ইসলাম ও চিত্রকলা: কিছু কথা by হাসান হামিদ
ভাষা সৃষ্টির আগে মানুষ মনের ভাব লেনদেন করতো ছবি এঁকে। চিত্রকলাকে তাই যোগাযোগের আদি মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। যে ইতিহাস পড়ে আমরা আজ অতীতকে জানতে পারছি; তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ গুলোর অনেকটাই লেখা হয়েছে আদিম ভাস্কর্য, শিলালিপি, তা¤্রলিপি, স্থাপত্য আর গুহাচিত্রকে কেন্দ্র করে। অনেক অনেক দিন আগে ফুল, পাতা ও বিভিন্ন নকশার উপর রঙ ব্যবহার করে ইসলামী চিত্রকলা গড়ে উঠেছিলো মধ্যপ্রাচ্যে। ইসলামী জীবনাদর্শের উপর ভিত্তি করে ২০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম চিত্রকলার ভিত্তি রচিত হয়েছিলো। আর ইসলামী স্থাপত্যগুলোতে চিত্রকলা প্রভাব বিস্তার করেছিলো ৭০০ এবং ৮০০ খ্রিস্টাব্দেই।
মুসলিম শাসন শুরুর পর এমন কোন উল্লেখযোগ্য ইমারত পাওয়া যাবে না যেখানে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার অনুপস্থিত। এই পদযাত্রায় অসামান্য অবদান ছিল তুর্কি ও আফগান শাসকদের। ১২০৫ সালে তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাঙলা বিজয়ের মাধ্যমে শিলালিপিতে আরবি-ফারসি ক্যালিগ্রাফির যাত্রা শুরু হয়। সুলতানী ও মোঘল আমলের ১২০৫ হতে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রায় চারশত নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব শিলালিপি মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, মাজার, কবরস্থান, প্রশাসনিক ইমারত ইত্যাদিতে স্থাপন করা হয়েছে। অধিকাংশ এ সকল নকশাচিত্রে কুরআন হাদিসের বাণী, সমকালীন বিষয়, স্থাপনের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সে সময়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থতি, সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমান্বয়ে পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মিশর, উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন প্রভৃতি দেশে ইসলামী চিত্রকলা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে উত্তর ভারতে আবির্ভাব ঘটে ইসলাম ধর্মের। এ অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতি বদলে যেতে থাকে এর প্রভাবে। স্থানীয় সকল মসজিদ ও স্থপত্যগুলোতে ইরানী ধারার ইসলামী চিত্রকলার ছাপ স্পষ্ট হয় এ সময়। গুজরাট, বাঙালা, কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও দক্ষিণাঞ্চলের বহু স্থাপনা এ সত্যের সাক্ষ্য বহন করছে। উদাহরণ হিসেবে দিল্লীতে হুমায়ুনের সমাধিসৌধের কথা বলা যায় ।
মোঘল চিত্রকলার প্রভাবে সতেরো আঠারো শতক ছিল মুসলিম বাংলার চিত্রকলার উজ্জ্বলতম সময়। এ সময় বাংলার মুসলমান চিত্রশিল্পীরা লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শাহনামা, আমির হামজা, শহীদে কারবালা, ইউসুফ জোলেখা ইত্যাদি পুঁথিকে নানা বর্ণে চিত্রিত করেছেন। স¤্রাট জাহাঙ্গীরের সময় মোঘল চিত্রকলা উচ্চাঙ্গে পৌঁছে । সম্রাট আকবর চিত্রকলার যে ধারা শুরু করেছিলেন, জাহাঙ্গীর তাকে পূর্ণতা দেন। জাহাঙ্গীরের সময়ে বিমূর্ত ধারার বদলে চিত্রে বাস্তব ঘটনাবলী গুরুত্ব পেতে থাকে। ইতোপূর্বে রাজদরবারের দৃশ্য, শিকার ইত্যাদি অঙ্কন শুরু হলেও পরবর্তীতে এসবের পাশাপাশি উৎসব, যুদ্ধের দৃশ্য, মসজিদের ছবি আঁকা শুরু হয়।
