রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল- সমস্যার জাদুকরী সমাধান নেই
রোহিঙ্গা
ক্যাম্প ও নো-ম্যান্সল্যান্ডের বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের অবস্থা
সরজমিন দেখেছেন নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। তারা নির্যাতিত
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথাও বলেন। পর্যবেক্ষণ শেষে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা
বললেন, এটি একটি গুরুতর সংকট। এর জাদুকরী কোনো সমাধান নেই। নজিরবিহীনভাবে
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ৫ এবং অস্থায়ী ১০ সদস্যের প্রতিনিধিরা
একযোগে গতকাল দিনভর মিয়ানমার সীমান্তে ঘুরেছেন। তারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে
নির্যাতিতদের কান্না, বুকে চাপা কষ্ট এবং বর্বর কাহিনী শুনেছেন। এ সময়
ক্যাম্পের বাইরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ব্যানার-ফেস্টুন প্রদর্শন করে বর্মী
বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেকের কাছে ন্যায় বিচার নিশ্চিত
পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন। বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি রোহিঙ্গা সংকটের
সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের তাৎপর্যপূর্ণ এ সফরকালে পররাষ্ট্র
প্রতিমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার
মহাপরিচালক এবং স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা সঙ্গে ছিলেন।
উল্লেখ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব এবং জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালক
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া রয়েছেন। আজ সকালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদল তার
সঙ্গেও দেখা করবে। সেখানে মন্ত্রী-সচিবসহ অনুপস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের দেখা হবে। পরে বিমানবন্দরে সংবাদ
সম্মেলন করে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাবেন।
রাতারাতি সমাধানের আশা নেই: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকটের রাতারাতি জাদুকরী কোনো কিছু আশা করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করে কক্সবাজার ছাড়েন। গতকাল রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অবস্থান সরজমিন দেখে তারা বলেন- আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে। এ বিষয়ে আগাম ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। রোহিঙ্গাদের সংকটের উৎস মিয়ানমারে। মিয়ানমারকেই এ সংকটের দীর্ঘস্থায়ী ও সম্মানজনক সমাধান করতে হবে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এ কাজে আন্তরিকতার সঙ্গে সহায়তা দিয়ে যাবে। দুপুরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু শিবির উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী আশ্রয় শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে- যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি: সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। তিন দিনের সফরে নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের ১৫ দূতসহ মোট ৪০ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি শনিবার বাংলাদেশে আসে। সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকালে প্রথমেই তারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়ায় শূন্যরেখায় যায়। সেখানে আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন দলটির সদস্যরা। পরে কুতুপালং শিবির ঘুরে দেখেন। পরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চারটি দলের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে কথা বলেন তারা। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রতিনিধিদলের কয়েক জন সদস্য। সফরকারী এ দলের সদস্য এবং নিরাপত্তা পরিষদে পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি গুস্তাভ মেজা কোয়াদ্রা বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে কীভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সহযোগিতা করা যায়, সেটি বুঝতে এ সফরে এসেছি। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আমরা সহযোগিতা করে যাবো।’ কোয়াদ্রা বলেন, এখন যে পরিস্থিতি রয়েছে, তা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযোগী নয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের যে সহযোগিতা করেছে, তার ভূয়সী প্রশংসা করেন কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আল ওতাইবি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের জনগণ রোহিঙ্গাদের যে সহযোগিতা করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। রোহিঙ্গাদের বিষয় নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা? সংবাদ সম্মেলনে সেই প্রশ্নও ওঠে। জবাবে এ দলের সদস্য এবং নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বুঝতে এ সফর অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাস্তবিক অবস্থা কেমন, সেটি জানতে সহকর্মীদের সঙ্গে আমি এ সফরে এসেছি।’ তিনি এটিও উল্লেখ করেন, নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখনো একটি বিতর্কিত বিষয়। একই প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রতিনিধি বলেন, ‘এ সমস্যা যে বাংলাদেশের জনগণকে কতটা প্রভাবিত করছে, তা আমরা বুঝতে পারছি। আমরা মনে করি, এ সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান দরকার দুই দেশের মধ্যেই। সমস্যার সমাধানে মানবিক দিকটি বিবেচনা করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে শুরু থেকেই চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।
তিনি এও উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ওঠে, নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের ওপর নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে কিনা? জবাবে পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি গুস্তাভ মেজা কোয়াদ্রা বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি বাস্তব পরিস্থিতি কী তা বুঝতে এবং জানতে। নিউ ইয়র্কে ফিরে আমরা আলোচনা করবো। তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
বাবা-মাকে হত্যার বর্ণনায় আমেনার বিলাপ: ওদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সামনে নিজ নিজ পরিবারের উপর বয়ে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন রোহিঙ্গারা। সীমান্তের তুমব্রু জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের জীবনমান দেখতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হন সফররত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ টিম। সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথার সময় রোহিঙ্গা কিশোরী আমেনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি উচ্চস্বরে বিলাপ করে চোখের সামনেই বাবা সৈয়দ আলম ও মা সখিনাকে গুলি করার বর্ণনা দেন। বলেন, হত্যার দৃশ্য দেখে ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ সময় তাকে বারবার সান্ত্ব্তনা দিচ্ছিলেন সফররত দলের প্রধান। তারা কিশোরী আমেনার বাবাসহ রাখাইনে হত্যার শিকার সবার বিচার পেতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। রোববার সকাল সোয়া ৯টার দিকে ৩০ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রুর কোনারপাড়া জিরো পয়েন্ট এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে তারা দুপুর ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। শূন্যরেখা থেকে ফিরে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কুতুপালং ক্যামপ পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে ফিরে ক্যাম্পে যান।
রোহিঙ্গা সংকটটি ‘স্পটলাইটে’ রাখার প্রতিশ্রুতি: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়ার শূন্যরেখা এবং উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা নিউ ইয়র্কে ফিরে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার অঙ্গীকার করেন। বলেন, এই সংকট থেকে বিশ্ববাসী চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। জাতিসংঘও তা করবে না। গত বছর আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হওয়ার পর এই প্রথম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করলো। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যাপক হত্যা-নির্যাতনের মুখে গত আট মাসে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পর্ষদ হিসেবে বিবেচিত নিরাপত্তা পরিষদেও এ সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনা এসেছে সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে। তবে রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গতকাল পরিষদের প্রতিনিধিরা এক ঘণ্টার বেশি সময় ক্যাম্প এবং নো-ম্যান্সল্যান্ডে কাটিয়েছেন। ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এবং তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের মতামত শোনেন।
