আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী by ড.তারেক শামসুর রেহমান
ডা. দীপু মনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ব্যক্তি জীবনে তিনি এমবিবিএস পাস করেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু কোনোদিন প্রাকটিস করেননি। স্বামী আইনজীবী হওয়ার সুবাদে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে আইনজীবী হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রাকটিস করেছেন কিংবা আইনজীবীদের নেতা হয়েছেন, এমন খবর অন্তত আমার জানা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ‘ভিআইপি বন্দি’ ছিলেন, তখন মাঝে-মধ্যে দীপু মনি ‘আপার’ সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন—এ রকম খবর আমরা পত্রিকায় পড়েছি।
প্রধানমন্ত্রী ডা. দীপু মনির মাঝে কী খুঁজে পেয়েছিলেন, বলতে পারব না। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দীপু মনি যখন শপথ নিলেন, তখন কিছুটা অবাক হয়েছিলাম বৈকি! কেননা দীর্ঘ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তথা নিরাপত্তা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সবাইকে চিনি ও জানি। কিন্তু ২০০৯ সালের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত আমি দীপু মনিকে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত কোনো সেমিনারে অংশ নিতে বা বক্তব্য রাখতে দেখিনি। সেই দীপু মনি হঠাৎ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গেলেন! শেখ হাসিনা নয়া নেতৃত্ব চান। এটা ভালো কথা। আমি আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যকে চিনি, যারা পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ধারণা রাখেন। অতীতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এমন ব্যক্তিও সংসদে আছেন। এদের কাউকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করলে, আমি অবাক হতাম না। অবাক হয়েছিলাম দীপু মনিকে সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসে দেখে। তারপর কেটে গেছে ৯ মাস। মন্ত্রিসভায় রদবদল হলেও থেকে গেছেন দীপু মনি। ব্যক্তি দীপু মনিকে আমি চিনি না। জানার সৌভাগ্যও হয়নি কোনোদিন। কিন্তু একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেন তখন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শুধু নিজের অজ্ঞতাই তিনি প্রকাশ করেন না। বরং তার বক্তব্য বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ভিন্ন ধারণার জন্ম দিতে বাধ্য। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ‘বাফার সেল্টট’ সম্পর্কে তিনি সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছিলেন, সে কথা। ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল। কূটনৈতিক অনেক ভাষা ও জ্ঞান তার না জানার কথা, তাতে কোনো অপরাধ নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যারা আছেন, তাদের সাহায্য তিনি নিতে পারতেন। তা তিনি নেননি। সাম্প্রতিককালে নানা কারণে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচিত। সর্বশেষ যে কারণটির জন্য তিনি আলোচিত, তা হচ্ছে তার টরেন্টো সফর ও সেখানকার বিরোধী দলের সঙ্গে তার মতবিনিময়। এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে গত ১০ অক্টোবর টরেন্টো থেকে প্রকাশিত অন লাইন পত্রিকা নতুন দেশ-এ ----। গত ১ অক্টোবরের টরেন্টো সফর ছিল তার ব্যক্তিগত সফর। ব্যক্তিগত সফরে তিনি কোনো দেশে যেতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি সেখানকার সরকার অথবা বিরোধীদলের কারো সঙ্গে কথা বলেন, সেটা তখন প্রটোকলের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এখানে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে, তা হচ্ছে, ১. তিনি কানাডার বিরোধী লিবারেল পার্টর এমপিদের সঙ্গে দেখা ও মতবিনিময় কেন করলেন, যখন লিবারেল পার্টি কানাডার পার্লামেন্টে সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে? তার এই ‘সাক্ষাত্কার পর্ব’ কি কানাডীয় সরকারের কাছে কোনো ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে না? ২. ব্যক্তিগত সফরে এসে তিনি যদি কারো সঙ্গে দেখা করতেই চান, তাহলে তিনি তার কানাডীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন না কেন? প্রটোকল অনুযায়ী সেটাই তো তার করা উচিত ছিল। ৩. তিনি যে কানাডার বিরোধী দলের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন, তাতে কি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছিল? প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েই কি তিনি এই ‘সাক্ষাত্’ পর্বটি শেষ করেছিলেন? ৪. পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সাক্ষাত্পর্ব দেখে কি আমরা ধরে নেব আওয়ামী লীগ লিবারেল পার্টির সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে চায়? কানাডার সরকারি দলের সঙ্গে নয়?
এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা আমাদের দূতাবাস প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে (ছবিসহ) সংবাদটি সবাইকে জানিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের হাইকমিশনারও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার বিলও হাই কমিশন পরিশোধ করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি ভুল করে, না বুঝেশুনেই এ কাজটি করলেন? হাই কমিশনারও বা কী করলেন? তিনি কি মন্ত্রী মহোদয়কে ‘প্রপার ব্রিফ’ করেননি? বিরোধী দলের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘বৈঠক’ কানাডীয় সরকারকে একটি ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে পারে। আমাদের ভুললে চলবে না, কানাডা আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। যে তিনটি দেশ আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয়, কানাডার অবস্থান জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের পরে। ১৯৭১-৭২ সাল থেকে ২০০৬-০৭ সালের সময়সীমায় আমরা কানাডার কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি ২০১০ মিলিয়ন ডলার (জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের পরিমাণ এ সময় যথাক্রমে ৬৭৬৭.৭ মি. ডলার ও ৩৫৩৫.৫ মিলিয়ন ডলার)। কানাডা থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের মাঝে রয়েছে ৯৪৮ মি. ডলার খাদ্য সাহায্য, ৩৮৪.৩ মি. ডলার পণ্য সাহায্য ও ৬৭৭.৭ মিলিয়ন ডলার প্রকল্প সাহায্য। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কানাডা আমাদের বড় অংশীদার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কানাডায় আমরা রফতানি করেছি ২৪২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকার পণ্য। ২০০৫-০৬ সালে এই পরিসংখ্যান ছিল ২০৬৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাত্ এক বছরে রফতানি আয় বেড়েছে। নব্বই সালের পর থেকেই কানাডায় আমাদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রতি বছরই তা বেড়ে চলেছে। যদি আমরা আমদানির পরিসংখ্যান নেই, তাহলে আমরা দেখব ২০০৬-০৭ সময়সীমায় কানাডা থেকে আমদানি হয়েছে ১০৮০ কোটি ২৮ লাখ টাকার পণ্য। ২০০৫-০৬ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৩৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর অর্থ হচ্ছে আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। তবে সামগ্রিক বিচারে বাণিজ্যিক ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে। এক্ষেত্রে আমরা আগামীতে কানাডায় আরও পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার আশা করছি। আমাদের রফতানি আরও সম্প্রসারিত হওয়ার কথা। কিন্তু যেখানে কানাডার লিবারেল পার্টি সরকারের প্রতি অনাস্থা এনেছে, সেখানে সেই বিরোধী দলের কয়েকজন সিনিয়র এমপির সঙ্গে বৈঠক, কানাডার সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বাধ্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি একই সঙ্গে সরকারি দলের এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করতেন, তাহলে এ প্রশ্নটা উঠত না। এখানে হাই কমিশনারের ব্যর্থতাও চোখে লাগার মতো।
সরকারের বয়স ন’মাস। এই ন’মাস একেবারে কম সময় নয়। এই ন’মাসে আমরা কি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কোনো দিকনির্দেশনা পেয়েছি? এই দিকনির্দেশনাটি আসার কথা দীপু মনির কাছ থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক’ রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করার পরিবর্তে আমরা লক্ষ্য করলাম একটা ‘ভারত ঘেঁষা’ নীতি। