অর্থসঙ্কটে বেহাল সরকার by সৈয়দ মিজানুর রহমান
অর্থ সঙ্কটে বেহাল অবস্থার মধ্যে পড়েছে সরকার। মাসে হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ দিয়েও অবস্থা সামাল দেয়া যাচ্ছে না। দাতারাও ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে রেমিট্যান্স। রফতানি আয়ও আনুপাতিক হারে কমছে। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি এবং ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে সরকার। শেষ পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারকে হাত পাততে হচ্ছে ‘সার্বভৌম বা সভরেন লোনের’ ওপর। বিপজ্জনক এই ঋণ নিয়েও ইউরোপের দেশগুলো তাদের অর্থনীতি সামাল দিতে পারেনি।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, কোনো দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে গেলে বা এমন লক্ষণ দেখা দিলেই কেবল এই ঋণের দিকে সরকার হাত বাড়ায়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান মনে করেন, সভরেন খুব বিপজ্জনক লোন। এ ধরনের ঋণ সাধারণত খুব কম সময়ের (শর্ট টাইম) জন্য নেয়া হয়। ফেরত দেয়ার সময় খুব সীমিত। তাই অনেক সময় এ ধরনের ঋণ ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ে যেতে হয় বিভিন্ন দেশকে। সভরেন লোনের একটি বড় ব্যাপার হলো, এ ধরনের ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। সুতরাং ঋণ নিয়ে কোন খাতে ব্যয় করা হবে তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। যে খাতে এ ধরনের ঋণের টাকা ব্যবহার করা হবে তা থেকে যদি উচ্চ হারে রিটার্ন না আসে তবে আর্থিক ভারসাম্যহীনতা বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার যদি ঋণের টাকা সময় মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তবে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং নিচে নেমে যাবে। ফলে আর্থিক অবস্থার আরও অবনতি হবে।
এ বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে সভরেন লোন করা ঠিক হবে না। কারণ এমনিতেই এখন বিশ্ববাজারে বন্ড মার্কেট বেশ অস্থিতিশীল। এখন যদি সরকার বিদেশে বন্ড ছেড়ে সভরেন লোন করতে যায় তবে সুদ গুনতে হবে অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে আর্থিক চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, সভরেন লোন না করে বৈদেশিক ঋণের যে ১৩ বিলিয়ন ডলার পাইপ লাইনে পড়ে রয়েছে তা কিভাবে ছাড় করা যাবে সে ব্যবস্থা করা দরকার। আর অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেডিট রেটিং নির্ধারণী সংস্থা (মুডি) বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিংয়ের অবস্থান জানাবে। তার আগে বিশ্বের বর্তমান অস্থিতিশীল বন্ড মার্কেটে প্রবেশ করা উচিত হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দেশের অর্থনীতি যে ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং সরকার যে পুরোপুরি ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে- তা কয়েক মাস আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এর মধ্যে অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানও স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলেন সরকার ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ড. আতিউর দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বিদেশি উত্স (দেশের বাইরের বাংক ও আর্থিক খাত) থেকে ঋণ সংগ্রহের। তবে সেই ডাকে ব্যবসায়ীদের সাড়া এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার আগেই সরকারই হাত বাড়িয়েছে বিদেশের উত্স থেকে ঋণ করতে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ব্যাপক হারে ভর্তুকি ও সরকারের কিছু উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার স্থানীয় ব্যাংকের সব টাকাই নিয়ে নিচ্ছে। গত তিন মাসে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এখন ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় সামনের মাসগুলোতে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে আর খুব একটা টাকা পাবে না এটা অনেকটা নিশ্চিত। তবে আগামী মাসগুলোতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ খাতসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের খরচ আরও বাড়বে। ভর্তুকির এই চাপ ও সরকারের দৈনন্দিন কাজ চালাতে বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ চলছে। এর আগে বাংলাদেশ আর কখনও এ জাতীয় বাণিজ্যিক ঋণ বিদেশ থেকে নেয়নি।
জানা গেছে, সার্বভৌম ঋণ নিতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ও এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একটি বিদেশি ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিবের কাছে এ ঋণ প্রস্তাবও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলারের ঋণের জন্য বাংলাদেশ বন্ড ছাড়তে যাচ্ছে। ১০ বছরের জন্য সরকার এই ঋণ করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ও রাজস্ব ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষ করে কুইক রেন্টাল খাতে সরকারকে গুনতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। তবে এই টাকার জোগান রাজস্ব খাত থেকে সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে বিদেশি সাধারণ ঋণ ও সহায়তাও প্রত্যাশিত হারে পাচ্ছে না সরকার। কমে গেছে রেমিট্যান্স। রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও আবার ঋণাত্মক ধারায়। অর্থ বছরের শুরুতেই ব্যাংক ঋণের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। সরকার ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নিট ১০ হাজার ৯০০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ঋণ করেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৬ হাজার ১২৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে এভাবে আর অর্থ জোগান সম্ভব নয়।
