পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতি
বহির্বিশ্বের বহমান ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমরা যদি যথোপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ
করতে পারি, তাহলে গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা সম্ভবপর ও সহজতর হয়ে
উঠতে পারে। সম্প্রতি প্রয়াত ব্রিটেনের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী
মার্গারেট থ্যাচারের সাফল্যসমৃদ্ধ জীবন এবং তাঁর
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদি ও আলোচনা থেকে আমার মনে হয়,
আমাদের রাজনৈতিক দিক থেকে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে প্রচুর। এটা অনস্বীকার্য
যে বিতর্কিত হলেও মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ ও সফল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান রক্ষণশীল দলীয় প্রধানমন্ত্রী
ক্যামেরন তাঁকে ব্রিটেনের ‘শান্তিকালে শ্রেষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ
করেছেন। যেমন স্যার উইনস্টন চার্চিল ছিলেন ‘শ্রেষ্ঠতম যুদ্ধকালীন
প্রধানমন্ত্রী’। থ্যাচারের ব্যয়বহুল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজনে রক্ষণশীল
দল যথেষ্ট দলগত প্রচারেরও সুবিধা পেয়েছে। থ্যাচারের বহু কর্মকাণ্ড
তীব্রভাবে বিতর্কিত ছিল। লেবার পার্টি এবং ব্রিটেনের মেহনতি জনতা ও
লেবার-ইউনিয়নগুলো থ্যাচারের অনুসৃত নীতিতে তাঁর আমলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছিল। তবু বহির্বিশ্বে তারা (অর্থাৎ রক্ষণশীল ও লেবার পার্টি) উভয়ই
সম্মিলিতভাবে থ্যাচারকে বহির্বিশ্বে ও ইতিহাসের পাতায় প্রক্ষেপিত করল
ব্রিটেনের এক সার্থক পতাকাবাহী হিসেবে। শুনে অবাক হয়েছি, ১৯৯৪ সালে স্বামী
ডেনিস থ্যাচারের মৃত্যু-পরবর্তী একাকী জীবনে বছর পাঁচেক আগে যখন মার্গারেট
থ্যাচারের প্রথম স্ট্রোক হলো, তখনই বিরোধীদলীয় লেবার পার্টির নেতা সাবেক
প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনই মার্গারেটের সম্ভাব্য শেষকৃত্যের
আনুষ্ঠানিকতার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর এই ব্যয়বহুল আনুষ্ঠানিকতাগুলোর
যৌক্তিকতার সপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে
বলেন, পরিকল্পনার চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন বিরোধীদলীয় নেতা
এডমিলিব্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে ও তাঁর সম্মতি অনুসারেই হয়েছে। সাবেক
প্রধানমন্ত্রী লেবারের টনি ব্লেয়ার তো সস্ত্রীক প্রথমেই উপস্থিত হন
অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে। প্রশস্তিতে বিরোধীদলীয় এডমিলিব্যান্ড বলেন, ‘তিনি
(মার্গারেট) একটি পুরো প্রজন্মের রাজনীতির পূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন।
...তিনি ব্রিটিশ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু স্থানান্তরিত করেন। হয়ে দাঁড়ান
বিশ্বমঞ্চে এক প্রধানতম ভূমিকা পালনকারী।’ আমাদের দেশের পারস্পরিক কাদা
ছোড়াছুড়ির ও অশ্লীল বাক্যবিনিময়ের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এসব যেন
অকল্পনীয় কাহিনি। ‘ব্রিটিশ লেবার পার্টির সর্বাধিক সফল প্রতিপক্ষ’ ও
‘সর্বাত্মক শত্রু’ ব্যারনেস থ্যাচার অব কেসটেভেন জীবন শুরু করেছিলেন
মার্গারেট হিলদা রবার্টস নামে, ছোট শহর গ্র্যান্থামের এক মুদির দোকানের
মালিকের মেয়ে হয়ে। তাঁর ৮৭ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে কেসটেভেন, অক্সফোর্ড,
পার্লামেন্ট, দলনেতা ও তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত
হয়েছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং পশ্চিমা ক্যাপিটেলিস্ট সভ্যতার
প্রবক্তা হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সঙ্গে ছিল তাঁর
নিবিড়তম আদর্শিক সখ্য, প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়রকে তিনি উপসাগরীয় যুদ্ধে
ইরাকের বিরুদ্ধে কোনো সহনশীলতা দেখাতে তীব্রভাবে বারণ করেছিলেন। রক্ষণশীল
হলেও তিনি গর্ভপাত আইনসম্মতভাবে করার পক্ষে ছিলেন, আইনানুগ মৃত্যুদণ্ডের
তিনি ছিলেন সপক্ষে। ফকল্যান্ডস পুনরুদ্ধার করতে আট হাজার মাইল দূরে
আটলান্টিকের ওপারে ব্রিটিশ রণতরি পাঠাতে ৩৬৮ জন নাবিকসমেত আর্জেন্টিনিয়ান
যুদ্ধজাহাজকে সাবমেরিন দিয়ে ডোবাতে তিনি ভ্রুক্ষেপ করেননি। তাঁর
প্রয়াণ-পূর্ব নির্দেশানুসারে শেষ বিদায়ের কালে গীত হয়েছিল উগ্র ব্রিটিশ
জাতীয়তাবাদের ব্যঞ্জনাময় ভিক্টোরিয়ান লিরিক: ‘হে আমার দেশ, তোমার কাছে