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। পার্শ্ববর্তী দেশের উপর এর একটা প্রভাব থাকবেই। সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে সঠিক নীতিটি গ্রহণ করার মধ্যেই রয়েছে স্বার্থকতা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন জাতীয় স্বার্থের কথা। কিন্তু এশিয়ান হাইওয়ে কিংবা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না বলে আমার ধারণা। ভারতকে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার ব্যাপারেও নানা কথা উঠেছে এবং বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যাবে, তা কি আমাদের কাসল্টমস্ পরীক্ষা করতে পারবে? দুই. এসব যন্ত্রপাতির জন্য কি আদৌ কোনো কর পরিশোধ করা হবে? তিন. এসব যন্ত্রপাতি পরিবহন করবে কারা? চার. ভারি যন্ত্রপাতি আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে অবকাঠামো সুবিধা দরকার, তা কি আছে? রাস্তাঘাট কি বাংলাদেশকে তৈরি করতে হবে? মনে রাখতে হবে ভারতীয় হেভি ট্রাক চালানোর জন্য রাস্তা বাংলাদেশে নেই। পাঁচ. রাস্তাঘাট প্রশ্বস্ত করার সুযোগ যদি আমরা ভারতীয় প্রকৌশলীদের দেই, তাহলে ভবিষ্যতে ভারত যে, ‘দ্বিতীয়বার’ আর এ ধরনের সুযোগ চাইবে না, এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি কীভাবে? ছয়. এ ধরনের কোনো পরিবহন ব্যবস্থার উপর যদি উলফা গেরিলারা ‘আক্রমণ’ (?) করে (যার আশঙ্কা রয়েছে), তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? আমরা কি তাহলে আশুগঞ্জ-আগরতলা রুটে পাহারা বসাব? সেটা কি সম্ভব? এসব প্রশ্ন উঠবেই। ভালো হতো বিষয়গুলো যদি নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করা হতো, সংসদে আলোচনা হতো—তারপর না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নিতাম। সরকার এসব বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনার দিন ধার্য করলে, আমার বিশ্বাস বিএনপি তখন সংসদে আসত। বিএনপিকে সংসদে আনানোর এটি ছিল একটি মোক্ষম উপায়।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার জন্য ট্রানজিট দেয়া হবে। বাংলাদেশ ও নেপালের মাঝখানে ছোট্ট একখণ্ড ভূমি এই দু’টো দেশকে আলাদা করেছে। নেপালিরা দীর্ঘদিন চেয়ে আসছে এই সুযোগ। তারা মংলা পোর্টকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে ভারত ট্রানজিট দেয়নি। এখন দিলে আমরা খুশি হব। কিন্তু ভারতকে কি বিশ্বাস করা যায়? ৮০ লাখ পিচ শার্ট কেনার কথা বলেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আজও সেই শার্ট ভারতে যায়নি। অশুল্ক বাধার কথা আমাদের ব্যবসায়ীরা বার বার বলছেন। কিন্তু সেই অশুল্ক বাধা দূর হয়নি। তাই ঘাটতি বাড়ছে। বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। তখন এই ঘাটতি কমাতে না পারলে ভারত তো ট্রানজিটের সুবিধা চাবেই! ‘ট্রানজিট ফি’ দিয়ে ঘাটতি কমানো! চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহার করতে দেয়া! এসব দাবি অতীতে ভারতীয় হাই কমিশনাররা প্রকাশ্যেই করেছেন। এখন আমরা সেদিকেই যেতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ আমাদের অনেক পণ্য রয়েছে, যা রফতানি করে আমরা ঘাটতি কমাতে পারি। কিন্তু অসহযোগিতার কারণে আমাদের পণ্য ভারতে যাচ্ছে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরে আমি খুব একটা খুশি হতে পারিনি। ভারতের সঙ্গে আমাদের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে, যেসব সমস্যার ব্যাপারে ভারত কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি কখনও। বার বার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশীরা মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। টিপাইমুখ নিয়ে একটি যৌথ বিশেষজ্ঞ টিম গঠনেও রাজি হয়নি ভারত। সমুদ্রসীমায় আমাদের দাবি ভারত এখনও স্বীকার করে নিচ্ছে না। চুক্তি হয়েছিল গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে—কিন্তু পদ্মায় পানি নেই। রাজশাহীতে পদ্মার পাড়ে এখন মাইলের পর মাইল শুধুই বালু। ৬.৫ কি. মি. সীমান্ত চিহ্নিত হয়নি আজো। ৫১টি ছিটমহল আমরা আজও ফিরে পাইনি। দক্ষিণ তালপট্টিতে আমাদের অধিকার আজও স্বীকৃত হয়নি। এশিয়ান হাইওয়ের নামে আমরা ভারত থেকে ভারতে যাওয়ার রুট মেনে নিলাম। কিন্তু একবারও ভেবে দেখলাম না মিয়ানমার রুট আমাদের জন্য আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে বিশাল এক পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে পারে। আমরা শুধু ভারতীয় আশ্বাস পাচ্ছি বার বার। এবারও পেলাম। শুধু আশ্বাসেই কি আমরা খুশি থাকব?