অন্যদিকে অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ১৮ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। তবে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ শতাংশ।
এ সময়ে বিদেশি-সহায়তা ছাড়ের পরিমাণ গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। এ সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা ১৪২ কোটি ৮০ লাখ ডলার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ হিসাবে তিনমাসে প্রতিশ্রুতির মাত্র ১৭ শতাংশ অর্থ ছাড় দিয়েছে দাতারা। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ইআরডি জানায়, গত বছরের একই সময়ে ১৪ কোটি ৪২ লাখ ডলারের অনুদান ও ১৬ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের ঋণসহ মোট সহায়তা এসেছিল ৩১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত বছরের একই সময়ের চাইতে বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তি ২২ শতাংশ কমে গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দাতারা সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগ খাতে বেশ কয়েকটি প্রকল্পসহ পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। যথাযথ কাজ না করেই এ সব প্রকল্প থেকে তুলে নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে, এর ফলে জাতীয় বাজেটে নেয়া সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এর ফলে সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গিয়ে নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারবে বলেও তারা মনে করেন।
ইআরডি জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১১১ কোটি ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার। আর ৩০ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান প্রতিশ্রুতির বিপরীতে অর্থছাড় হয়েছে ১১ কোটি ২৭ লাখ ডলার। ঋণ ও অনুদান মিলে এ সময়ে ১৪২ কোটি ৮০ লাখ ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ছাড় হয়েছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতিশ্রুতি থাকলেও এ সময়ে দাতারা ১১৮ কোটি ১৮ লাখ ডলার কম অর্থছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৯৪৮ কোটি ৫৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
এসব কারণে সরকার এখন শুধু দাতাদের দিকে না তাকিয়ে থেকে বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে স্বল্প মেয়াদে ঋণ নিতে যাচ্ছে। সার্বভৌম ঋণের ক্ষেত্রে সুদ গুনতে হয় কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। অন্যদিকে দাতাদের ঋণে সুদ গুনতে হয় সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ শতাংশ। আর দাতাদের ঋণের মেয়াদ হয় ২৫ থেকে ৪০ বছর। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার স্বল্প মেয়াদে ও চড়া সুদে যে ঋণ নিতে চাইছে তার দায় পড়বে পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে। অন্যদিকে দেশের সামর্থ্যের বিষয়টিও অনিশ্চিত। ফলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন কোনো দেশের অর্থনীতি দেউলিয়ার পথে হলেই এ ধরনের ঋণের দিকে সরকার হাত বাড়ায়।
এ বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে সভরেন লোন করা ঠিক হবে না। কারণ এমনিতেই এখন বিশ্ববাজারে বন্ড মার্কেট বেশ অস্থিতিশীল। এখন যদি সরকার বিদেশে বন্ড ছেড়ে সভরেন লোন করতে যায় তবে সুদ গুনতে হবে অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে আর্থিক চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, সভরেন লোন না করে বৈদেশিক ঋণের যে ১৩ বিলিয়ন ডলার পাইপ লাইনে পড়ে রয়েছে তা কিভাবে ছাড় করা যাবে সে ব্যবস্থা করা দরকার। আর অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেডিট রেটিং নির্ধারণী সংস্থা (মুডি) বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিংয়ের অবস্থান জানাবে। তার আগে বিশ্বের বর্তমান অস্থিতিশীল বন্ড মার্কেটে প্রবেশ করা উচিত হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দেশের অর্থনীতি যে ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং সরকার যে পুরোপুরি ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে- তা কয়েক মাস আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এর মধ্যে অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানও স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলেন সরকার ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ড. আতিউর দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বিদেশি উত্স (দেশের বাইরের বাংক ও আর্থিক খাত) থেকে ঋণ সংগ্রহের। তবে সেই ডাকে ব্যবসায়ীদের সাড়া এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার আগেই সরকারই হাত বাড়িয়েছে বিদেশের উত্স থেকে ঋণ করতে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ব্যাপক হারে