একটি আশার মৃত্যু

গত সপ্তাহে, নাজাত আল-আঘা তার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিনগুলো কাটিয়েছেন। কিন্তু একটা খবর তার হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। শনিবার মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ৬২০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীর। যার মধ্যে তার ছেলেরও থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে নাজাতের ছেলেকে এখনই মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। ১৬ বছর বয়সে একজন ইসরাইলি অফিসারকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া দিয়া আল-আঘা প্রায় ৩৩ বছর ধরে ইসরাইলি কারাগারে থাকা গাজার একজন বন্দী। ১৯৯২ সালের ১০ অক্টোবর দিয়ার গ্রেফতারের পর থেকে  তার পঁচাত্তর বছর বয়সী মা নাজাত ছেলের জন্য অপেক্ষা করে আসছেন। তিনি ছেলের জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন, অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন, সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন এবং বন্দীদের পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখদের একজন হয়ে উঠেছেন। আজ সেই মা কাতরকণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আমার আদরের ছেলে, আমি ৩৩ বছর ধরে তার মুক্তির জন্য অপেক্ষা করে আসছি। হঠাৎ করে সেই আনন্দের দিনটি আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।’

মায়ের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার
গাজায় হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ৬২০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল ইসরাইলের। হঠাৎ সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে তারা। এই ঘটনায় নাজাতই একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি হতাশ। শনিবার হামাস ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইল থেকে আটক ছয়জন বন্দীকে তাদের কাছে হস্তান্তর করে। অন্যদিকে ইসরাইলের বিভিন্ন সময়ে আটক ৬২০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তা না করার সিদ্ধান্ত নেয়, দাবি করে যে ছয় বন্দীর হস্তান্তর অনুষ্ঠান ‘উস্কানিমূলক’ ছিল।  তাই ইসরাইল বন্দীদের মুক্তি বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। নাজাত বলছেন, ‘যখন তারা আমাদের বলল যে, আমার ছেলে মুক্তি পাবে না, আমি চিৎকার করে বলে উঠি ‘কেন? কেন?’ তারপর আমি সংজ্ঞা হারাই।’

শনিবার সকালে, নাজাত তার আরেক ছেলে মোহাম্মদ, তার স্ত্রী ও সন্তানরা এবং তার মেয়ে ওলা সন্তানদের নিয়ে সালাহ আল-দিন স্ট্রিট ধরে খান ইউনিসে পৌঁছানোর উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন। সেখানেই বন্দীদের মুক্তি দেবার কথা হচ্ছিলো। যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় ধরে নাজাত ও তার পরিবার বাস্তুচ্যুত ছিল। সালাহ আল-দিনই একমাত্র রাস্তা যেখানে ইসরাইল গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। রাস্তায় ট্রাফিক দেখে নাজাতের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিলো। ২০২৩ সালের নভেম্বরে গাজায় হামলার সময় ইসরাইল যে খান ইউনিসে গোলাবর্ষণ করেছিল, সেখানে তাদের বিধ্বস্ত বাড়ি পৌঁছাতে এক ঘন্টারও বেশি সময় লেগেছে। এই যাত্রার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৪ কিলোমিটার (১৫ মাইল)।

দিয়ার আসন্ন মুক্তি উদযাপন করতে নাজাতের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধবরা  জড়ো হয়েছিলেন। ৩৩ বছর পর অবশেষে ছেলে বাড়ি ফিরতে চলেছে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না হতভাগ্য মা। যখন নাজাত শুনলেন যে ইসরাইল অবশেষে দিয়াকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে, তখন তার হৃদয়  আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। মায়ের মনের এই আনন্দ হয়তো ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। নাজাত বলে চলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরে এই দিনটির স্বপ্ন দেখছিলাম। ৩৩ বছর ধরে অপেক্ষা করার পর  আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে এই জীবদ্দশায় আমি আমার ছেলেকে আর হয়তো দেখতে পাবো না।’ কিন্তু মায়ের সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো না।

