শামসুল হকের পর আবদুল জলিল by মহিউদ্দিন খান মোহন
অবশেষে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল স্বীয় দল কর্তৃক পাগল হিসেবে আখ্যায়িত হলেন। গত ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন-আবদুল জলিল ভারসাম্যহীন ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তবে তার সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, নির্বাহী কমিটির সভায় আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোরালো দাবি ওঠে। এ সময় দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলিলের বিরুদ্ধে সময়মত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সর্বশেষ খবর হচ্ছে ব্যবস্থা একটা নেয়া হয়েছে। জলিল সাহেব বাদ পড়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ থেকে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে আবদুল জলিল দেশের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি নেত্রী ও দল সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করে যুগপৎ আলোচনার বিষয়বস্তু এবং দলের নেতাকর্মীদের একাংশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। আবদুল জলিলের অপরাধ হলো, তিনি গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গোমর ফাঁক করে দিয়েছেন। যে বিষয়টি সচেতন অনেকেরই জানা ছিল এবং দেশের অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করতেন, আবদুল জলিল সে বিষয়টি খোলাসা করেছেন মাত্র। তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কাজ করেছেন, একথা অনেকেই বলেছেন। তবে এটাও সত্যি, 'নীল নকশা'র নির্বাচনে আধা সামরিক জান্তা সরকারের কাছ থেকে বিজয়ের সনদ হাতিয়ে নেয়ার পর তিনি যদি বঞ্চিত না হতেন, তাহলে হয়তো এই নিরেট সত্য তার মুখ থেকে নিঃসৃত হতো না। গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কীভাবে জিতেছে, কারা কারা এই জেতার পেছনে 'চক্রবদ্ধ' হয়েছিল, আবদুল জলিলের তা ভালোভাবেই জানা থাকার কথা। কেননা, তিনি সে সময় দলটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সরকারের সঙ্গে সব গোপন-প্রকাশ্য সমঝোতা-অাঁতাত প্রক্রিয়ায় তার সংশ্লিষ্ট থাকাটাই স্বাভাবিক। খুব কাছ থেকে তিনি একটি নির্বাচনের জালিয়াতি শুধু প্রত্যক্ষই করেননি, ওই জালিয়াতি কারবারের একজন সক্রিয় পার্টনারও ছিলেন। সে কারণেই ওই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মঞ্চে ও নেপথ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ বিশেষ ঘটনার তিনি প্রধান সাক্ষীও বটে। সেই তিনি যখন নির্বাচনে 'সাগরচুরির' কাহিনী প্রকাশ করে দেন- তখন তা সঙ্গত কারণেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। আর এখানেই আওয়ামী লীগের গাত্রদাহের প্রধান কারণ নিহিত। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের জরুরি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি কারোরই অজানা ছিল না। কোন সমঝোতায় তারা ওই সরকারকে সমর্থনের ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছিল সেটাও অজানা থাকার কথা নয় কারও। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়ে এদেশে আধিপত্যবাদী শক্তির শিখন্ডি সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত দীর্ঘদিনের। দেশি-বিদেশি সে চক্রান্ত যখন সাফল্যের মুখ দেখল, তখনই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল আওয়ামী লীগ। ফখরুদ্দীনের সরকারকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে সগর্বে ঘোষণা করে শেখ হাসিনা শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দেশ ও গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে তিনি এবং তার দলও অংশীদার। এ অংশীদারিত্ব অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। কেননা, দেশাত্মবোধের চেয়ে দলীয় এবং ব্যক্তিস্বার্থ যাদের কাছে বড়, তারা যে কোনো সময় যে কোনো ভূমিকায় নামতে পারে। বিদেশি অপশক্তির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে এদের বিবেকেও যেমন বাঁধে না, তেমনি লজ্জাও করে না। 