ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ শান্তি প্রক্রিয়ার পথে প্রধান অন্তরায় by আহমেদ জামিল
সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্য তথা ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করার জন্য দু'নেতার ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেন।
বিশ্লেষকদের কারও কারও অভিমত, পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করতে চান না। বাহ্যিকভাবে হলেও প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির কৌশল নিয়েছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওবামা গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পরই মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠাকে তার প্রধান অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করেন। এর কারণ হলো প্রেসিডেন্ট ওবামা তার পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশের জামানায় মুসলিম জাহান বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃত ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, অতি ইসরাইল ঘেঁষা নীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব এবং বেশিরভাগ মুসলিম বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রায় সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়েছে জানি দুশমন ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব জাহানে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন তথা পেন্টাগন। যে কারণে ওবামা প্রশাসন চাইছে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের দ্রুত সমাধান। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেমস জোনস এবং মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ মার্কিন দূত জর্জ মিচেলকে মধ্যপ্রাচ্য সফরে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু ওবামা, নেতানিয়াহু ও আব্বাসের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মতোই বিশিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তাদের ওইসব সফরও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত আরবদের এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণের প্রশ্নে ইসরাইল সরকারের একগুঁয়েমি এবং অনমনীয়তার কারণে। অধিকৃত এলাকায় বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের সুসপষ্ট লঙ্ঘন। ওবামা প্রশাসন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকে বসতি নির্মাণ এবং সম্প্রসারণ বন্ধে ইসরাইল সরকারকে বারংবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তেলআবিব তার প্রতি কোনো কর্ণপাতই করছে না। যা হোক, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট আব্বাস ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উদ্দেশে রোডম্যাপ নামে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বরাবর বসতি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় ওবামা, নেতানিয়াহু ও আব্বাসের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ব্যর্থ হয়। বৈঠকের আগে নেতানিয়াহু এবিসি টেলিভিশনকে বলেছিলেন, তিনি নতুন বসতি স্থাপন বন্ধের অঙ্গীকার করবেন, তবে ইতোমধ্যে স্থাপিত বসতি বিস্তার রোধে রাজি হবেন না। অর্থাৎ বসতি নির্মাণ ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অনমনীয়তা ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর প্রয়াসকে আবারও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিল। শুরু থেকেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বসতি নির্মাণ এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কঠোর মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ক্ষমতায় বসার পরপরই কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন, পশ্চিমতীর, গাজা উপত্যকার অধিকৃত ভূখন্ডে এবং পূর্বজেরুজালেমে ২০০৫ সাল থেকে শুরু করা ইহুদি বসতি কখনই সরানো হবে না। ইসরাইল সরকার ইতোমধ্যে পূর্বজেরুজালেমে বহু ফিলিস্তিনি পরিবার উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কাজ জোরেশোরে শুরু করেছে। অথচ ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনার অন্যতম শর্ত হলো, ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসত নির্মাণ বন্ধ করা। পশ্চিমতীর, পূর্বজেরুজালেম এবং গাজা হলো ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকা; যা ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের অংশ। এই অংশ নিয়েই ভবিষ্যৎ স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা। ১৯৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে মরহুম ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে ইসরাইলের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি মোতাবেক অধিকৃত গাজা ও জেরিকো হবে ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের অংশ। এই চুক্তি মতে, অধিকৃত ভূখন্ড থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, পশ্চিম তীর এবং পূর্বজেরুজালেম সবই এক সময় জর্ডানের অংশ ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। অন্যদিকে, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত পূর্বজেরুজালেম ছিল জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৬৭'র আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইল এটিও কব্জা করে। আরবদের মতে, ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ওয়াশিংটন শান্তি চুক্তির ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্বজেরুজালেম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠবে; কিন্তু ইসরাইল যে কোনো মূল্যে পূর্বজেরুজালেমে তার অবৈধ দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অতীতের ইসরাইল সরকারগুলো ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তাদের কেউই তা বাতিলের কোনো ঘোষণা দেয়নি কখনই। কিন্তু বর্তমান লিকুদ দলীয় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এই ইস্যুতে তার কট্টরপন্হী অবস্থানের কথা গোপন করেননি কখনও। নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের পেছনে ন্যাচারাল গ্রোথ বা ইহুদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির দোহাই দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে কিছু যুক্তির অবতারণা করেছে। এ প্রসঙ্গে লন্ডন স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান ষ্টাডিজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাক খান বিবিসিকে বলেছিলেন, ইসরাইলের ভেতরে এখন প্রায় শতকরা ২০ ভাগ ফিলিস্তিনি রয়েছে। যারা ইতোমধ্যে ইসরাইলের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে। যে কারণে যারা দক্ষিণপন্হী জায়েনিষ্ট ইহুদি তারা বলছে, আমরা অধিকৃত এলাকা থেকে সরে এলেও, আমাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই বিভিন্ন ইসরাইলি সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকা থেকে সরে আসা হবে; কিন্তু এর পেছনে ইসরাইলের অভ্যন্তরে শক্ত কোনো জনমত নেই। অধ্যাপক মুস্তাক খান এ প্রসঙ্গে বলেন, যত দিন না ইসরাইল নিজেকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে নাগরিকভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করছে, ততদিন পর্যন্ত এ সঙ্কটের সমাধানের সম্ভাবনা কম। শুধু ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণের ইস্যুই নয়, ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়েও মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটকে আরও গভীর করে তুলেছেন। প্রথমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উড়িয়ে দিলেও, অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যে অসামরিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, তার সত্যিকারার্থে 'সার্বভৌমত্ব' বলে কোনো কিছুই থাকবে না। আর দখলিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণ এবং সম্প্রসারণও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়। সেই সঙ্গে এসব এলাকায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনি জনগণও নিজ বাসভূমে পরবাসীর মতো হয়ে আছে। ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণের প্রশ্নে নেতানিয়াহু সরকারের কঠোর অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে আরও একঘরে করে তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এই ইস্যু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কেরও কিছুটা হলেও অবনতি ঘটিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত বিকাশমান সামরিক শক্তি ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন কট্টরপন্হী ফিলিস্তিনি গ্রুপসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রভিত্তিকর্ যাডিক্যাল সংগঠনের দৌরাত্ম্যও বেড়ে যেতে পারে। ফলে ইসরাইলের নিরাপত্তার শঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাবে। হিজবুল্লাহ এবং হামাসের হাতে সাম্প্রতিক সময়ে সামরিকভাবে নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখে পিসনাউ মুভমেন্টের মতো শান্তিবাদী ও মানবাধিকারকামী ইসরাইলি সংগঠনগুলো অবিলম্বে ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। এমন কি পশ্চিমতীরে বসতি স্থাপনে ইসরাইলের মন্ত্রিপরিষদেও দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে। এ কথাও তো সত্য যে, ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে ওবামা প্রশাসনও আরব বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট বজায় থাকলে এবং তা আরও তীব্র হলে ইসরাইলের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাও বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। আরও ৯/১১ ঘটতে পারে সেখানে। তাই সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলকে ফিলিস্তিনসহ সব আরব দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান সূত্র উপস্থাপন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
No comments