পরে কুতুপালংয়ের সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বলেন, ‘সিকিউরিটি কাউন্সিলের ওপর অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো ম্যাজিক সলিউশন নেই। আমরা সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। সেজন্যই বাংলাদেশে এখানে এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতি আসলে কেমন, তা দেখা আমাদের জন্য জরুরি ছিল।’ রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা এখনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে এই সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। আমরা দুই দেশের সরকারকেই বোঝাতে চেষ্টা করছি যেন তারা গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যায়। আর আমরাও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।’ নিরাপত্তা পরিষদে এ সংকট নিয়ে আলোচনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে পোলিয়ানস্কি বলেন, ‘আমরা আলোচনা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছি না, চোখ বন্ধ করেও থাকছি না। সে কারণেই আমরা আজ এখানে এসেছি।’ তিনি বলেন, কিছু কিছু সময় থাকে যখন সংকটের কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তারা একটি ‘ভালো’ সমাধান খুঁজে বের করতে চান, যা ‘সবার কাছে গ্রহণযাগ্য’ হবে। নিরাপত্তা পরিষদে চীনের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, ‘আমরা এখনই কোনো সমাধান বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়ার জন্য হয়তো প্রস্তুত নই।
আমি বলতে চাই, এখানে এসে, ক্যাম্প পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে আমাদের মিশন শুরু হলো। যে পরিমাণ সাংবাদিক এখানে আছেন, তাতে স্পষ্ট যে বিষয়টি মিডিয়ার কতটা মনোযোগে আছে। ‘আমি বলতে চাই, আমরা এখানে প্রমোদ ভ্রমণে বা ছুটি কাটাতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি কারণ এটাকে আমরা গুরুতর সংকট বলে মনে করছি এবং সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। সুতরাং আজই আপনারা আমাদের কাছে কোনো একটি সিদ্ধান্তের আশা করবেন না। আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে চাই, এই সংকট থেকে আমরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবো না।’ চীনের প্রতিনিধি বলেন, ঢাকা ফিরে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তাদের কথা হবে। পরে নিউ ইয়র্কে ফিরে তারা একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করবেন। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের মধ্যে কুয়েতের প্রতিনিধি মনসুর আলোতাইবিও সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদ তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে বা মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করবে- এমন আশা করা ঠিক হবে না। আমার মনে হয় না, নিরাপত্তা পরিষদ শিগগিরই কোনো অবরোধ আরোপ করতে যাবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো বিরোধ তো নেই। তিনি বলেন, ‘সমস্যার সূচনা হয়েছে মিয়ানমারে। নিরাপত্তা পরিষদে আমরা হয়ত এখন নতুন একটি প্রস্তাব আনতে পারবো। সেখানে আমরা হয়তো মিয়ানমারকে বলতে পারবো, যাতে তারা তাদের দায়িত্ব, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সনদের প্রতি তাদের যে অঙ্গীকার, তা যেন তারা পালন করে।’ পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে আর খারাপের দিকে যাবে না এবং রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন কুয়েতের প্রতিনিধি। মিয়ানমার রাখাইনে যে বর্বরতা চালিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ তাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করবে কি না- সে প্রশ্নও রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। তবে একজন প্রতিনিধি উত্তরে বলেন, ‘সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছে কি না- সে রায় কেবল একটি আদালতই দিতে পারে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বললেন- প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, কিছু বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সব দেশের একমত হতে হয়তো সময় লাগবে। তবে এ সমস্যার সমাধান যে দ্রুত করা উচিত। এ সমস্যার সমাধান যে মিয়ানমারেই নিহিত আছে, এই সমস্যার জন্য দায়ী না হয়েও বাংলাদেশকে যে ভুগতে হচ্ছে, সেজন্য বাংলাদেশের পাশে থাকা- এসব বিষয়ে তারা সবাই একমত। ‘যে বিষয়টিতে অনেকে একমত নন, তাহলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরো শক্ত কোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রে। অনেকে মনে করতে পারেন এটা কালকে হওয়া উচিত, অনেকে মনে করতে পারেন, আরো কিছুদিন চেষ্টা করে তারপর হওয়া উচিত, অনেকে মনে করতে পারেন- না এটা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। কিন্তু দোষটা যে মিয়ানমারের, সমাধান যে মিয়ানমারকে করতে হবে, সে বিষয়ে সকলেই একমত।’ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে নিজেদের দাবির কথা তাদের সামনে তুলে ধরেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা ভিশনের একটি ব্যানারে লেখা ছিল- ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ সরকার’। রোহিঙ্গা যুব উন্নয়ন সোসাইটির ব্যানারে লেখা ছিল- ‘নিজের ভাষায় পড়া ও শেখার অধিকার আমাদেরও আছে’। রাস্তার পাশে থাকা এক রোহিঙ্গা প্রৌঢ় সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতিসংঘের অফিস আমাদের দেশে দিতে হবে, হাতে পায়ে ধরে হলেও এ অফিস দিতে হবে। তাহলে আমাদের শান্তি হবে। আমাদের রোহিঙ্গা হিসেবে মেনে নিতে হবে। মা বোনদের ওপর যে জুলুম হয়েছে, মেরে ফেলেছে, কেটে ফেলেছে, তার বিচার হতে হবে। বিচার হলেই আমাদের শান্তি হবে।’ আরেক রোহিঙ্গা নারী তার দুর্দশার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘অনেক অত্যাচার-জুলুম থেকে রক্ষা পেতে আমরা এখানে এসেছি। আমাদের স্বামী, ছেলে-মেয়েদের মেরে ফেলেছে ওরা। এই দুঃসময়ে উপোস ছিলাম, এখানে আমাদের স্থান দেয়া হয়েছে। আশ্রয় পেয়েছি, কাপড়-চোপড় পেয়েছি এখানে। এখন বন্যা আসছে, ত্রিপলে থাকছি। এখন আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। আমরা যে অধিকার তা পেতে চাই। এজন্যে কোর্টের কাছে বিচার চাই।’ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, পোলান্ড, সুইডেন, গিনি ও আইভরি কোস্টের প্রতিনিধিরা ছাড়াও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এএইচএম মনিরুজ্জামান, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, জেলার পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান ও উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রাতারাতি সমাধানের আশা নেই: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকটের রাতারাতি জাদুকরী কোনো কিছু আশা করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করে কক্সবাজার ছাড়েন। গতকাল রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অবস্থান সরজমিন দেখে তারা বলেন- আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে। এ বিষয়ে আগাম ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। রোহিঙ্গাদের সংকটের উৎস মিয়ানমারে। মিয়ানমারকেই এ সংকটের দীর্ঘস্থায়ী ও সম্মানজনক সমাধান করতে হবে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এ কাজে আন্তরিকতার সঙ্গে সহায়তা দিয়ে যাবে। দুপুরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু শিবির উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী আশ্রয় শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে- যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি: সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। তিন দিনের সফরে নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের ১৫ দূতসহ মোট ৪০ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি শনিবার বাংলাদেশে আসে। সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকালে প্রথমেই তারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়ায় শূন্যরেখায় যায়। সেখানে আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন দলটির সদস্যরা। পরে কুতুপালং শিবির ঘুরে দেখেন। পরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চারটি দলের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে কথা বলেন তারা। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রতিনিধিদলের কয়েক জন সদস্য। সফরকারী এ দলের সদস্য এবং নিরাপত্তা পরিষদে পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি গুস্তাভ মেজা কোয়াদ্রা বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে কীভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সহযোগিতা করা যায়, সেটি বুঝতে এ সফরে এসেছি। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আমরা সহযোগিতা করে যাবো।’ কোয়াদ্রা বলেন, এখন যে পরিস্থিতি রয়েছে, তা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযোগী নয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের যে সহযোগিতা করেছে, তার ভূয়সী প্রশংসা করেন কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আল ওতাইবি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের জনগণ রোহিঙ্গাদের যে সহযোগিতা করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। রোহিঙ্গাদের বিষয় নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা? সংবাদ সম্মেলনে সেই প্রশ্নও ওঠে। জবাবে এ দলের সদস্য এবং নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বুঝতে এ সফর অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাস্তবিক অবস্থা কেমন, সেটি জানতে সহকর্মীদের সঙ্গে আমি এ সফরে এসেছি।’ তিনি এটিও উল্লেখ করেন, নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখনো একটি বিতর্কিত বিষয়। একই প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রতিনিধি বলেন, ‘এ সমস্যা যে বাংলাদেশের জনগণকে কতটা প্রভাবিত করছে, তা আমরা বুঝতে পারছি। আমরা মনে করি, এ সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান দরকার দুই দেশের মধ্যেই। সমস্যার সমাধানে মানবিক দিকটি বিবেচনা করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে শুরু থেকেই চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।
তিনি এও উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ওঠে, নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের ওপর নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে কিনা? জবাবে পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি গুস্তাভ মেজা কোয়াদ্রা বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি বাস্তব পরিস্থিতি কী তা বুঝতে এবং জানতে। নিউ ইয়র্কে ফিরে আমরা আলোচনা করবো। তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
বাবা-মাকে হত্যার বর্ণনায় আমেনার বিলাপ: ওদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সামনে নিজ নিজ পরিবারের উপর বয়ে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন রোহিঙ্গারা। সীমান্তের তুমব্রু জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের জীবনমান দেখতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হন সফররত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ টিম। সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথার সময় রোহিঙ্গা কিশোরী আমেনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি উচ্চস্বরে বিলাপ করে চোখের সামনেই বাবা সৈয়দ আলম ও মা সখিনাকে গুলি করার বর্ণনা দেন। বলেন, হত্যার দৃশ্য দেখে ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ সময় তাকে বারবার সান্ত্ব্তনা দিচ্ছিলেন সফররত দলের প্রধান। তারা কিশোরী আমেনার বাবাসহ রাখাইনে হত্যার শিকার সবার বিচার পেতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। রোববার সকাল সোয়া ৯টার দিকে ৩০ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রুর কোনারপাড়া জিরো পয়েন্ট এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে তারা দুপুর ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। শূন্যরেখা থেকে ফিরে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কুতুপালং ক্যামপ পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে ফিরে ক্যাম্পে যান।
রোহিঙ্গা সংকটটি ‘স্পটলাইটে’ রাখার প্রতিশ্রুতি: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়ার শূন্যরেখা এবং উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা নিউ ইয়র্কে ফিরে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার অঙ্গীকার করেন। বলেন, এই সংকট থেকে বিশ্ববাসী চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। জাতিসংঘও তা করবে না। গত বছর আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হওয়ার পর এই প্রথম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করলো। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যাপক হত্যা-নির্যাতনের মুখে গত আট মাসে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পর্ষদ হিসেবে বিবেচিত নিরাপত্তা পরিষদেও এ সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনা এসেছে সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে। তবে রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গতকাল পরিষদের প্রতিনিধিরা এক ঘণ্টার বেশি সময় ক্যাম্প এবং নো-ম্যান্সল্যান্ডে কাটিয়েছেন। ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এবং তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের মতামত শোনেন।
পরে কুতুপালংয়ের সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বলেন, ‘সিকিউরিটি কাউন্সিলের ওপর অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো ম্যাজিক সলিউশন নেই। আমরা সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। সেজন্যই বাংলাদেশে এখানে এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতি আসলে কেমন, তা দেখা আমাদের জন্য জরুরি ছিল।’ রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা এখনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে এই সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। আমরা দুই দেশের সরকারকেই বোঝাতে চেষ্টা করছি যেন তারা গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যায়। আর আমরাও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।’ নিরাপত্তা পরিষদে এ সংকট নিয়ে আলোচনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে পোলিয়ানস্কি বলেন, ‘আমরা আলোচনা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছি না, চোখ বন্ধ করেও থাকছি না। সে কারণেই আমরা আজ এখানে এসেছি।’ তিনি বলেন, কিছু কিছু সময় থাকে যখন সংকটের কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তারা একটি ‘ভালো’ সমাধান খুঁজে বের করতে চান, যা ‘সবার কাছে গ্রহণযাগ্য’ হবে। নিরাপত্তা পরিষদে চীনের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, ‘আমরা এখনই কোনো সমাধান বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়ার জন্য হয়তো প্রস্তুত নই।