ভর্তুকি ও সরকারের কিছু উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার স্থানীয় ব্যাংকের সব টাকাই নিয়ে নিচ্ছে। গত তিন মাসে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এখন ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় সামনের মাসগুলোতে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে আর খুব একটা টাকা পাবে না এটা অনেকটা নিশ্চিত। তবে আগামী মাসগুলোতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ খাতসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের খরচ আরও বাড়বে। ভর্তুকির এই চাপ ও সরকারের দৈনন্দিন কাজ চালাতে বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ চলছে। এর আগে বাংলাদেশ আর কখনও এ জাতীয় বাণিজ্যিক ঋণ বিদেশ থেকে নেয়নি।
জানা গেছে, সার্বভৌম ঋণ নিতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ও এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একটি বিদেশি ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিবের কাছে এ ঋণ প্রস্তাবও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলারের ঋণের জন্য বাংলাদেশ বন্ড ছাড়তে যাচ্ছে। ১০ বছরের জন্য সরকার এই ঋণ করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ও রাজস্ব ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষ করে কুইক রেন্টাল খাতে সরকারকে গুনতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। তবে এই টাকার জোগান রাজস্ব খাত থেকে সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে বিদেশি সাধারণ ঋণ ও সহায়তাও প্রত্যাশিত হারে পাচ্ছে না সরকার। কমে গেছে রেমিট্যান্স। রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও আবার ঋণাত্মক ধারায়। অর্থ বছরের শুরুতেই ব্যাংক ঋণের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। সরকার ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নিট ১০ হাজার ৯০০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ঋণ করেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৬ হাজার ১২৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে এভাবে আর অর্থ জোগান সম্ভব নয়।
অন্যদিকে অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ১৮ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। তবে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ শতাংশ।
এ সময়ে বিদেশি-সহায়তা ছাড়ের পরিমাণ গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। এ সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা ১৪২ কোটি ৮০ লাখ ডলার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ হিসাবে তিনমাসে প্রতিশ্রুতির মাত্র ১৭ শতাংশ অর্থ ছাড় দিয়েছে দাতারা। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ইআরডি জানায়, গত বছরের একই সময়ে ১৪ কোটি ৪২ লাখ ডলারের অনুদান ও ১৬ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের ঋণসহ মোট সহায়তা এসেছিল ৩১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত বছরের একই সময়ের চাইতে বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তি ২২ শতাংশ কমে গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দাতারা সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগ খাতে বেশ কয়েকটি প্রকল্পসহ পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। যথাযথ কাজ না করেই এ সব প্রকল্প থেকে তুলে নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে, এর ফলে জাতীয় বাজেটে নেয়া সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এর ফলে সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গিয়ে নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারবে বলেও তারা মনে করেন।
ইআরডি জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১১১ কোটি ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার। আর ৩০ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান প্রতিশ্রুতির বিপরীতে অর্থছাড় হয়েছে ১১ কোটি ২৭ লাখ ডলার। ঋণ ও অনুদান মিলে এ সময়ে ১৪২ কোটি ৮০ লাখ ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ছাড় হয়েছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতিশ্রুতি থাকলেও এ সময়ে দাতারা ১১৮ কোটি ১৮ লাখ ডলার কম অর্থছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৯৪৮ কোটি ৫৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
এসব কারণে সরকার এখন শুধু দাতাদের দিকে না তাকিয়ে থেকে বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে স্বল্প মেয়াদে ঋণ নিতে যাচ্ছে। সার্বভৌম ঋণের ক্ষেত্রে সুদ গুনতে হয় কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। অন্যদিকে দাতাদের ঋণে সুদ গুনতে হয় সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ শতাংশ। আর দাতাদের ঋণের মেয়াদ হয় ২৫ থেকে ৪০ বছর। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার স্বল্প মেয়াদে ও চড়া সুদে যে ঋণ নিতে চাইছে তার দায় পড়বে পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে। অন্যদিকে দেশের সামর্থ্যের বিষয়টিও অনিশ্চিত। ফলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন কোনো দেশের অর্থনীতি দেউলিয়ার পথে হলেই এ ধরনের ঋণের দিকে সরকার হাত বাড়ায়।
No comments