকে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সব পর্যায়ের নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, তাঁরা নির্বাচনে জয়লাভের চেয়ে নির্বাচনটি যে সুষ্ঠু হবে না, সেদিকেই বেশি জোর দিচ্ছেন। এর অর্থ হলো নির্বাচনের আগেই বিএনপি জেনে গেছে নির্বাচনটি কোনোভাবেই সুষ্ঠু হবে না। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিএনপি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কেন?
পৌরসভা নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ওপর ক্ষমতার রদবদল নির্ভর করে না। কিন্তু এই নির্বাচনের অব্যবস্থাকে পুঁজি করে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার সূচনা করা যেতে পারে। বিএনপি তাদের এই আকাঙ্ক্ষার কথা এখন প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করছে। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি, গতবারের মতো এবারও বছরের শুরুতেই জাতীয় রাজনীতির মাঠ গরম করতে চাইছে বিএনপি।
পৌরসভা নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর। এরপরই শুরু হচ্ছে নতুন বছর। জানুয়ারি হলো পৌষের শেষ আর মাঘের শুরুর মাস। মাঘের শীতে বাঘ কতটা কাঁপে তা জানা না গেলেও মানুষ যে কাঁপে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন দেখার বিষয় হলো, মানুষের হাড়কাঁপানো শীতের এই মাসে বিএনপি কতটা উত্তাপ ধরে রাখতে পারে। আগুন পোহানোর জন্য খড়কুটোর কিছুটা জোগান হয়তো দিয়ে বসতে পারে স্বয়ং নির্বাচন কমিশনই। কিন্তু কথা হলো বিএনপি নিজ উৎস থেকে কতটা জ্বালানি সরবরাহ করতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করছে উত্তাপ ছড়িয়ে দেওয়ার মাত্রা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে পেট্রল উন্নত মানের জ্বালানি হওয়া সত্ত্বেও গত বছরের ব্যর্থ-অভিজ্ঞতার পর এবার এই জ্বালানিটি সম্ভবত ব্যবহারের সুযোগ থাকছে না।
পৌরসভা নির্বাচনের গরম হাওয়াকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় দুর্বলতা বোধকরি বিএনপির দিশাহীনতা। আসলে বিএনপি ঠিক কী লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে চায় তা স্পষ্ট নয়। অবশ্য মোটা দাগে একটা লক্ষ্য তাদের আছে। সেটা হলো ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু কীভাবে, এ প্রশ্নেই রয়েছে অস্পষ্টতা। তারা একবার বলছে সরকার পতনের আন্দোলন করবে, আর একবার বলছে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাবে। আবার সে নির্বাচন মধ্যবর্তী নির্বাচন কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। তত্ত্বাবধায়ক না নির্দলীয়-নিরপেক্ষ—এ প্রশ্নের মীমাংসাও তারা করতে পারেনি। তাদের তরফ থেকে তুলে ধরা হয়নি সুস্পষ্ট কোনো রূপরেখাও। বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ কদিন আগে বললেন, তাঁদের আন্দোলন শুরু হবে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। এ বক্তব্যের মধ্যেও আছে ধোঁয়াশা। তিনি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের অপসারণের কথা বলছেন, নাকি কমিশনের সংস্কার দাবি করছেন, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কমিশনের ত্রুটিগুলো দূর করে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন অবশ্যই সময়ের দাবি। তবে এ দাবি যৌক্তিক করে তুলতে হলে সুস্পষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হবে। আমরা বিএনপির কর্মকাণ্ডে এ ধরনের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। তাদের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও এসব প্রশ্নে রয়েছে চরম বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি নিয়ে কতটা পথ হাঁটা যাবে, তা বিএনপিকে ভেবে দেখতে হবে।
পৌরসভা নির্বাচনে যদি ব্যাপক অনিয়ম হয়, তাহলে এই অনিয়মকে কেন্দ্র করে পরাজিত প্রার্থী এবং তঁাদের সমর্থকদের ক্ষোভ নিচ থেকে কতটা ওপরমুখী হবে তা কিন্তু পরীক্ষিত নয়। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় এ দেশের বড় দলগুলোর সব সিদ্ধান্তই হয় শীর্ষ থেকে নিম্নমুখী। তৃণমূলের কমিটিতে কারা থাকবেন, নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন কে, তা এ দেশে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়। আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ যেকোনো আন্দোলন কেন্দ্র বা রাজধানীতে গড়ে না উঠলে তা নিচের পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে না। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে বিএনপির রয়েছে বেশ দুর্বলতা। তারা ঢাকায় নেতা-কর্মীদের ব্যাপক হারে মাঠে নামাতে পারেনি। সম্ভবত এই দুর্বলতা ঢাকতেই বিএনপি নিজের শক্তির ওপর নির্ভর না করে হেফাজতের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ফল যা ঘটার তা–ই ঘটেছে। পুলিশের তাড়া খেয়ে হেফাজতের কর্মীরা সরে পড়তেই ঢাকার রাজপথ ফাঁকা হয়ে যায়। একই ধারাবাহিকতায় এবার বিজয় দিবসেও বিএনপির অনেক নেতাকে তঁাদের দলীয় শোভাযাত্রায় শামিল হতে দেখা যায়নি।
পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতে কোটিপতির সংখ্যা অনেক বেশি। এসব ব্যবসায়ী কোটিপতি নেতারা তাঁদের সম্পদ রক্ষার চেয়ে আন্দোলনের পথকে শ্রেয় ভাববেন, এমন মনে করার কারণ নেই। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী। দলের মনোনয়নবঞ্চিত এসব নেতা চটজলদি দলের পক্ষে মাঠে না-ও নামতে পারেন। এটা ঠিক, মাঠপর্যায়ে বিএনপির একটা বড় সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু কেবল সমর্থক দিয়ে যে আন্দোলন হয় না, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছে।
শরিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াত ছাড়া আন্দোলন-সংগ্রামে অন্য দলগুলোর তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। মাঠের আন্দোলনে বিএনপি বহুল অংশেই জামায়াত-শিবিরের ওপর নির্ভরশীল। সরকার পতনের আন্দোলনের চেয়ে যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষাই বর্তমানে জামাতের এক নম্বর এজেন্ডা। কিন্তু এ প্রশ্নে বিএনপির দোদুল্যমান অবস্থান জামায়াতকে যথেষ্ট পরিমাণেই নাখোশ করে। সম্ভবত এ কারণেই পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ২০-দলীয় জোট সভায় জামায়াত অনুপস্থিত ছিল। অনেকেই মনে করেন ভোটব্যাংক ও আন্দোলন—এই দুই ব্যাপারেই বিএনপির কাছে জামায়াতের কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া বিএনপিপন্থীদের সিংহভাগের মাথায় এখনো রয়েছে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ। কাজেই যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে বিএনপির এখন আর দ্বিমুখী অবস্থানের সুযোগ নেই। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর খালেদা জিয়া কর্তৃক বিস্ময়করভাবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন মূলত এই ভাবনারই ফল। ২২ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়া কেবল শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অসম্মানজনক উক্তিই করেননি, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন যথাযথ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান, সে দাবি জানিয়েছেন। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই বক্তব্য যে মূলত জামায়াতকে খুশি করার জন্য, সে ব্যাপারে আর সন্দেহ থাকছে না। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে বিএনপি তাদের এত দিনের দোদুল্যমান অবস্থানেরও ইতি টানল বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ইদানীং বারবার বলছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবে। সহিংস আন্দোলন যে দলের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনেনি, সম্ভবত এটা মাথায় রেখেই মির্জা ফখরুল এ কথা বলেছেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য যে প্রজ্ঞা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তা জামায়াতনির্ভর বিএনপির আছে কি না, বিএনপিকে ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির বর্তমান সুস্পষ্ট অবস্থানের পর জামায়াত-শিবির যে নতুন উদ্যমে সহিংস হয়ে উঠবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়।
পৌরসভা নির্বাচনের ‘অব্যবস্থা’কে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলা না গেলেও বিএনপি তার সংগঠনকে নড়বড়ে অবস্থান থেকে শক্ত অবস্থানে আনার একটা সুযোগ হয়তো সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু তারা যে পথে হাঁটছে তাতে মনে হয় না ওই সুযোগকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আছে। মোটকথা, লেখকের প্রশ্নে এককেন্দ্রিক কোনো অবস্থানে তাদের এখনো দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতারাও নির্বাচনী মাঠে নেই। সাধারণের আকাঙ্ক্ষাকে তারা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেনি। এ অবস্থায় তারা বরং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ‘সংখ্যাতত্ত্ব’ নিয়ে নতুনরূপে হাজির হলো। নতুন এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য কী এবং এতে শীতের এই মাঠ কি সত্যি সত্যি গরম হবে, নাকি আরও বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন হবে, তা জানার জন্য আমাদের হয়তো আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নাট্যকার।
No comments