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ুক—আমরা তা চাই। কিন্তু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়। দীপু মনি আশ্বাস দিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। হাজারটা যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু মূল যে প্রশ্ন, তার কোনো সমাধান হয়েছে বলে মনে হয় না। মূল প্রশ্নটাই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে ভারত থেকে ভারতে যাওয়া এশিয়ান হাইওয়ের মধ্য দিয়ে— এ প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন আমাদের জন্য মিয়ানমার ও চীন অনেক জরুরি। আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য চাহিদার অন্যতম উত্স হতে পারত মিয়ানমার। চীন তো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সঙ্গে নিয়েই ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভারত এককভাবে যেতে চায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। তার টার্গেট আশিয়ান। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় ব্যর্থতা। এখন চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক আটকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও আমরা ‘ইমেজ সঙ্কটে’ ভুগছি। শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের এখনও আশ্বাসের কথা শোনান। তিনি বিদেশ সফর করতে ‘ভালোবাসেন’, এটা আমরা জানি। মাসের কতদিন তিনি বাংলাদেশে থাকেন, এ প্রশ্ন আমি করব না। কিন্তু আমি চাই আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হোক। পররাষ্ট্র নীতিতে চাই নতুন উদ্দীপনা। ‘জলবায়ুু নিরাপত্তা’ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো উদ্বেগ এতে আছে বলে মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে কোনো ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত, যে কোনো ‘ভুল উদ্যোগ’, হিতে বিপরীত হতে পারে। আর এতে করে ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে দাতা গোষ্ঠীকে। কানাডায় লিবারেল পার্টির সঙ্গে তার বৈঠক ও মতবিনিময়ের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সঠিক হয়নি।
লেখক : নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক
এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা আমাদের দূতাবাস প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে (ছবিসহ) সংবাদটি সবাইকে জানিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের হাইকমিশনারও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার বিলও হাই কমিশন পরিশোধ করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি ভুল করে, না বুঝেশুনেই এ কাজটি করলেন? হাই কমিশনারও বা কী করলেন? তিনি কি মন্ত্রী মহোদয়কে ‘প্রপার ব্রিফ’ করেননি? বিরোধী দলের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘বৈঠক’ কানাডীয় সরকারকে একটি ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে পারে। আমাদের ভুললে চলবে না, কানাডা আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। যে তিনটি দেশ আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয়, কানাডার অবস্থান জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের পরে। ১৯৭১-৭২ সাল থেকে ২০০৬-০৭ সালের সময়সীমায় আমরা কানাডার কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি ২০১০ মিলিয়ন ডলার (জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের পরিমাণ এ সময় যথাক্রমে ৬৭৬৭.৭ মি. ডলার ও ৩৫৩৫.৫ মিলিয়ন ডলার)। কানাডা থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের মাঝে রয়েছে ৯৪৮ মি. ডলার খাদ্য সাহায্য, ৩৮৪.৩ মি. ডলার পণ্য সাহায্য ও ৬৭৭.৭ মিলিয়ন ডলার প্রকল্প সাহায্য। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কানাডা আমাদের বড় অংশীদার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কানাডায় আমরা রফতানি করেছি ২৪২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকার পণ্য। ২০০৫-০৬ সালে এই পরিসংখ্যান ছিল ২০৬৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাত্ এক বছরে রফতানি আয় বেড়েছে। নব্বই সালের পর থেকেই কানাডায় আমাদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রতি বছরই তা বেড়ে চলেছে। যদি আমরা আমদানির পরিসংখ্যান নেই, তাহলে আমরা দেখব ২০০৬-০৭ সময়সীমায় কানাডা থেকে আমদানি হয়েছে ১০৮০ কোটি ২৮ লাখ টাকার পণ্য। ২০০৫-০৬ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৩৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর অর্থ হচ্ছে আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। তবে সামগ্রিক বিচারে বাণিজ্যিক ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে। এক্ষেত্রে আমরা আগামীতে কানাডায় আরও পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার আশা করছি। আমাদের রফতানি আরও সম্প্রসারিত হওয়ার কথা। কিন্তু যেখানে কানাডার লিবারেল পার্টি সরকারের প্রতি অনাস্থা এনেছে, সেখানে সেই বিরোধী দলের কয়েকজন সিনিয়র এমপির সঙ্গে বৈঠক, কানাডার সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বাধ্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি একই সঙ্গে সরকারি দলের এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করতেন, তাহলে এ প্রশ্নটা উঠত না। এখানে হাই কমিশনারের ব্যর্থতাও চোখে লাগার মতো।
সরকারের বয়স ন’মাস। এই ন’মাস একেবারে কম সময় নয়। এই ন’মাসে আমরা কি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কোনো দিকনির্দেশনা পেয়েছি? এই দিকনির্দেশনাটি আসার কথা দীপু মনির কাছ থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক’ রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করার পরিবর্তে আমরা লক্ষ্য করলাম একটা ‘ভারত ঘেঁষা’ নীতি। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। পার্শ্ববর্তী দেশের উপর এর একটা প্রভাব থাকবেই। সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে সঠিক নীতিটি গ্রহণ করার মধ্যেই রয়েছে স্বার্থকতা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন জাতীয় স্বার্থের কথা। কিন্তু এশিয়ান হাইওয়ে কিংবা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না বলে আমার ধারণা। ভারতকে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার ব্যাপারেও নানা কথা উঠেছে এবং বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যাবে, তা কি আমাদের কাসল্টমস্ পরীক্ষা করতে পারবে? দুই. এসব যন্ত্রপাতির জন্য কি আদৌ কোনো কর পরিশোধ করা হবে? তিন. এসব যন্ত্রপাতি পরিবহন করবে কারা? চার. ভারি যন্ত্রপাতি আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে অবকাঠামো সুবিধা দরকার, তা কি আছে? রাস্তাঘাট কি বাংলাদেশকে তৈরি করতে হবে? মনে রাখতে হবে ভারতীয় হেভি ট্রাক চালানোর জন্য রাস্তা বাংলাদেশে নেই। পাঁচ. রাস্তাঘাট প্রশ্বস্ত করার সুযোগ যদি আমরা ভারতীয় প্রকৌশলীদের দেই, তাহলে ভবিষ্যতে ভারত যে, ‘দ্বিতীয়বার’ আর এ ধরনের সুযোগ চাইবে না, এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি কীভাবে? ছয়. এ ধরনের কোনো পরিবহন ব্যবস্থার উপর যদি উলফা গেরিলারা ‘আক্রমণ’ (?) করে (যার আশঙ্কা রয়েছে), তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? আমরা কি তাহলে আশুগঞ্জ-আগরতলা রুটে পাহারা বসাব? সেটা কি সম্ভব? এসব প্রশ্ন উঠবেই। ভালো হতো বিষয়গুলো যদি নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করা হতো, সংসদে আলোচনা হতো—তারপর না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নিতাম। সরকার এসব বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনার দিন ধার্য করলে, আমার বিশ্বাস বিএনপি তখন সংসদে আসত। বিএনপিকে সংসদে আনানোর এটি ছিল একটি মোক্ষম উপায়।