দিয়া আল-আঘা
আগে বন্দি বিনিময়ের তালিকায় দিয়া'র নাম ছিল। কিন্তু ইসরাইল তার অপরাধের কথা উল্লেখ করে দিয়াকে মুক্তি দেবার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে। ১৩ বছর বয়স থেকে ফাতাহ আন্দোলনের সদস্য দিয়া, ১৬ বছর বয়সে সশস্ত্র অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এখন তিনি স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন। তার পাচনতন্ত্রে সমস্যা রয়েছে। তার মায়ের অভিযোগ, ছেলেকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। নাজাত তার পরিবারের অন্যান্য পুরুষদের জন্য অপেক্ষা করেছেন এবং প্রার্থনা করেছেন যাদের আগে আটক করা হয়েছিল। নাজাতের স্বামী জাকারিয়াকে ১৯৭৩ সালে প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং দুই বছর ইসরাইলি হেফাজতে কাটাতে হয়েছিল। ২০০৫ সালে স্ট্রোকের পর তিনি মারা যান, মৃত্যুর ঠিক  আগের দিন ছেলে দিয়াকে কারাগারে দেখতে পেয়ে সেই শোক সামলাতে পারেননি তার বাবা। নাজাতের বড় ছেলে আজ্জামকে ১৯৯০ সালে ‘সন্ত্রাসী সামরিক শাখার’ সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল এবং চার বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছিল, অন্যদিকে মোহাম্মদ ১২ বছর জেল খেটেছিলেন, ইসরাইলি সৈন্যদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালানোর অভিযোগে। প্রতিবারই নাজাত অপেক্ষা করতেন, পরিবারের সদস্যদের বাড়ি ফেরার দিন গুনতেন। মাঝে মাঝে তিনি দিয়াকে কারাগারে দেখতে যেতেন। নাজাতের কথায়, ‘আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি কারণ গাজা যুদ্ধের মাত্র এক মাস আগে আমি তাকে শেষবার দেখেছিলাম। সে সুস্থ এবং দৃঢ় মনোবলে ছিল।’

‘আমরা কি শুধুই বন্ধকী?’
দিয়ার মুক্তির দিন যত কাছে আসছিলো ততই নাজাতের মনে প্রত্যাশার পারদ চড়ছিলো। তিনি আশা নিরাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। নাজাত বলে চলেন, ‘আমি জানি ইসরাইলি কারারক্ষীরা মুক্তির আগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্দীদের অপমান করে আনন্দ পায়। আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম।’ তা সত্ত্বেও ৩৩ বছর পর প্রথম রমজান ছেলের সাথে কাটানোর কল্পনা করেছিলেন নাজাত। ছেলেকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে দেবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন নাজাত। কিন্তু হঠাৎ এক বিরাট শূন্যতা গ্রাস করে এই হতভাগ্য মায়ের মনকে। যখন তিনি পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পারেন এবারও দিয়াকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। তার সন্তানেরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল, আশ্বস্ত করেছিল এই বলে একটু দেরি হলেও দিয়াকে ছেড়ে দেয়া হবে । কিন্তু মায়ের মন মানেনি। তার  চারপাশের পৃথিবী ক্রমেই ঝাপসা হতে শুরু করে। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে একটি কথাই তিনি শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘আমরা কি এভাবেই তাদের কাছে বন্ধক থাকবো ? তেত্রিশ বছরের অপেক্ষা কি  যথেষ্ট নয়?’

তবে এতো সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন নাজাত আল-আঘা। তিনি বলেছেন, ‘আমি যদি ৩৩ বছর অপেক্ষা করতে পারি, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারবো। আমার ছেলেকে কারাগারের বাইরে দেখতো পাবো।’

সূত্র : আলজাজিরা

mzamin

No comments

Powered by Blogger.