আমি বলতে চাই, এখানে এসে, ক্যাম্প পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে আমাদের মিশন শুরু হলো। যে পরিমাণ সাংবাদিক এখানে আছেন, তাতে স্পষ্ট যে বিষয়টি মিডিয়ার কতটা মনোযোগে আছে। ‘আমি বলতে চাই, আমরা এখানে প্রমোদ ভ্রমণে বা ছুটি কাটাতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি কারণ এটাকে আমরা গুরুতর সংকট বলে মনে করছি এবং সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। সুতরাং আজই আপনারা আমাদের কাছে কোনো একটি সিদ্ধান্তের আশা করবেন না। আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে চাই, এই সংকট থেকে আমরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবো না।’ চীনের প্রতিনিধি বলেন, ঢাকা ফিরে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তাদের কথা হবে। পরে নিউ ইয়র্কে ফিরে তারা একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করবেন। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের মধ্যে কুয়েতের প্রতিনিধি মনসুর আলোতাইবিও সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদ তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে বা মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করবে- এমন আশা করা ঠিক হবে না। আমার মনে হয় না, নিরাপত্তা পরিষদ শিগগিরই কোনো অবরোধ আরোপ করতে যাবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো বিরোধ তো নেই। তিনি বলেন, ‘সমস্যার সূচনা হয়েছে মিয়ানমারে। নিরাপত্তা পরিষদে আমরা হয়ত এখন নতুন একটি প্রস্তাব আনতে পারবো। সেখানে আমরা হয়তো মিয়ানমারকে বলতে পারবো, যাতে তারা তাদের দায়িত্ব, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সনদের প্রতি তাদের যে অঙ্গীকার, তা যেন তারা পালন করে।’ পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে আর খারাপের দিকে যাবে না এবং রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন কুয়েতের প্রতিনিধি। মিয়ানমার রাখাইনে যে বর্বরতা চালিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ তাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করবে কি না- সে প্রশ্নও রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। তবে একজন প্রতিনিধি উত্তরে বলেন, ‘সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছে কি না- সে রায় কেবল একটি আদালতই দিতে পারে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বললেন- প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, কিছু বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সব দেশের একমত হতে হয়তো সময় লাগবে। তবে এ সমস্যার সমাধান যে দ্রুত করা উচিত। এ সমস্যার সমাধান যে মিয়ানমারেই নিহিত আছে, এই সমস্যার জন্য দায়ী না হয়েও বাংলাদেশকে যে ভুগতে হচ্ছে, সেজন্য বাংলাদেশের পাশে থাকা- এসব বিষয়ে তারা সবাই একমত। ‘যে বিষয়টিতে অনেকে একমত নন, তাহলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরো শক্ত কোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রে। অনেকে মনে করতে পারেন এটা কালকে হওয়া উচিত, অনেকে মনে করতে পারেন, আরো কিছুদিন চেষ্টা করে তারপর হওয়া উচিত, অনেকে মনে করতে পারেন- না এটা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। কিন্তু দোষটা যে মিয়ানমারের, সমাধান যে মিয়ানমারকে করতে হবে, সে বিষয়ে সকলেই একমত।’ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে নিজেদের দাবির কথা তাদের সামনে তুলে ধরেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা ভিশনের একটি ব্যানারে লেখা ছিল- ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ সরকার’। রোহিঙ্গা যুব উন্নয়ন সোসাইটির ব্যানারে লেখা ছিল- ‘নিজের ভাষায় পড়া ও শেখার অধিকার আমাদেরও আছে’। রাস্তার পাশে থাকা এক রোহিঙ্গা প্রৌঢ় সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতিসংঘের অফিস আমাদের দেশে দিতে হবে, হাতে পায়ে ধরে হলেও এ অফিস দিতে হবে। তাহলে আমাদের শান্তি হবে। আমাদের রোহিঙ্গা হিসেবে মেনে নিতে হবে। মা বোনদের ওপর যে জুলুম হয়েছে, মেরে ফেলেছে, কেটে ফেলেছে, তার বিচার হতে হবে। বিচার হলেই আমাদের শান্তি হবে।’ আরেক রোহিঙ্গা নারী তার দুর্দশার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘অনেক অত্যাচার-জুলুম থেকে রক্ষা পেতে আমরা এখানে এসেছি। আমাদের স্বামী, ছেলে-মেয়েদের মেরে ফেলেছে ওরা। এই দুঃসময়ে উপোস ছিলাম, এখানে আমাদের স্থান দেয়া হয়েছে। আশ্রয় পেয়েছি, কাপড়-চোপড় পেয়েছি এখানে। এখন বন্যা আসছে, ত্রিপলে থাকছি। এখন আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। আমরা যে অধিকার তা পেতে চাই। এজন্যে কোর্টের কাছে বিচার চাই।’ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, পোলান্ড, সুইডেন, গিনি ও আইভরি কোস্টের প্রতিনিধিরা ছাড়াও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এএইচএম মনিরুজ্জামান, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, জেলার পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান ও উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
No comments