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার জন্য ট্রানজিট দেয়া হবে। বাংলাদেশ ও নেপালের মাঝখানে ছোট্ট একখণ্ড ভূমি এই দু’টো দেশকে আলাদা করেছে। নেপালিরা দীর্ঘদিন চেয়ে আসছে এই সুযোগ। তারা মংলা পোর্টকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে ভারত ট্রানজিট দেয়নি। এখন দিলে আমরা খুশি হব। কিন্তু ভারতকে কি বিশ্বাস করা যায়? ৮০ লাখ পিচ শার্ট কেনার কথা বলেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আজও সেই শার্ট ভারতে যায়নি। অশুল্ক বাধার কথা আমাদের ব্যবসায়ীরা বার বার বলছেন। কিন্তু সেই অশুল্ক বাধা দূর হয়নি। তাই ঘাটতি বাড়ছে। বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। তখন এই ঘাটতি কমাতে না পারলে ভারত তো ট্রানজিটের সুবিধা চাবেই! ‘ট্রানজিট ফি’ দিয়ে ঘাটতি কমানো! চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহার করতে দেয়া! এসব দাবি অতীতে ভারতীয় হাই কমিশনাররা প্রকাশ্যেই করেছেন। এখন আমরা সেদিকেই যেতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ আমাদের অনেক পণ্য রয়েছে, যা রফতানি করে আমরা ঘাটতি কমাতে পারি। কিন্তু অসহযোগিতার কারণে আমাদের পণ্য ভারতে যাচ্ছে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরে আমি খুব একটা খুশি হতে পারিনি। ভারতের সঙ্গে আমাদের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে, যেসব সমস্যার ব্যাপারে ভারত কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি কখনও। বার বার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশীরা মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। টিপাইমুখ নিয়ে একটি যৌথ বিশেষজ্ঞ টিম গঠনেও রাজি হয়নি ভারত। সমুদ্রসীমায় আমাদের দাবি ভারত এখনও স্বীকার করে নিচ্ছে না। চুক্তি হয়েছিল গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে—কিন্তু পদ্মায় পানি নেই। রাজশাহীতে পদ্মার পাড়ে এখন মাইলের পর মাইল শুধুই বালু। ৬.৫ কি. মি. সীমান্ত চিহ্নিত হয়নি আজো। ৫১টি ছিটমহল আমরা আজও ফিরে পাইনি। দক্ষিণ তালপট্টিতে আমাদের অধিকার আজও স্বীকৃত হয়নি। এশিয়ান হাইওয়ের নামে আমরা ভারত থেকে ভারতে যাওয়ার রুট মেনে নিলাম। কিন্তু একবারও ভেবে দেখলাম না মিয়ানমার রুট আমাদের জন্য আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে বিশাল এক পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে পারে। আমরা শুধু ভারতীয় আশ্বাস পাচ্ছি বার বার। এবারও পেলাম। শুধু আশ্বাসেই কি আমরা খুশি থাকব?
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ুক—আমরা তা চাই। কিন্তু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়। দীপু মনি আশ্বাস দিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। হাজারটা যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু মূল যে প্রশ্ন, তার কোনো সমাধান হয়েছে বলে মনে হয় না। মূল প্রশ্নটাই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে ভারত থেকে ভারতে যাওয়া এশিয়ান হাইওয়ের মধ্য দিয়ে— এ প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন আমাদের জন্য মিয়ানমার ও চীন অনেক জরুরি। আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য চাহিদার অন্যতম উত্স হতে পারত মিয়ানমার। চীন তো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সঙ্গে নিয়েই ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভারত এককভাবে যেতে চায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। তার টার্গেট আশিয়ান। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় ব্যর্থতা। এখন চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক আটকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও আমরা ‘ইমেজ সঙ্কটে’ ভুগছি। শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের এখনও আশ্বাসের কথা শোনান। তিনি বিদেশ সফর করতে ‘ভালোবাসেন’, এটা আমরা জানি। মাসের কতদিন তিনি বাংলাদেশে থাকেন, এ প্রশ্ন আমি করব না। কিন্তু আমি চাই আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হোক। পররাষ্ট্র নীতিতে চাই নতুন উদ্দীপনা। ‘জলবায়ুু নিরাপত্তা’ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো উদ্বেগ এতে আছে বলে মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে কোনো ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত, যে কোনো ‘ভুল উদ্যোগ’, হিতে বিপরীত হতে পারে। আর এতে করে ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে দাতা গোষ্ঠীকে। কানাডায় লিবারেল পার্টির সঙ্গে তার বৈঠক ও মতবিনিময়ের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সঠিক হয়নি।
লেখক : নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক
No comments