ইসলাম ধর্মের প্রধান উপাসনালয় মসজিদ। আর মসজিদগুলো সুশোভিত হয়েছিলো ইসলামী চিত্রকলার মোহনীয় স্পর্শে। মসজিদের দেয়ালের গায়ে ও শিলালিপিতে বিচিত্র ধরণের লতা-পাতা ও ফুলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আজকাল সারা বিশ্বে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন নকশা ও বাহারী চিত্র সম্বলিত মোজাইক ও টাইলস ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদের গালিচা, কার্পেট, জায়নামাজে ব্যবহার করা হয় নান্দনিক চিত্রকর্ম । ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের নিদর্শন রয়েছে ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে সুলতান নুসরাত শাহ কর্তৃক নির্মিত মসজিদের শিলালিপিতে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলার উৎকীর্ণ লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনাটি হচ্ছে লালমনিরহাটের হারানো মসজিদ ইস্টকলিপি। পোড়ামাটির তৈরি ইটে উৎকীর্ণ করে কালেমা তৈয়্যবা এবং ৬৯ হিজরী লেখা হয়েছিলো। বর্তমান সময়ের ইরাকের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক ইউসুফ জিন্নুনের মতে, ‘সমুদ্রপথে এ লিপির বাংলায় আগমন এবং উন্নতি সাধনের কারণেই একে ‘খত আল বাহরি’ নাম দেয়া হয় । ‘খত আল বাহরি’ অর্থ সমুদ্রলিপি।
অন্য সব মুসলিম দেশের মতো ইরানী শিল্পীরা কাবাঘরের ছবিও এঁকেছেন । বিভিন্ন যুগে মসজিদের অনেক ছবি আঁকা হয়েছে । শিরাজের ‘আতিক মসজিদ’ ও ‘খোদায়ী খনেহ’ ছবি দুটি খুবই বিখ্যাত । এ সমস্ত ছবিতে নকশাচিত্রের পাশাপাশি দেয়াল, সিঁড়ি, গম্বুজ, মিনার ইত্যাদির যে গঠনচিত্র আঁকা হয়েছে তা সারা পৃথিবীর স্থাপত্যকলা সম্পর্কিত তথ্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করেছে ।
ইসলাম ধর্মে ছবি আঁকাকে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়নি; মুলতঃ নিষেধ করা হয় প্রাণীর ছবি আঁকাকে । শরীয়তের আইনের চারটি উৎস যথা কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস আছে বলেই পরবর্তীতে জরুরী প্রয়োজনে যেমন হজে যাওয়ার জন্যে ছবি তোলাকে হালাল করা হয়। আমরা জানি নবুয়তের যুগেও পবিত্র কাবা শরিফের দেয়ালে হযরত ঈসা (আ) এর প্রতিকৃতি অংকিত ছিল। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনদের জামানায়ও ইসলামের অনেক স্মৃতিসৌধ মক্কা-মদিনায় বিরাজমান ছিল। কিন্তু ওহাবী মতবাদের অনুসারী সৌদি সরকার ১৯২৫ সালের ২১শে এপ্রিল শরীয়তের দোহাই দিয়ে একমাত্র রাসুল (সা) ছাড়া বাকি সব স্মৃতিসৌধ, মাজার ইত্যাদি ধ্বংস করে দেয়। হযরত আয়েশা (রা) থেকে যেমন ছবির বিরুদ্ধে হাদিস আছে, তেমনি ছবির পক্ষেও হাদিস রয়েছে। যেমন নিচের ছবি সংক্রান্ত হাদিসখানাঃ
তিনি আরও বলেন, ‘একদিন রাসুল (সা.) এমন একটি কালো রেশমি চাদর গায়ে দিয়ে বের হলেন যাতে অনেক জীবজন্তু ও মানুষের ছবি ছিল’ ( সূত্র. দাউদ শরিফ, ৫ম খণ্ড, হাদিস নং ৩৯৯০)
পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীরা, মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্য নির্ণয়ের তীর শয়তানের খারাপ কাজ। এসব পরিত্যাগ করো, তাহলে সফলকাম হবে’ (সূরা মায়েদা, আয়াত- ৯০) । এই আয়াতে “আনছাব” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; যার অর্থ পূজা বা অর্চনার উদ্দেশ্যে নির্মিত মূর্তি। এর মানে এই নয়, আমাদের শিশুরা খেলার জন্য যে পুতুল ব্যবহার করে তা স্পষ্টত হারাম। কেননা এই সকল খেলনা মূর্তি পুতুল পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত নয়। তবে এ কথাও ঠিক, ইসলামের প্রাথমিক যুগে চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য বা মূর্তি বানানোকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিলো। কেননা তখনকার আরবেরা পূজার উদ্দেশ্যেই মূর্তি বানাতো। তাই সে সময় এ ব্যাপারে ইসলাম কঠোরতা অবলম্বন করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন ইসলামের বিস্তার ঘটে তথা খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অধিকৃত হলেও সেখানকার গির্জায় মা মরিয়ম ও ঈসা (আ) এর মূর্তি ভাঙ্গার কোন হুকুম হযরত ওমর (রা) দেননি ।
হযরত সোলায়মান (আ) এর ভাস্কর্য বানানোর কথা পবিত্র কুরআনের আয়াত থেকে জানা যায়, ‘তারা তৈরি করতেন (সোলায়মান (আ) এর) পছন্দমতো বড় বড় অট্টালিকা, বড় বড় মূর্তি বা ভাস্কর্য, হাউসের মতো বৃহদাকার পাত্র ও ডেগ’ ( সূরা: ছাবা, আয়াত- ১৩ )
প্রকৃতপক্ষে, কোন কর্মের ফল নির্ভর করে তার উদ্দেশ্যের উপর। কুকুর পোষলে সেই ঘরে ফেরেশতা আসবে না বলে কথিত হাদিস যেমন প্রচলিত আছে, তেমনি পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফে একটি কুকুরের কথা জানা যায় যার নাম ছিল ‘কিবতমিন’। আল্লাহর সাত অলির সঙ্গী হিসেবে কুকুরটিকে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক তাফসিরকারকের মতে, আল্লাহর সাত অলির সঙ্গে সেও বেহেশতে অবস্থান করবে।
এবার আসি চিত্রকলা তথা ছবি আঁকার বর্তমান প্রেক্ষাপট বিষয়ে। আমাদের ব্যবহার করা সমস্ত জিনিসপত্র, পোশাক-আশাক, প্লাস্টিক সামগ্রী কিংবা ইলেকট্রনিক্সের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে আপনার ল্যাপটপ বা মোবাইল সেটটিও কিন্তু নকশা চিত্র এঁকেই তৈরি করতে হয়েছে। ডিজাইন ছাড়া, অংকন বিদ্যা ছাড়া আজকের বিশ্ব কল্পনাও করা যায় না। প্রতিটি জিনিসের প্যাটার্নের চিত্র যেমন আঁকতে হয়, তেমনি তৈরি হওয়ার পর এটাকে রঙ্গিন করতে হয় বিভিন্ন নকশা দিয়ে; মোড়কেও চাই চিত্র ও রঙের বাহার। প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসাবিদ্যা, ভূগোল বা জ্ঞান চর্চার প্রায় অনেক শাখায় চিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ। চারুকলার কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত লোকও ভাল মতোন জানেন না। অথচ চারুকলা বিশ্বে এখন অনেক সমাদৃত ও গুরুত্বপূর্ণ । কম্পিউটার অন করলে স্ক্রিনে যে ঝকঝকে চিত্র দেখতে পাই তা চারুকলার গ্রাফিক্স বিভাগের অবদান ।
মূলতঃ প্রাচীনকাল থেকেই দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য, মুদ্রা ও অন্যান্য বহু প্রকার চিত্রকলায় মুসলিম ভাবধারার প্রভাব ছিল। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ সৃষ্টি করেছে অসংখ্য শিল্প নিদর্শন। বাংলাদেশীয় চিত্রশিল্পের সর্বাধিক বাস্তবধর্মীতার প্রতিফলন ঘটেছে স্বভাবতঃ প্রকৃতি হতে। বাংলার সবুজ প্রান্তর, হাজারো নদীর বাঁক ও এখানকার মানুষের সাহসিকতা, অনাড়ম্বতা ও শান্তিপ্রিয়তা দেশীয় চিত্রকলার ভাবধারাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত করেছে। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মানুসারী। শান্তিপ্রিয় এই মানুষগুলোর সকল স্বপ্ন বাস্তবতার সমান্তরালে আবির্ভূত হোক, বেঁচে থাকুক এখানকার মুসলিম চিত্রকলা ।
