শেষ দিনে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে ভিড়: ১০ শতাংশ উৎসে কর বহালই থাকলো

সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ শতাংশ প্রস্তাব রেখেই অর্থবিল, ২০১৯ পাস হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি প্রত্যাহার হয়নি। আগের মুনাফা ৩০শে জুনের মধ্যে না উত্তোলন করলে বাড়তি কর কেটে নেয়া হবে। এ কারণে গতকাল অর্থবছরের শেষ কার্যদিবসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে গ্রাহকদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এছাড়া রাজধানীর গুলিস্তানের জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও) ও সোনালী ব্যাংকেও ভিড় দেখা গেছে। সব জায়গায় ছিল গ্রাহকের দীর্ঘ লাইন। এতে সেবা দিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে হিমশিম খেতে হয়েছে।
প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর বাড়ানোর ঘোষণার পরই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
জানা গেছে, গত ১৩ই জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর থেকে যেসব বিষয়ে বেশি আলোচনা সমালোচনা হয়েছে সেগুলো হলো- বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে টিআইএন নম্বর বাধ্যতামূলক করা এবং সঞ্চয়পত্রের উৎসে করহার বৃদ্ধির প্রস্তাব। আগে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের মুনাফার ওপর উৎসে কর (চূড়ান্ত দায়) দিতে হতো ৫ শতাংশ, নতুন অর্থবছর থেকে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ দুটি বিষয়ে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটের প্রস্তাবই বহাল রাখা হয়েছে পাসকৃত অর্থবিলে।
উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, শেষ পর্যন্ত করহারে পরিবর্তন করা হয় নাই। তাই ১লা জুলাই থেকে বর্ধিত হারে উৎসে কর কাটা শুরু হবে। পুরোনো গ্রাহকদের যারা ১লা জুলাইয়ের পর মুনাফা তুলতে যাবেন, তাদেরও এই বাড়তি কর দিতে হবে। অনেক গ্রাহক আছেন, যারা নিয়মিত মুনাফা না তুলে কয়েক মাস পর একবারে তোলেন। তারাও ১লা জুলাইয়ের আগে মুনাফা তুলতে এসেছেন। এ কারণেই বিভিন্ন ব্যাংক, ডাকঘরে মুনাফা তুলতে গ্রাহকের উপচে পড়া ভিড়। এদিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে সাধারণ করদাতারা নির্দিষ্ট হারে কর রেয়াত-সুবিধা পান। তাই কর রেয়াত-সুবিধা নিতে অনেক করদাতা ১লা জুলাইয়ের আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন।
মতিঝিলের একাধিক ব্যাংক ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই সঞ্চয়পত্র কেনা, মুনাফা উত্তোলনের জন্য গ্রাহকের দীর্ঘ লাইন। যাদের বেশির ভাগই প্রবীণ ও মহিলা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে দেখা গেছে, মুনাফা তুলতে দীর্ঘ ৪টি সারিতে দাঁড়ানো কয়েক হাজার গ্রাহক। এক কর্মকর্তা বলেন, আগে দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ জনকে সেবা দেয়া হতো। বাজেট ঘোষণার পর প্রতিদিন সেবা নিতে আসছেন ৫ হাজারের বেশি গ্রাহক। যারা চারটার মধ্যে টোকেন নিতে পারছেন, তাদের সবাইকে সেবা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে কথা হয় মিরপুরের বাসিন্দা মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিবার সঞ্চয়পত্রে তার ১০ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতি মাসেই মুনাফা পেলেও তা উত্তোলন করেন ছয় মাস পরপর। জুলাইয়ে মুনাফা উত্তোলন করলে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। তাই আগে ভাগেই সব মুনাফা তুলতে এসেছেন তিনি।
দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন আমিনুল ইসলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের নিচতলায় অপেক্ষা করছিলেন মুনাফার টাকা তোলার জন্য। তিনি বলেন, পেনশন থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখে ছিলেন। সঞ্চয়পত্রের মুনাফাই এখন তার পরিবারের আয়ের বড় উৎস। তিনি বলেন, গ্রামের বাড়িতে সামান্য জমি আছে। সেখানে কিছু ফসল হয়। আর নগদ আয় বলতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। এই দিয়েই সংসার চলে। শুনেছি ৩০শে জুনের পর থেকে বাড়তি কর কাটবে ব্যাংক। এ কারণে মুনাফার টাকা তুলতে এসেছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেকে সময়মতো মুনাফা উত্তোলন করেন না। কর বাড়ানো হবে, এমন খবরে সবাই মুনাফা তুলে ফেলছেন। আবার অনেকে নতুন করেও সঞ্চয়পত্র কিনছেন। এর ফলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গ্রাহকের চাপ বেশি।
মতিঝিলের সোনালী ব্যাংকের নিচতলায় ক্যাশ কাউন্টারে কথা হয় সেলিম উদ্দিনের সঙ্গে। ষাটের বেশি বয়সী এই লোকটিও এসেছেন মুনাফার টাকা তুলতে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ কমাল না, কিন্তু আয়ের ওপর কর বাড়াল। আমার পরিবার চলেই এই টাকার ওপর। সরকার এখানে কর না বসালেও পারত।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে ১১ শতাংশ করে সুদ নির্ধারণ করা আছে। প্রতি তিন মাস পর এই সুদ বা মুনাফা বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী, প্রবাসী বাংলাদেশিসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ এই সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করে বলে জানা গেছে। অনেক অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীর আয়ের একমাত্র উৎস এই সঞ্চয়পত্র। এই টাকাতেই তাদের সংসার চলে। এ কারণে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বাড়তি কর আরোপ করায় এসব সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা কাজ করছে।

No comments

Powered by Blogger.