ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর: বিপ্লবের আগে ও পরে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের গত ৪০ বছরের ইতিহাস নানা
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ভরপুর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে
আমরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান প্রচারের পদক্ষেপ নিয়েছি। ধারাবাহিক এ আলোচনার
প্রথম পর্বে আমরা ইসলামি বিপ্লবের আগে ও পরে ইরানের পররাষ্ট্র নীতির নানা
দিক নিয়ে আলোচনা করব।
ইসলামি
বিপ্লবের আগে স্বৈরাচারী পাহলভি শাসনামলে ইরানের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি
বলতে কিছু ছিল না এবং তৎকালীন শাসক বিদেশীদের ক্রীড়নক বা সেবাদাসে পরিণত
হয়েছিল। দ্বিতীয় পাহলভি শাসকের পররাষ্ট্র নীতি মূলত আমেরিকা ও ব্রিটেনের
দ্বারা পরিচালিত হত। এ ছাড়া, ইরান সরকারের গঠন কাঠামোর মধ্যেও বিশেষ করে
দেশটির সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ করত।
স্বৈরাচারী শাহ সরকারের শাসনামলে ইরানের ওপর আমেরিকার প্রভাব এতটা বেশি ছিল
যে, ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর মার্কিন সরকার ইরানে ক্যাপিচুলেশন আইন
বাস্তবায়ন করার ধৃষ্টতা দেখায়। বিশ্বের ইতিহাসে এই আইন বাস্তবায়নকারী দেশের
নজীর নেই বললেই চলে। এই আইনে বলা হয়, ইরানে অবস্থানরত আমেরিকার নাগরিকরা
কোনো অপরাধ করলে এমনকি কাউকে খুন করলেও তাকে ইরানের আইনে বিচার করা যাবে না
বরং তাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে।
রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে রেজা শাহ
সে সময় শাহ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার
রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা এত বেশি বেড়ে যায় যে, মার্কিন সরকারের আঙুলের ইশারায়
ইরানের সরকার চলতে থাকে। তৎকালীন ইরান সরকার পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। সেসময় ইরান ও
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পক্ষে পুলিশি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে
মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নে অন্যতম হাতিয়ার বা স্তম্ভ হিসেবে
নির্বাচিত হওয়ায় পাহলভি সরকার এতোবেশি গর্বিত ও খুশী হয়েছিল যে তারা নিজেকে
এ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ভাবত। আমেরিকার
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয় পাহলভি
শাসক অর্থাৎ মোহাম্মদ রেজা শাহ ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে আমেরিকা সফরে যান। রেজা
শাহ আমেরিকা পৌঁছার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং
রেজা শাহের 'স্বেত বিপ্লব'এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন,
রেজা শাহের 'স্বেত বিপ্লব' উন্নয়নে আগ্রহী সব দেশের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে
আছে। নিক্সন আরো বলেছিলেন, ইরান ও আমেরিকার সম্পর্ক অতীতে কখনোই এতোটা ভালো
ছিল না। বিশেষ করে শুধু দেশ নয় বরং একজন ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের এ ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরানের ব্যাপারে নিক্সনের
ওই বক্তব্য আমেরিকার সঙ্গে সৌদি আরবের বর্তমান সম্পর্কের কথাই মনে করিয়ে
দেয়। কারণ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট
ট্রাম্পের সম্পর্কের ধরনটাও নিক্সন ও রেজা শাহের মতোই।
আমেরিকার
স্বার্থ দেখাশোনা করা ও তাদের সেবাদাসে পরিণত হওয়া ছিল ইরানের তৎকালীন
শাসক রেজা শাহের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম একটি দিক। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের
পর ইরান সকল পরাধিনতা ছিন্ন করে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে স্বাধীন নীতি গ্রহণ করে
যা ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্য বিরাট চপেটাঘাত। ইরানের পররাষ্ট্র
নীতি বিষয়ক গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইয়্যেদ জালাল দেহকানি
ফিরোজাবাদি বলেছেন, "ইসলামি ইরানের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হচ্ছে
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা। আর এটাই ইরান ও আমেরিকাকে মুখোমুখি দাড়
করিয়েছে।"
ইমাম খোমেনি
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম
খোমেনি(র.) বলেছিলেন, "আমেরিকা হোক কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন হোক আমরা কোনো
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গেই আপোষ করব না।" ইরানের সংবিধানের ১৫২ নম্বর