লেখক: স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণি)চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মুসলিম শাসন শুরুর পর এমন কোন উল্লেখযোগ্য ইমারত পাওয়া যাবে না যেখানে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার অনুপস্থিত। এই পদযাত্রায় অসামান্য অবদান ছিল তুর্কি ও আফগান শাসকদের। ১২০৫ সালে তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাঙলা বিজয়ের মাধ্যমে শিলালিপিতে আরবি-ফারসি ক্যালিগ্রাফির যাত্রা শুরু হয়। সুলতানী ও মোঘল আমলের ১২০৫ হতে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রায় চারশত নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব শিলালিপি মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, মাজার, কবরস্থান, প্রশাসনিক ইমারত ইত্যাদিতে স্থাপন করা হয়েছে। অধিকাংশ এ সকল নকশাচিত্রে কুরআন হাদিসের বাণী, সমকালীন বিষয়, স্থাপনের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সে সময়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থতি, সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমান্বয়ে পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মিশর, উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন প্রভৃতি দেশে ইসলামী চিত্রকলা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে উত্তর ভারতে আবির্ভাব ঘটে ইসলাম ধর্মের। এ অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতি বদলে যেতে থাকে এর প্রভাবে। স্থানীয় সকল মসজিদ ও স্থপত্যগুলোতে ইরানী ধারার ইসলামী চিত্রকলার ছাপ স্পষ্ট হয় এ সময়। গুজরাট, বাঙালা, কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও দক্ষিণাঞ্চলের বহু স্থাপনা এ সত্যের সাক্ষ্য বহন করছে। উদাহরণ হিসেবে দিল্লীতে হুমায়ুনের সমাধিসৌধের কথা বলা যায় ।
মোঘল চিত্রকলার প্রভাবে সতেরো আঠারো শতক ছিল মুসলিম বাংলার চিত্রকলার উজ্জ্বলতম সময়। এ সময় বাংলার মুসলমান চিত্রশিল্পীরা লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শাহনামা, আমির হামজা, শহীদে কারবালা, ইউসুফ জোলেখা ইত্যাদি পুঁথিকে নানা বর্ণে চিত্রিত করেছেন। স¤্রাট জাহাঙ্গীরের সময় মোঘল চিত্রকলা উচ্চাঙ্গে পৌঁছে । সম্রাট আকবর চিত্রকলার যে ধারা শুরু করেছিলেন, জাহাঙ্গীর তাকে পূর্ণতা দেন। জাহাঙ্গীরের সময়ে বিমূর্ত ধারার বদলে চিত্রে বাস্তব ঘটনাবলী গুরুত্ব পেতে থাকে। ইতোপূর্বে রাজদরবারের দৃশ্য, শিকার ইত্যাদি অঙ্কন শুরু হলেও পরবর্তীতে এসবের পাশাপাশি উৎসব, যুদ্ধের দৃশ্য, মসজিদের ছবি আঁকা শুরু হয়।