আমি শপথবদ্ধ (আই ভাউ টু দি, মাই কান্ট্রি...)।’ তদনুসারেই বাইবেল থেকে তাঁর
নাতনি আমান্দা থ্যাচার পড়ে শুনিয়েছিলেন, ‘ঋজু হয়ে দাঁড়াও। সত্যকে তুলে
ধরো। ন্যায়নিষ্ঠাকে বুকে প্রোথিত করো।’ কিন্তু এ কোন সত্য, কোন
ন্যায়নিষ্ঠা? শুধু যা ছিল ব্রিটেনের স্বার্থের অনুকূল, পশ্চিমি সভ্যতা
প্রসারে সহায়ক। কমিউনিজম সাম্যবাদের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। মিখাইল
গর্বাচভ ক্ষমতা গ্রহণের আগেই থ্যাচার তাঁকে চিহ্নিত করেছিলেন, ‘ অ্যা ম্যান
উই ক্যান ডু বিজনেস উইথ’—এ ব্যক্তির সঙ্গে আমরা কাজ করতে পারব, এই ছিল
তাঁর উক্তি। এবং পরবর্তীকালে এই গর্বাচভের বিভীষণী ভূমিকাই ইউরোপে
কমিউনিজমের সমাধি রচনা করতে মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। নেলসন ম্যান্ডেলাকে
থ্যাচার ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন। যার জন্য কেন
লিভিংস্টোন ও জর্জ গ্যালওয়ের মতো বামপন্থী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা তাঁকে
তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছিলেন। উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্পর্কেও তাঁর একটি
নাক-উঁচু কিছুটা অবজ্ঞাসূচক মনোভাব ছিল। ব্রিটেনে থাকাকালীন আমি যখন
অ্যাসোসিয়েশন অব ইকোনমিক রিপ্রেজেন্টেটিভস ইন লন্ডনের (এইআরএল) সভাপতি
ছিলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন আগেই থ্যাচারকে একটি মধ্যাহ্নভোজ
ভাষণে আমন্ত্রণ করেছিলাম। তিনি জোরেশোরে একটি কথাই বলেছিলেন, নতুন স্বাধীন ও
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আমার একটিই উপদেশ—সোশ্যালিজমের অভিশপ্ত পথ পরিহার
করে পশ্চিমা জগতের গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করো—অনুসরণ করো
তাদেরই, যারা সফল হয়েছে—(অর্থাৎ পশ্চিমকে বা ক্যাপিটেলিস্টদের) সোভিয়েত
সংবাদ সংস্থা ‘টাস’ তাঁকে আয়রন লেডি বা লৌহমানবী অ্যাখ্যা দিয়েছিল।
শ্লেষাত্মক ছিল তা, কিন্তু থ্যাচার এই বর্ণনাকে যথার্থ বলেই গ্রহণ
করেছিলেন। এমনকি ওয়েস্টমিনস্টারে যখন উইনস্টন চার্চিলের বিপরীতে ২০০৭ সালে
তাঁর ব্রোঞ্জনির্মিত আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল, কৌতুকচ্ছলে তিনি
বলেছিলেন, ‘এটা লোহার তৈরি হলেই ভালো হতো’।
যে বিষয়টি আমি লক্ষণীয় বলে মনে করি, চিন্তায় ও ভাবাদর্শে বিপরীতধর্মী হলেও ব্রিটেনের লেবার পার্টি তাঁকে সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছে এ জন্য যে তিনি ব্রিটেনের মর্যাদা বহির্বিশ্বে উন্নত করেছিলেন এবং ব্রিটিশ জনগণকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জাতির স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে, স্বদেশের সম্মান ও পতাকা উঁচু করে ধরে রাখতে সব রাজনৈতিক দলই ঐক্যবদ্ধ। সে অবস্থা যদি প্রতিপক্ষের অনুকূলে যায়, তবুও। অবশ্য থ্যাচারও নমনীয় ও সমঝোতামূলক ভাব দেখিয়েছেন প্রয়োজনমতো। জাতীয় স্বার্থে। যখন হংকংকে চীনের কর্তৃত্বে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চীনা নেতা দেং জিয়াওপিংয়ের সঙ্গে ১৯৮২ সালে তিনি আলোচনা করেন এবং দেং তাঁকে বলেন, ‘মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী, চীন ইচ্ছা করলে আজ বিকেলেই হংকংকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।’ তখন বাস্তববাদী থ্যাচার বলেন, ‘তা ঠিক, কিন্তু হংকংয়ের জন্য বা চীনের খ্যাতির জন্য তা ভালো হবে না। চলুন, আমরা একটি সম্মানজনক সমঝোতাভিত্তিক হস্তান্তর-প্রক্রিয়া স্থির করি।’ এবং তা-ই করা হলো। এই পরিস্থিতিতে নমনীয় হতে থ্যাচার কোনো দ্বিধা করেননি। এই ঘটনাগুলো এবং অবস্থান বিশ্লেষণ থেকে দেখা যেতে পারে যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। দেরিতে হলেও, বর্তমানে সংলাপের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আমরা আশা করব, সরকারি দল উপলব্ধি করতে চেষ্টা করবে যে দলীয় ক্ষমতাধীন নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বিএনপি ও সহযোগী দলগুলো তাতে অংশ নেবে না। আমাদের গণতন্ত্রের ইতিহাসও সুস্পষ্টভাবে শুধু নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিচালনাধীন নির্বাচন-উত্তর সরকার গঠনের সাক্ষ্য দিচ্ছে। সুতরাং অংশগ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য আলোচনা এখনই শুরু হোক এবং রেওয়াজমতো প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে লিখিতভাবে আহ্বান করুন। সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে মুক্তি দিয়ে, সভা-সমাবেশের অনুমতি দিয়ে আলোচনার এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। নইলে অন্যান্য বহু অপশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তাদের কিছুতেই রুখতে পারবেন না। বিভাজনের খাল কাটলে যে কুমির আসবে, সে হবে সর্বগ্রাসী। ইতিমধ্যেই তার আলামত দেখা যাচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া স্থিরীকৃত হলেই দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা আসবে।