ধারায় বলা হয়েছে, "ইরানের পররাষ্ট্র নীতি হবে আধিপত্যবাদ প্রত্যাখ্যান করা,
দেশের সার্বাঙ্গীন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, আধিপত্যবাদী
পরাশক্তিগুলোর ব্যাপারে জোটনিরপেক্ষ থাকা এবং যুদ্ধে জড়িত নয়-এমন দেশগুলোর
সাথে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা ও বিশ্বের সব মুসলমানদের
অধিকার রক্ষা করা।"
ইসলামি
বিপ্লবের পর গত ৪০ বছর ধরে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ইরান এ নীতি মেনে চলছে।
ইরান আমেরিকার নির্যাতনমূলক নিষেধাজ্ঞা সহ্য করলেও নিজের স্বাধীনতা ও
সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে বিন্দুমাত্র আপোষ করেনি। আর এটাই ইরানের ওপর মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অতীতের সব সরকারের ক্ষোভ ও অসন্তোষের বড়
কারণ। ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য পরমাণু সমঝোতার মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি
থেকে বেরিয়ে যেতেও আমেরিকা কুণ্ঠাবোধ করেনি যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
এমনকি ইয়েমেনে সৌদি অপরাধযজ্ঞ ও সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার ঘটনাকেও
আমেরিকা উপেক্ষা করে চলেছে। কারণ সৌদি আরব হচ্ছে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র যে
কিনা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ দেখাশোনা করছে অনেকটা ইরানের সাবেক রেজা
শাহ পাহলভি সরকারের মতো। কিন্তু বিপ্লবের পর ইরানের নীতিতে পরিবর্তন আসায়
আমেরিকা ইরানের এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
ইসলামি
বিপ্লবের আগে রেজা শাহের শাসনামলে বিদেশি বিশেষ করে মার্কিন সামরিক
উপদেষ্টাদের ব্যাপক আনাগোনা ছিল ইরানে। বলতে গেলে আমেরিকাই ইরানকে পরিচালনা
করত। এ ব্যাপারে ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলি রেজা আযগান্দি এক
নিবন্ধে লিখেছেন, " ১৯৫৩ সালের ৮ নভেম্বর ইরানে অভ্যুত্থানের পর আমেরিকা ও
ইরানের মধ্যে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এরপর থেকে
আমেরিকা ইরানের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার নামে এদেশে ব্যাপক প্রভাব
বিস্তার করা শুরু করে। ইরানে আমেরিকার সামরিক উপদেষ্টাদের সংখ্যা এতো
বাড়ানো হয় যে, ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের মাত্র এক বছর আগে ৪৫ হাজার
মার্কিন উপদেষ্টা ইরানে উপস্থিত ছিল। এমনকি তাদের লাখ লাখ ডলারের বেতনও
ইরানকে পরিশোধ করতে হত। ৪৫ হাজার মার্কিন সামরিক উপদেষ্টার উপস্থিতির ফলে
ইরানকে বিপুল অংকের অস্ত্র আমেরিকার কাছ থেকে কিনতে হত। এসব অস্ত্র দিয়ে
তৎকালীন রেজা শাহ সরকার মধ্যপ্রাচ্যে পুলিশি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং
মার্কিন নীতি বাস্তবায়ন করত।
হেনরি কিসিঞ্জার
১৯৭৪ সালের ৬ আগস্ট মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তেহরান সফরের সময় স্বৈরাচারী রেজা
শাহের অর্থমন্ত্রী হুশাঙ্গ আনসারি বলেছিলেন, "ইরানের অতীতের শাসকরা বলতেন,
আমেরিকার একার পক্ষে বিশ্বে তাদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হবে না এবং সে
কারণে তাদের নির্ভরযোগ্য বন্ধুর প্রয়োজন হবে। তাই ইরান আমেরিকার সর্বোত্তম
বন্ধু হতে পারে।"
আমেরিকার
স্বার্থ রক্ষার জন্য ইরানের রেজা শাহ যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে পুলিশি ভূমিকায়
অবতীর্ণ হয়েছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই ইরানের জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায়
না এনে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নিজের পররাষ্ট্র নীতিকে ঢেলে সাজানো
হয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বর্তমানে সৌদি
আরবের ক্ষেত্রেও। সৌদি আরব আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল অংকের অস্ত্র কেনার
পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা এবং ওয়াশিংটনের নীতি
বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইসলামি
বিপ্লবের আগে ও পরে ইরানের অবস্থানের দিকে লক্ষ্য করলে একটি বড় পার্থক্য
চোখে পড়বে। আর তা হচ্ছে, বিপ্লবের আগে ইরানে ৪৫ হাজার মার্কিন সামরিক
উপদেষ্টা ইরানে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর আজ ইরান প্রতিরক্ষা
ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে ও আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। এমনকি ইরান
আজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অন্য দেশে সামরিক উপদেষ্টা
পাঠাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়।
No comments