ইসলাম ধর্মের প্রধান উপাসনালয় মসজিদ। আর মসজিদগুলো সুশোভিত হয়েছিলো ইসলামী চিত্রকলার মোহনীয় স্পর্শে। মসজিদের দেয়ালের গায়ে ও শিলালিপিতে বিচিত্র ধরণের লতা-পাতা ও ফুলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আজকাল সারা বিশ্বে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন নকশা ও বাহারী চিত্র সম্বলিত মোজাইক ও টাইলস ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদের গালিচা, কার্পেট, জায়নামাজে ব্যবহার করা হয় নান্দনিক চিত্রকর্ম । ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের নিদর্শন রয়েছে ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে সুলতান নুসরাত শাহ কর্তৃক নির্মিত মসজিদের শিলালিপিতে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলার উৎকীর্ণ লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনাটি হচ্ছে লালমনিরহাটের হারানো মসজিদ ইস্টকলিপি। পোড়ামাটির তৈরি ইটে উৎকীর্ণ করে কালেমা তৈয়্যবা এবং ৬৯ হিজরী লেখা হয়েছিলো। বর্তমান সময়ের ইরাকের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক ইউসুফ জিন্নুনের মতে, ‘সমুদ্রপথে এ লিপির বাংলায় আগমন এবং উন্নতি সাধনের কারণেই একে ‘খত আল বাহরি’ নাম দেয়া হয় । ‘খত আল বাহরি’ অর্থ সমুদ্রলিপি।
অন্য সব মুসলিম দেশের মতো ইরানী শিল্পীরা কাবাঘরের ছবিও এঁকেছেন । বিভিন্ন যুগে মসজিদের অনেক ছবি আঁকা হয়েছে । শিরাজের ‘আতিক মসজিদ’ ও ‘খোদায়ী খনেহ’ ছবি দুটি খুবই বিখ্যাত । এ সমস্ত ছবিতে নকশাচিত্রের পাশাপাশি দেয়াল, সিঁড়ি, গম্বুজ, মিনার ইত্যাদির যে গঠনচিত্র আঁকা হয়েছে তা সারা পৃথিবীর স্থাপত্যকলা সম্পর্কিত তথ্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করেছে ।
ইসলাম ধর্মে ছবি আঁকাকে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়নি; মুলতঃ নিষেধ করা হয় প্রাণীর ছবি আঁকাকে । শরীয়তের আইনের চারটি উৎস যথা কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস আছে বলেই পরবর্তীতে জরুরী প্রয়োজনে যেমন হজে যাওয়ার জন্যে ছবি তোলাকে হালাল করা হয়। আমরা জানি নবুয়তের যুগেও পবিত্র কাবা শরিফের দেয়ালে হযরত ঈসা (আ) এর প্রতিকৃতি অংকিত ছিল। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনদের জামানায়ও ইসলামের অনেক স্মৃতিসৌধ মক্কা-মদিনায় বিরাজমান ছিল। কিন্তু ওহাবী মতবাদের অনুসারী সৌদি সরকার ১৯২৫ সালের ২১শে এপ্রিল শরীয়তের দোহাই দিয়ে একমাত্র রাসুল (সা) ছাড়া বাকি সব স্মৃতিসৌধ, মাজার ইত্যাদি ধ্বংস করে দেয়। হযরত আয়েশা (রা) থেকে যেমন ছবির বিরুদ্ধে হাদিস আছে, তেমনি ছবির পক্ষেও হাদিস রয়েছে। যেমন নিচের ছবি সংক্রান্ত হাদিসখানাঃ
তিনি আরও বলেন, ‘একদিন রাসুল (সা.) এমন একটি কালো রেশমি চাদর গায়ে দিয়ে বের হলেন যাতে অনেক জীবজন্তু ও মানুষের ছবি ছিল’ ( সূত্র. দাউদ শরিফ, ৫ম খণ্ড, হাদিস নং ৩৯৯০)
পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীরা, মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্য নির্ণয়ের তীর শয়তানের খারাপ কাজ। এসব পরিত্যাগ করো, তাহলে সফলকাম হবে’ (সূরা মায়েদা, আয়াত- ৯০) । এই আয়াতে “আনছাব” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; যার অর্থ পূজা বা অর্চনার উদ্দেশ্যে নির্মিত মূর্তি। এর মানে এই নয়, আমাদের শিশুরা খেলার জন্য যে পুতুল ব্যবহার করে তা স্পষ্টত হারাম। কেননা এই সকল খেলনা মূর্তি পুতুল পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত নয়। তবে এ কথাও ঠিক, ইসলামের প্রাথমিক যুগে চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য বা মূর্তি বানানোকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিলো। কেননা তখনকার আরবেরা পূজার উদ্দেশ্যেই মূর্তি বানাতো। তাই সে সময় এ ব্যাপারে ইসলাম কঠোরতা অবলম্বন করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন ইসলামের বিস্তার ঘটে তথা খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অধিকৃত হলেও সেখানকার গির্জায় মা মরিয়ম ও ঈসা (আ) এর মূর্তি ভাঙ্গার কোন হুকুম হযরত ওমর (রা) দেননি ।
