যুক্তরাষ্ট্র ইরানের মুখোমুখি অবস্থান কি অর্থ বহন করে আফগানিস্তানের জন্য

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনার মাত্রা আরেক দফা বেড়ে গেছে যখন ২০ জুন ইরান যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন ভূপাতিত করে। ওমান উপসাগরে একটি তেল ট্যাঙ্কারকে হামলার দায়ে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের দোষারোপ করার পর ওই ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনা ঘটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরে দাবি করেন যে, তিনি ইরানের উপর পাল্টা হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে কেউ হতাহত না হওয়ায় সে আদেশ তিনি ফিরিয়ে নেন। তবে, ভবিষ্যতে ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হামলার আশঙ্কা পুরোপুরি বাতিল করেননি ট্রাম্প। এবং সবশেষ ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর দুই দেশের এই মুখোমুখি অবস্থান হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচলকে ব্যাহত করবে যেটার যথেষ্ট প্রভাব পড়বে আফগানিস্তান ও এই অঞ্চলের উপর এবং এমনকি এই অঞ্চলের বাইরেও।
উত্তেজনাপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক সম্ভবত সঙ্ঘাতের দিকে যাচ্ছে এবং ইরানের উপর অব্যাহত প্রবল চাপের একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বে আফগানিস্তানের উপর। স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবে ট্রানজিট রুটের জন্য পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে তাদের ট্রানজিট বাণিজ্যের সম্পর্কও টালমাটাল হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগানিস্তান ইরানের বন্দর নগরী বন্দর-ই-আব্বাসে তাদের ট্রানজিট রুট সরিয়ে নিয়ে গেছে। হিসেবে দেখা গেছে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে আফগানিস্তান যে ট্রানজিট বাণিজ্য করতো সেটা ২০০৮-০৯ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। কিন্তু সেটা ২০১৬ সালে কমে ৩০ শতাংশে চলে এসেছে। অন্যদিকে ইরানের ভেতর দিয়ে আফগানিস্তানের বাণিজ্যের পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে আফগানিস্তান এমনকি ইরান থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য নিজস্ব পরিবহন লাইন স্থাপনের জন্যও কাজ করছে। ইরান থেকে তেল আমদানির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পাচ্ছে আফগানিস্তান। কিন্তু ইরানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের যে ট্রানজিট বাণিজ্য, সেটা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে, কারণ কোন ছাড়ই পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে পারবে না।
এই পরিস্থিতি থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার রয়েছে আফগানিস্তানের। ইরানের বন্দর ই আব্বাসের দিকে ট্রানজিট বাণিজ্য স্থানান্তরিত হওয়ার কারণ ছিল দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অতি ব্যয়বহুল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অদক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, এবং পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের অবৈধ ফি আদায়। ২০১৫ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পর এই মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে, উত্তরাধিকার সূত্রে আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট করিডোর প্রকল্প হাতে পান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি – যেটা হলো চাবাহার ও লাপিস লাজুলি। দুটি প্রকল্পই কার্যকর হতে যেখানে অনেক সময় লাগবে, তার পরও আফগান প্রেসিডেন্ট এই বাণিজ্যের স্থানান্তরকে বড় অর্জন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন যে, ট্রানজিটের জন্য আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল নয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থেকে এটাও বোঝা গেছে যে, ট্রানজিট বাণিজ্যের জন্য ইরানের উপর নির্ভর করলে সেখানেও বিপদ রয়েছে। তার বদলে, এখনই সময় কাবুল আর ইসলামাবাদের ভেতরকার সমস্যা মিটিয়ে ফেলার। আফগানিস্তান-পাকিস্তান ট্রানজিট ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এপিটিটিএ) স্বাক্ষরিত হয় ২০১০ সালে। এবং প্রয়োজন হলে দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে পাঁচ বছরের মধ্যে সেটা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। এপিটিটিএ’র প্রধান বিধানগুলো কঠোর ও অনৈতিক ছিল। ফলে আফগানিস্তানের জন্য ট্রানজিট বাণিজ্যটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে। এপিটিটিএ’র শর্তগুলো নিয়ে পুনরায় দর কষাকষি করা প্রয়োজন যাতে আফগানিস্তানের ট্রানজিট রুটটা সংক্ষেপ হয় এবং ইরানের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে আফগানিস্তান যাতে কোন সমস্যায় না পড়ে।
হরমুজ প্রণালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা ভাবলে, এবং ওয়াশিংটন থেকে যে বার্তা আসছে, তাতে আগামীতে দুই দেশের মুখোমুখি অবস্থানের তীব্রতা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হলে এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের উত্তেজনা আরও বাড়লে সেটা নিশ্চিতভাবে আফগানিস্তানের, এই অঞ্চলের এবং এমনকি এই অঞ্চলের বাইরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

No comments

Powered by Blogger.