হাসিনা কি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করছেন? -দ্য স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয়

৩০শে জুনের দ্য স্টেটসম্যান থেকে: ১লা জুলাই থেকে ৫ই জুলাই পর্যন্ত বহুল প্রচারিত ও প্রত্যাশিত সফরে চীনে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর শেষের দিকে নির্বাচনে বড় বিজয়ের পর তিনি দৃশ্যত রাজনৈতিক নিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন বলে মনে হয়।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন নেতা বা নেত্রীর মর্যাদাকে ব্যাপক হারে দেয়া ম্যান্ডেট জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি করে। এই ব্যতিক্রমী বিজয়কে সঙ্গে করে, এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছে, এ অবস্থায় হাসিনা গত ৬ মাসে বেশ কিছু দেশ সফর করেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার ‘কাউন্ডারপার্টস’দের সঙ্গে যখন আলোচনা করেছেন তখন তার ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ ইঙ্গিত দিয়েছে, তার আস্থা বাড়ছে এবং দেশের ভিতরে সব অসন্তোষ ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
২৮ শে জুন ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। এতে তিনি এরই মধ্যে শেখ হাসিনার বহুল প্রচারিত চীন সফর নিয়ে আরো কিছু আশা যোগ করেছেন। এতে মনে হতে পারে, চীনের কাছে এমন অনুভূতি পাঠানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ যে, দুই দেশ এরই মধ্যে বিশেষ এক সম্পর্ক উপভোগ করছে এবং প্রস্তাবিত এই সফর তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো জোরালো করবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হাসিনার সফরসঙ্গী মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাবেন উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা বেইজিং থাকা অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে ৮টি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হবে। এগুলো মূলত বিদ্যুত খাতকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও দুই পক্ষ ব্রহ্মপুত্র নদ সহ নদী সংক্রান্ত বিষয়েও আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আরো খাত অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ঋণ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার প্রধান ফোকাস হতে পারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার যাতে ফেরত নেয় তার বোধোদয়ের জন্য চীনকে চেষ্টা করতে এবং মিয়ানমারকে এ বিষয়ে চীন যেন চাপ দেয়। এসব রোহিঙ্গাকে ২০১৭ সালের আগস্টে সামরিক নৃশংসতার পর বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এখন এসব শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৭ লাখ পেরিয়ে গেছে। চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে অসাধারণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান। সেখানে এটা হবে এক দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জ। তবু বাংলাদেশ আশা করে যে, তার পক্ষে চীন কথা বললে তা শুনবে মিয়ানমার। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটিতে এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি থেকে সন্ত্রাসের উদ্বেগের বিষয়টি যুক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। এসব রোহিঙ্গা উগ্রপন্থি হয়ে উঠতে পারে।
২০১৬ সালে ঢাকা সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সে সময়ে যেসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবায়ন চাইবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে নিজেকে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমানে শুল্ক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান। ফলে বিভিন্ন দেশ ও তাদের এই সম্পর্কের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে সমীকরণ। এ অবস্থার মধ্যে হাসিনার চীন সফরকে মূল্যায়ন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্রীষ্মকালীন ডাভোস সম্মেলনে যোগ দেবেন হাসিনা। তিনি এতে অংশগ্রহণ করলে তা এমনই ইঙ্গিত দেবে যে, বাংলাদেশের ফোকাস হলো অর্থনৈতিক ইস্যুতে। পাশাপাশি ২০২১ সালের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে অর্থনীতির পাওয়ারহাউজ হিসেবে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন সেই লক্ষ্য পূরণ হিসেবে দেখা হবে। এর সঙ্গে মিশে থাকছে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস সহ বাংলাদেশে সক্রিয় শক্তিশালী চীনপন্থি লবি। এই লবি দীর্ঘ সময় ধরে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে গতিশীল অংশীদারিত্বের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকতে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে উন্নত করতে নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য এর আগে চীনের সাবমেরিন কেনার ইঙ্গিত দিয়েছিল বাংলাদেশ। এতে ভারতের কোনো কোনো মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কোনো ক্ষতি করবে না, এমনটা ভারতকে নিশ্চিত করার পর, ওই উদ্বেগে প্রশমিত হয়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদা ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠক করবেন হাসিনা। তার সম্মানে একটি ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী। এটা হতে পারে আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে বেশি কিছু। হতে পারে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার একটি উপায়।
শেখ হাসিনা একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক। ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অঙ্গীকার আছে তার। তিনি হয়তো এমন কোনো কার্ড নিজের কাছে রাখবেন, যা দিয়ে অবশ্যই তিনি ভারত ও চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করবেন।
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাই কমিশনার ছিলেন পিআর চক্রবর্তী। তিনি তার এক লেখায় বলেছেন, ভারতের প্রতিবেশী ও আফ্রিকায় চীনের ‘ডেবট ট্রাপ ডিপ্লোম্যাসি’তে পড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন চীনা কার্ড খেলছে তখন আগের দিনের বাংলাদেশ খুব সতর্কতার ক্ষেত্রে পা ফেলছে।  এই সতর্কতা ভাল। এমনকি এখনও, যখন হাসিনা দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক উদ্বেগজনক বিষয়গুলো নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলবেন।
এর আলোকে, বাংলাদেশের দিকে ভারত বাজপাখির মতো ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করা শুরু করেছে, আসলেই চীনের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছে কিনা বাংলাদেশ। হাসিনা ৬ই জুলাই তার চীন সফর শেষ করবেন। তারপর চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়টি মূল্যায়ন করা হবে। এটাই তখন গুরুত্ব পাবে।
(৩০শে জুনের দ্য স্টেটসম্যান থেকে অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.