শুধু গণতন্ত্রের জন্যই নয়, অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য আজ তা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে আজ যদি আমরা এক ইতিবাচক বা পজিটিভ ভাবমূর্তিতে প্রকাশ না করতে পারি, তাহলে আমাদের প্রায়-বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে দাঁড়াবে। বিরোধী দলের গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার স্থিরীকৃত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-হরতাল চলবেই। ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে আমাদের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতি। বতুতপক্ষে জীবনের সব কটি দিক।
বাংলাদেশের বর্তমান সাংঘর্ষিক সংকট এড়াতে সহায়তা দিতে কূটনৈতিক উদ্যোগের কোনো কমতি হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসপ্রধানেরা ছাড়াও আসছেন বহু সফরকারী। কিছুদিন আগে ওআইসির মহাসচিব এসে কথা বলে গেলেন। সফর করে গেলেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। সরকারের উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণসমন্বিত নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত এক নিরপেক্ষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে সংলাপের আয়োজন করা।
নিবন্ধের প্রথমার্ধে আমি ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির সূতিকাগার ব্রিটেনে কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলো আচরণ করে এবং একে অন্যের প্রতি সমীহ ও সহযোগিতামূলক সম্মান দেখায়, তা ব্যক্ত করেছি। প্রধানমন্ত্রী লক্ষ করতে পারেন, কীভাবে লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচার হংকং ইস্যুতে বাস্তববাদী হয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও সংকট নিরসনে নমনীয় হয়ে সমঝোতামূলক মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। তা না করতে পারলে কিন্তু হবে তাঁরই ব্যর্থতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের কাছ থেকেই ধার করে নিয়ে পাকিস্তান একটা সর্বাঙ্গসুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করল। নিশ্চয়তা বিধান করল গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের। নেপালেও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড়।
বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় কিন্তু সরকারের। আর এ নিয়ে উদ্যোগ নেওয়ার মুখ্য দায়িত্ব সরকারি দল ও তার নেত্রীর।
সরকারকে এটা ভুললে চলবে না, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির মূল ও অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে পার্টিসিপেটরি বা অংশগ্রহণসমন্বিত সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন। আর তার নিশ্চয়তা বিধান না করতে পারলে তা হয়ে দাঁড়াবে দলীয় স্বৈরাচার।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: উপদেষ্টা, বিএনপিরচেয়ারপারসন।
যে বিষয়টি আমি লক্ষণীয় বলে মনে করি, চিন্তায় ও ভাবাদর্শে বিপরীতধর্মী হলেও ব্রিটেনের লেবার পার্টি তাঁকে সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছে এ জন্য যে তিনি ব্রিটেনের মর্যাদা বহির্বিশ্বে উন্নত করেছিলেন এবং ব্রিটিশ জনগণকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জাতির স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে, স্বদেশের সম্মান ও পতাকা উঁচু করে ধরে রাখতে সব রাজনৈতিক দলই ঐক্যবদ্ধ। সে অবস্থা যদি প্রতিপক্ষের অনুকূলে যায়, তবুও। অবশ্য থ্যাচারও নমনীয় ও সমঝোতামূলক ভাব দেখিয়েছেন প্রয়োজনমতো। জাতীয় স্বার্থে। যখন হংকংকে চীনের কর্তৃত্বে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চীনা নেতা দেং জিয়াওপিংয়ের সঙ্গে ১৯৮২ সালে তিনি আলোচনা করেন এবং দেং তাঁকে বলেন, ‘মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী, চীন ইচ্ছা করলে আজ বিকেলেই হংকংকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।’ তখন বাস্তববাদী থ্যাচার বলেন, ‘তা ঠিক, কিন্তু হংকংয়ের জন্য বা চীনের খ্যাতির জন্য তা ভালো হবে না। চলুন, আমরা একটি সম্মানজনক সমঝোতাভিত্তিক হস্তান্তর-প্রক্রিয়া স্থির করি।’ এবং তা-ই করা হলো। এই পরিস্থিতিতে নমনীয় হতে থ্যাচার কোনো দ্বিধা করেননি। এই ঘটনাগুলো এবং অবস্থান বিশ্লেষণ থেকে দেখা যেতে পারে যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। দেরিতে হলেও, বর্তমানে সংলাপের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আমরা আশা করব, সরকারি দল উপলব্ধি করতে চেষ্টা করবে যে দলীয় ক্ষমতাধীন নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বিএনপি ও সহযোগী দলগুলো তাতে অংশ নেবে না। আমাদের গণতন্ত্রের ইতিহাসও সুস্পষ্টভাবে শুধু নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিচালনাধীন নির্বাচন-উত্তর সরকার গঠনের সাক্ষ্য দিচ্ছে। সুতরাং অংশগ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য আলোচনা এখনই শুরু হোক এবং রেওয়াজমতো প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে লিখিতভাবে আহ্বান করুন। সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে মুক্তি দিয়ে, সভা-সমাবেশের অনুমতি দিয়ে আলোচনার এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। নইলে অন্যান্য বহু অপশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তাদের কিছুতেই রুখতে পারবেন না। বিভাজনের খাল কাটলে যে কুমির আসবে, সে হবে সর্বগ্রাসী। ইতিমধ্যেই তার আলামত দেখা যাচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া স্থিরীকৃত হলেই দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা আসবে।
শুধু গণতন্ত্রের জন্যই নয়, অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য আজ তা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে আজ যদি আমরা এক ইতিবাচক বা পজিটিভ ভাবমূর্তিতে প্রকাশ না করতে পারি, তাহলে আমাদের প্রায়-বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে দাঁড়াবে। বিরোধী দলের গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার স্থিরীকৃত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-হরতাল চলবেই। ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে আমাদের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতি। বতুতপক্ষে জীবনের সব কটি দিক।
বাংলাদেশের বর্তমান সাংঘর্ষিক সংকট এড়াতে সহায়তা দিতে কূটনৈতিক উদ্যোগের কোনো কমতি হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসপ্রধানেরা ছাড়াও আসছেন বহু সফরকারী। কিছুদিন আগে ওআইসির মহাসচিব এসে কথা বলে গেলেন। সফর করে গেলেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। সরকারের উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণসমন্বিত নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত এক নিরপেক্ষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে সংলাপের আয়োজন করা।
নিবন্ধের প্রথমার্ধে আমি ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির সূতিকাগার ব্রিটেনে কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলো আচরণ করে এবং একে অন্যের প্রতি সমীহ ও সহযোগিতামূলক সম্মান দেখায়, তা ব্যক্ত করেছি। প্রধানমন্ত্রী লক্ষ করতে পারেন, কীভাবে লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচার হংকং ইস্যুতে বাস্তববাদী হয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও সংকট নিরসনে নমনীয় হয়ে সমঝোতামূলক মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। তা না করতে পারলে কিন্তু হবে তাঁরই ব্যর্থতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের কাছ থেকেই ধার করে নিয়ে পাকিস্তান একটা সর্বাঙ্গসুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করল। নিশ্চয়তা বিধান করল গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের। নেপালেও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড়।
বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় কিন্তু সরকারের। আর এ নিয়ে উদ্যোগ নেওয়ার মুখ্য দায়িত্ব সরকারি দল ও তার নেত্রীর।
সরকারকে এটা ভুললে চলবে না, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির মূল ও অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে পার্টিসিপেটরি বা অংশগ্রহণসমন্বিত সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন। আর তার নিশ্চয়তা বিধান না করতে পারলে তা হয়ে দাঁড়াবে দলীয় স্বৈরাচার।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: উপদেষ্টা, বিএনপিরচেয়ারপারসন।
No comments