হযরত সোলায়মান (আ) এর ভাস্কর্য বানানোর কথা পবিত্র কুরআনের আয়াত থেকে জানা যায়, ‘তারা তৈরি করতেন (সোলায়মান (আ) এর) পছন্দমতো বড় বড় অট্টালিকা, বড় বড় মূর্তি বা ভাস্কর্য, হাউসের মতো বৃহদাকার পাত্র ও ডেগ’ ( সূরা: ছাবা, আয়াত- ১৩ )
প্রকৃতপক্ষে, কোন কর্মের ফল নির্ভর করে তার উদ্দেশ্যের উপর। কুকুর পোষলে সেই ঘরে ফেরেশতা আসবে না বলে কথিত হাদিস যেমন প্রচলিত আছে, তেমনি পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফে একটি কুকুরের কথা জানা যায় যার নাম ছিল ‘কিবতমিন’। আল্লাহর সাত অলির সঙ্গী হিসেবে কুকুরটিকে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক তাফসিরকারকের মতে, আল্লাহর সাত অলির সঙ্গে সেও বেহেশতে অবস্থান করবে।
এবার আসি চিত্রকলা তথা ছবি আঁকার বর্তমান প্রেক্ষাপট বিষয়ে। আমাদের ব্যবহার করা সমস্ত জিনিসপত্র, পোশাক-আশাক, প্লাস্টিক সামগ্রী কিংবা ইলেকট্রনিক্সের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে আপনার ল্যাপটপ বা মোবাইল সেটটিও কিন্তু নকশা চিত্র এঁকেই তৈরি করতে হয়েছে। ডিজাইন ছাড়া, অংকন বিদ্যা ছাড়া আজকের বিশ্ব কল্পনাও করা যায় না। প্রতিটি জিনিসের প্যাটার্নের চিত্র যেমন আঁকতে হয়, তেমনি তৈরি হওয়ার পর এটাকে রঙ্গিন করতে হয় বিভিন্ন নকশা দিয়ে; মোড়কেও চাই চিত্র ও রঙের বাহার। প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসাবিদ্যা, ভূগোল বা জ্ঞান চর্চার প্রায় অনেক শাখায় চিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ। চারুকলার কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত লোকও ভাল মতোন জানেন না। অথচ চারুকলা বিশ্বে এখন অনেক সমাদৃত ও গুরুত্বপূর্ণ । কম্পিউটার অন করলে স্ক্রিনে যে ঝকঝকে চিত্র দেখতে পাই তা চারুকলার গ্রাফিক্স বিভাগের অবদান ।
মূলতঃ প্রাচীনকাল থেকেই দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য, মুদ্রা ও অন্যান্য বহু প্রকার চিত্রকলায় মুসলিম ভাবধারার প্রভাব ছিল। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ সৃষ্টি করেছে অসংখ্য শিল্প নিদর্শন। বাংলাদেশীয় চিত্রশিল্পের সর্বাধিক বাস্তবধর্মীতার প্রতিফলন ঘটেছে স্বভাবতঃ প্রকৃতি হতে। বাংলার সবুজ প্রান্তর, হাজারো নদীর বাঁক ও এখানকার মানুষের সাহসিকতা, অনাড়ম্বতা ও শান্তিপ্রিয়তা দেশীয় চিত্রকলার ভাবধারাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত করেছে। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মানুসারী। শান্তিপ্রিয় এই মানুষগুলোর সকল স্বপ্ন বাস্তবতার সমান্তরালে আবির্ভূত হোক, বেঁচে থাকুক এখানকার মুসলিম চিত্রকলা ।
লেখক: স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণি)চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments