রেলের কালো বিড়ালেরা কোথায়?

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সাবেক রেলমন্ত্রী এ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা দূর করতে প্রথমেই রেলের কালো বিড়াল খুঁজে বের করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই বিড়াল খুঁজে পাওয়ার আগেই  তিনি কালো বিড়ালের শিকার হয়ে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন। মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী যোগ দিলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকারের মৌখিক সদিচ্ছা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুবই কম। দীর্ঘদিন ধরে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি হয় না—এ কারণ দেখিয়ে রেলের ভাড়া শতভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। রেলে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল, সেটিও তুলে নেওয়া হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয় সেবার মান বাড়াতে না পারলেও ভাড়া বাড়ানোর কাজটি সফলভাবেই করতে পেরেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রেল সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি পর্যায়ে কিছু বিআরটিসি বাস চলাচল করলেও সড়কপথে চলে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস। রেলপথকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই সড়কপথের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে। নয়তো রেল যোগাযোগ কখনোই  কার্যকর হবে না। সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সড়কপথের সঙ্গে বহুমাত্রিক পুঁজির বিনিয়োগ রয়েছে। সবাই চাইবে, সড়কপথ চালু থাকুক। যারা বাসের পার্টস বিক্রি করে, তারা থেকে শুরু করে বাসের মালিক—কেউই চাইবে না রেলপথ সমৃদ্ধ হোক। কারণটা খুবই সহজ। ধরা যাক রংপুর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামের সড়ক ও রেলপথের কথা। সরকার যদি রংপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত সরাসরি কোনো রেলপথ গড়ে তোলে, সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ট্রেন চালু করে এবং ট্রেনের ব্যবস্থাপনা যদি ঠিক থাকে, তাহলে রংপুর থেকে কোন যাত্রী কী কারণে রেলপথ ছেড়ে সড়কপথে যাওয়া-আসা করবে? একবার যদি রেলপথ স্থান করে নেয়, তাহলে সড়কপথ আর কখনোই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। এ কারণে সড়কপথের ব্যবসায়ীরা কিছুতেই চান না, রেলপথ শক্তিশালী হোক। রেলপথে সুবিধা অনেক। প্রতিবছর বহু মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, অনেকের অঙ্গহানি ঘটে। রেলপথের প্রসার ঘটলে এসব দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো যেত। রেলযাত্রা শুধু নিরাপদই নয়, সাশ্রয়ীও। সরকার মুনাফা করতে পারবে অনেক বেশি, জ্বালানি খরচ হবে কম। পণ্য পরিবহন ব্যয় কমে আসবে। সড়কপথের ব্যবসায়ীরা রেলের উন্নয়নে প্রতিবন্ধক কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারের মেয়াদের শেষ বছর চলছে। কোনো বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ রেলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। মেয়াদের শেষ বছর হিসেবে নির্বাচনী বাজেট চেয়েছেন সাংসদেরা। স্থানীয় পর্যায়ে কাজের বহর দেখিয়ে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে চান তাঁরা। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কাজ করলে সাংসদদের ভোটের রাজনীতিতে হয়তো কিছুটা সুবিধা হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে অনেক বড় কোনো কাজ করে সরকার যদি বৃহৎ অর্থে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে, সেটা নিশ্চয় অনেক ভালো। সরকার যোগাযোগব্যবস্থায় অনেক বড় একটি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে। রেলপথেও ভালো কিছু করা যায়নি। ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডেমুর প্রথম সেটের উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ডেমু চালু করার ব্যাপারে সরকার অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের উচিত ছিল, এক বগিবিশিষ্ট ডেমু না এনে তিন বগিযুক্ত ডেমু সেট চালু করা। আমাদের দেশে যেখানে দূরপাল্লার ট্রেনের অনেক অভাব, সেখানে ডেমু না এনে ‘এই টাকায় চারটি শক্তিশালী ইঞ্জিন ও এক শ কোচ’ কেনা যেত। এখনো আমাদের ইঞ্জিনের অভাবে কনটেইনার যথাসময়ে পরিবহন করা সম্ভব হয় না বলে রপ্তানিকাজ ব্যাহত হয়। যে ডেমু নিয়ে এসেছে সরকার, তার জন্য এখন প্ল্যাটফর্ম উঁচু করতে হবে। প্রথম দিন চলার পরই ডেমু বন্ধ রয়েছে। চলছে ডেমু সংস্কারের কাজ।
সরকার যদি আসন্ন নির্বাচনে কোনো খাতে অনেক বাজেট বরাদ্দ দিয়ে ভোটের সুবিধা নিতে চায়, তাহলে রেলকে সেই কাজে ব্যবহার করতে পারে। এই কাজটি এখন অত্যন্ত সহজ। যেসব স্থানে রেললাইন রয়েছে, সেসব স্থানে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ইঞ্জিন আর কোচ নিয়ে এসে রেল যোগাযোগকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। দেশের কাজও হবে, জনপ্রিয়তাও বাড়বে। আমাদের রেলব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দিনাজপুরের সৈয়দপুর-পার্বতীপুরে যে রেলকারখানা গড়ে তুলেছিলেন, সেগুলোকে সক্রিয় করে দেশেই রেলের প্রয়োজনীয় সবকিছুই উৎপাদন করা সম্ভব। রেলওয়ের প্রচুর সম্পদ রয়েছে। সেই সম্পদের এখন কোনো সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। রেলের স্থাপনা ও ভূমি যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমেও অনেক আয় করা সম্ভব।
রেলব্যবস্থা যাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, হয়তো সে জন্যই রেলের প্রতি হরতালের দিনগুলোয় রেলপথকে নাশকতার বড় লক্ষ্যে পরিণত করেছে হরতালকারীরা। রেললাইন তুলে ফেলা, ফিশপ্লেট তুলে ফেলা, রেললাইনে আগুন দেওয়া, ক্লিপ খুলে ফেলা, লাইনের নিচে গ্রেনেড পুঁতে রাখা, লাইনের ওপর গাছ কেটে রাখা, স্টেশনে আগুন দেওয়াসহ বিভিন্ন নাশকতা করছে জামায়াত-শিবির। গত দু-তিন মাসে শতাধিক নাশকতা হয়েছে রেলে। এগুলো ভীতি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে খুবই সহজ। কারণ, ট্রেন চলে অনেক দ্রুত। কোথাও দ্রুত একটি লাইন খুলে ফেললেই দুর্ঘটনা অনিবার্য। অর্থমূল্যে এ ক্ষতি প্রায় ৫০ কোটি টাকা। রেলের নাশকতা বন্ধ করা না গেলে সড়কপথের ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভবান হবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ যাত্রী। রেলের সেবা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। স্টেশনগুলোয় জেনারেটর না থাকার কারণে বিদ্যুৎ থাকা সাপেক্ষে টিকিট পেতে হয়। এই বিড়ম্বনাও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। রেলের যত কালো বিড়াল রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করি, আসন্ন বাজেটে সরকার বরাদ্দ বাড়িয়ে রেলপথের  উন্নয়নে মনোযোগী হবে।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.