ভোগবাদে বামেরা by সাজেদুল হক ও কাজী সুমন
তাদের
সবার পথ একদিকে যায়নি। কেতাবের সঙ্গে হয়তো মানুষের মিলও হয়নি শেষ পর্যন্ত।
তবুও তারা ছিলেন আদর্শ। উপমহাদেশে বাম রাজনীতির ইতিহাস দীর্ঘ। যে ইতিহাস
গৌরবের। পাকিস্তান শাসনামলে আদর্শিক রাজনীতির পতাকা বহন করতেন বামেরাই।
মহান মুক্তিযুদ্ধেও স্বতন্ত্র ভূমিকা রেখেছিলেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের পর
নানা মত আর পথে বিভক্ত হয়েছে বাম রাজনীতি। কখনও কখনও হঠকারিতাও আশ্রয়
নিয়েছে সেখানে। শ্রেণীশত্রু নিধনের নামে নানা বর্বরতাও দেখা গেছে। তবুও
আদর্শিক রাজনীতি বলতে মানুষ বাম রাজনীতিকেই বুঝতো। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী
শিক্ষার্থীটিই হয়তো নিজেকে জড়াতেন বাম রাজনীতিতে। স্বপ্ন আর রোমান্টিসিজমের
সেই রাজনীতি। একসময় স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। যন্ত্রণায় দগ্ধ হন লাখ লাখ তরুণ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এর একটি প্রধান কারণ। ক্ষমতায় বসতে না পারলেও
স্বতন্ত্র প্রতিবাদের ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাম রাজনীতিবিদেরা ঠিক কখন
ভোগবাদের রাজনীতিতে জড়িয়েছেন তা হয়তো একেবারে হলফ করে বলা যায় না। এ পতন
হয়তো একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে পতনের পথ বিস্তৃত হয়েছে। যে হালুয়া-রুটির
রাজনীতির তারা বিরোধিতা করে এসেছেন সারাজীবন একসময় নিজেরাও জড়িয়ে পড়েন এতে।
আদর্শিক রাজনীতির পক্ষে বড় বড় বুলি ওড়ানো এক নেতাকে হঠাৎ দেখা গেলো ফুল
হাতে জিয়াউর রহমানকে স্বাগত জানাতে। এখন অবশ্য তার স্থান হয়েছে একেবারে
বিপরীত শিবিরে। বাম রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ অবশ্য সরাসরিই জড়িয়ে পড়েন
তাদের ভাষায় বুর্জোয়া রাজনীতিতে। তাদের কেউ যোগ দেন আওয়ামী লীগে, কেউ
বিএনপিতে অথবা কেউবা জাতীয় পার্টিতে। একসময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো
প্রধান রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারণেও প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এই
সাবেক বামেরা। যে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে এ নিয়ে
অনেকের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে। যদিও এতে সাবেক এই বাম রাজনীতিবিদদের প্রভাব
কমেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তো বেড়েছে। তবে বাম রাজনীতির সবচেয়ে বড় পতন হয়
খুব সম্ভবত গত এক দশকে। দুই যুগ আগে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ধীরে
বাংলাদেশের রাজনীতি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক শিবিরের নেতৃত্বে দেয়
আওয়ামী লীগ। অপরপক্ষের নেতৃত্ব দেয় বিএনপি। বিএনপির প্রথম জমানায়
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সময় অবশ্য রাজনীতিতে এক ভিন্ন মেরুকরণ দেখা
যায়। সেসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে জামায়াত। ১৯৯৬
সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ঐকমত্যের সে সরকারের
জাতীয় পার্টির পাশাপাশি জাসদেরও অংশগ্রহণ ছিল। মন্ত্রিসভায় স্থান পান আ স ম
আবদুর রব। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় বিএনপি তথা চারদলীয় জোট। আওয়ামী
লীগের সর্বশেষ দুটি সরকারেই বাম রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ রয়েছে। এর আগে
তিনবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ
বড়ুয়া। কিন্তু প্রতিবারই তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে টেকনোক্রেট
কোটায় মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী হয়েই ঘুরে যায় এই বাম রাজনীতিকের
ভাগ্যের চাকা। মন্ত্রী হওয়ার আগে থাকতেন ভাড়াবাসায়। এখন তিনি রাজধানীতে
একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক। সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত দিলীপ বড়ুয়া
মন্ত্রী হওয়ার পর কিভাবে সম্পদশালী হয়েছেন তার বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত
হয়েছে। বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও বাম রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী অংশগ্রহণ রয়েছে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন
পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাসদের (একাংশ) কার্যকরী সভাপতি
মাঈনউদ্দিন খান বাদলও হয়েছেন এমপি। তাদের মতো অন্য বাম রাজনৈতিক নেতারাও
নানাভাবে সুবিধা আদায় করছেন সরকারের কাছ থেকে। তবে অনেকে সে স্রোতে গা
ভাসাননি। সিপিবি এবং বাসদ কোন জোটে নেই। দল দুটি বিগত ৫ই জানুয়ারির একতরফা
নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ ব্যাপারে সিপিবি’র সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম
মানবজমিনকে বলেন, প্রতিকূল পরিবেশেও আমরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাজনীতি
করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নসহ সব জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে
নেতৃত্ব দিয়েছে বাম ছাত্র নেতারাই। আমরা আদর্শচ্যুত হইনি। কিন্তু অনেকেই
বাম রাজনীতি থেকে আদর্শচ্যুত হয়ে ভোগবাদে জড়িয়ে পড়েছেন। এর কারণ তারাই ভাল
বলতে পারবেন। আশা করছি, আগামীতে বাম আদর্শের ভিত্তিতেই তরুণ নেতৃত্ব গড়ে
উঠবে। একই মত পোষণ করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন,
যারা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্গে
জড়িয়ে পড়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে লাভ নেই। তারা কোন জাতির আদর্শ হতে
পারে না। তিনি বলেন, কিউবায় ৬০-৬৫ বছর অবরোধের মধ্যেও সমাজতন্ত্রের যে
শ্রেষ্ঠত্ব তা বিশ্ববাসী দেখেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্র ছাড়া
গতি নেই। তাই ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রের আদর্শের রাজনীতি টিকে থাকবে। বামপন্থার
রাজনীতির আদর্শই সত্যিকার মানুষের মুক্তির পথ দেখাবে। বাম রাজনীতিবিদ
হায়দার আকবর খান রনো বলেন, বাম রাজনীতির অনেকেই ডিগবাজি খেয়ে সরকারের
মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। ব্যক্তিস্বার্থে যারা আদর্শচ্যুত হয়েছেন তাদের বাম
বলা ঠিক হবে না। তারা বাম রাজনীতির আদর্শ হতে পারে না। তিনি বলেন, যুগে
যুগে মীরজাফর ছিল। এখনও মীরজাফরের দোসররা আছে। তাদের আদর্শ অনুকরণীয় হতে
পারে না। আমরা যারা ভুলভ্রান্তির মধ্যে বাম আদর্শ ধারণ করে আছি সেটা তরুণরা
অনুকরণ করবে। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া বাম রাজনীতির
আদর্শচ্যুতির বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্য বাম
রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় রাজনীতিতে কোন ভূমিকা নেই। ফলে তাদের পুরনো
চিন্তা-ভাবনা বর্তমান রাজনীতিতে কোন প্রভাব ফেলবে না। তাই আমরা আমাদের
নিজের দলের আদর্শ নিয়ে পর্যালোচনা করি। অন্য বাম দল নিয়ে চিন্তা করি না।
No comments