'কানে গুঁজেছি তুলো, আর পিঠে বেঁধেছি কুলো' নীতিকে অবলম্বন করে এরা আপন মনে প্রভুর নির্দেশ পালন করে যায়। সমালোচনা, নিন্দা এদের গায়ে লাগে না। সে যাই হোক, আবার গোড়ার কথায় ফিরে আসি। একজন মানুষকে 'ভারসাম্যহীন' হিসেবে ঘোষণা করতে পারে শুধু চিকিৎসক। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলে দিতে পারেন লোকটি সুস্থ না মানসিক রোগী। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিপূর্ণ কিনা আমাদের জানা নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উদ্ধৃতিও দেননি এ বিষয়ে। সে হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি নিজ দায়িত্বেই ঘোষণাটি দিয়েছেন। আবদুল জলিল প্রকৃতই মানসিক ভারসাম্যহীন কিনা, সেটা চিকিৎসকরাই নিশ্চিত করতে পারবেন। তার উত্তরসূরি তাকে যে অভিধায় অভিহিত করেছেন সে সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়াও এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে যেহেতু সৈয়দ আশরাফ দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের একজন প্রবীণ নেতাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে ঘোষণা করেছেন, তাহলে এটা ধরে নেযা যায় যে, এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। এখন আবদুল জলিলের এই কথিত 'ভারসাম্যহীনতা'র বিষয়টি প্রমাণ করার দায়িত্বও তাদের। সৈয়দ আশরাফের এই তথ্য দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। কেননা, আবদুল জলিল সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় মাপের রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য তিনি। এই সেদিনও ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। একজন মানসিক রোগী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো পদে থাকতে পারেন কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে সদস্যপদ প্রাপ্তি ও সদস্যপদ হারানোর বিধান রয়েছে। তাতে উন্মাদ, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্য নন বলে উল্লেখ থাকে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও সেরকমই হয়তো উল্লেখ আছে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে দলের সদস্য রাখবে কোন যুক্তিতে, তাও ভেবে দেখা দরকার। আবদুল জলিল এখন আওয়ামী লীগের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছেন, এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। অথচ এই আবদুল জলিলই এক সময় তাদের গলার মালা ছিলেন। তখন আবদুল জলিলের কথায় মধু ঝরত! আর এখন হয়েছে তা নিমের মতো তেঁতো। মনে পড়ে, ২০০৫ সালে এই আবদুল জলিল যখন ৩০ এপ্রিলের 'ডেডলাইন' ঘোষণা করে 'ট্রাম্পকার্ড' ছাড়ার কথা বলেছিলেন- এই আওয়ামী শিবিরেই তখন বয়ে গিয়েছিল আনন্দের বন্যা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তখন 'জলিল ভাই'কে মাথায় তুলে নাচার অবস্থা। ৩০ এপ্রিলের 'ট্রাম্পকার্ড' মিশন যখন ফেল মারল, তখনই অনেকে আবদুল জলিলের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সে সময় যদি জলিল সাহেবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হতো, তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। আবদুল জলিলের আজকের অবস্থা দেখে আওয়ামী লীগের আরেকজন সাবেক সাধারণ সম্পাদকের কথা অনেকেরই মনে পড়ে থাকবে। তিনি টাঙ্গাইলের শামসুল হক। অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ এই নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। তার পদটি দখল করার জন্য সে সময় একটি চক্র কীভাবে তাকে দল থেকে বিতাড়িত এবং পাগল বানিয়ে ছেড়েছিল সে ইতিহাস এদেশের কমবেশি সবারই জানা। সম্প্রতি মরহুম শামসুল হকের কবর আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে নানান তথ্য। তাকে পাগল বানানোর নেপথ্যে যারা ছিলেন- আজ আবদুল জলিলকে মানসিক ভারসাম্যহীন ঘোষণার পেছনে তাদেরই উত্তরসূরিরা প্রধান কুশীলবের ভূমিকা পালন করছে। আমার মতো অনেকেই চিন্তিত এই ভেবে যে, আবদুল জলিলকেও শেষ পর্যন্ত শামসুল হকের ভাগ্য বরণ করতে হয় কিনা। কারণ, আওয়ামী লীগ সেই দল-যা প্রয়োজনে যাকে কোলে টেনে নেয়, আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো ছুড়ে ফেলে দেয়। দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আবদুল জলিল নাটকের শেষ অংকের শেষ দৃশ্যটি দেখার জন্য।
No comments