একজন রোহিঙ্গাও ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা সরকারের নেই by রুমিন ফারহানা
আচ্ছা,
মেজাজ খারাপ হলে সেটা কমানোর দ্রুততম এবং সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী? এর
একটা সুন্দর জবাব পাওয়া যায় হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত নাটক
‘বহুব্রীহি’তে। সেখানকার বিখ্যাত চরিত্র মামার (আলী যাকের) মেজাজ ভীষণ
খারাপ এবং সেটা কমানোর উপায় খুঁজছেন তিনি। মেজাজ খারাপ যখন কমছেই না, তখন
তিনি সেই নাটকেরই আরেকটি চরিত্র আনিসের (আসাদুজ্জামান নূর) কাছে যান
পরামর্শের জন্য। আনিস অতি বুদ্ধিমান মানুষ। আনিস মামাকে পরামর্শ দেন—রাগ
কমানোর সবচেয়ে কার্যকর ও সহজ উপায় হলো দুর্বল, নিরীহ কারো ওপরে রাগটা
চাপিয়ে দেওয়ার। মামা সেই পথ অবলম্বন করে তার রাগ কমাতে সফল হন।
কথাটা মনে পড়লো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটা মন্তব্য দেখে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে ব্যর্থ হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার যাবতীয় রাগ চাপিয়ে দেন রোহিঙ্গাদের ওপরে। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন—‘এখন তো তারা খুব সুখে আছে। কিন্তু সুখে খুব বেশিদিন থাকবে না।’ শুধু সেটাও না, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা অনেক দেশি-বিদেশি সংস্থার বিরুদ্ধেও তিনি বিষোদগার করেছেন, নজরদারিসহ ব্যবস্থা গ্রহণের এক ধরনের হুমকিও দিয়েছেন। অনুমান করি রোহিঙ্গা এবং ওইসব সংস্থার ওপরে রাগ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাজনিত মেজাজ খারাপ কিছুটা হলেও তার কমেছে।
এমন একটা জাতিগোষ্ঠী প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন তারা আরামে আছে যারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। কুতুপালংয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই মানুষগুলো, পাহাড় কেটে তৈরি করা এই শিবির অতিবৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে মুহূর্তেই শত শত বা হাজার হাজার মানুষ মাটিচাপা পড়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতেও আছে। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী তারা ‘আরামে আছে’। পৃথিবীর ইতিহাস বলে চূড়ান্তভাবে নিপীড়িত না হলে কেউ কখনও নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থীর জীবন বেছে নেয় না।
কতটা অমানবিক হলে, কতটা অসংবেদনশীল হলে একজন মানুষ এরকম একটা মন্তব্য করতে পারেন, সেটা ভাবতেও অবাক লাগে। অথচ এদের আশ্রয় দিয়েই খুব বাহবা কুড়ানো হয়েছিল মানবতার সেবা করার। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর অনেকে এটাকে ‘নোবেল’ পাওয়ার যোগ্য হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
একটা সুখ অবশ্য রোহিঙ্গাদের আছে—তাদের বেঁচে থাকাজনিত সুখ। হোক একেবারে মানবেতর জীবন, তবুও কোনও সেনাবাহিনী এসে নির্বিচারে তাদের মেরে ফেলবে না, গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ঝলসে দেবে না, কিংবা তাদের নারীরা গণধর্ষণের শিকার হবে না কোনও সেনাবাহিনী বা আরেক জাতিগোষ্ঠী দ্বারা। মায়ের কোল থেকে দুধের শিশুকে কেড়ে নিয়ে কেউ শূন্যে ছুড়ে উল্লাস করবে না, মায়ের চোখের সামনে সন্তান কিংবা স্ত্রীর সামনে স্বামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করবে না।
আমরা কেন এটা আশা করি বিনা শর্তে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারবে, যেখানকার দুঃসহ স্মৃতি দগদগে ঘায়ের মতো এখনও তাদের তাড়া করে ফেরে! তাদের নাগরিকত্ব পাওয়া, তাদের জমিজমা ফেরত পাওয়া, ক্ষতিপূরণ পাওয়া, নিজভূমে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া, রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন, অপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার এসব নিশ্চয়তা না পেলে কেন তারা ফেরত যাবে? আমি যদি রোহিঙ্গা হতাম তাহলে তো আমি শর্তহীনভাবে ফেরত যেতাম না। জীবনের নিশ্চয়তাটুকু থাকলে মানবেতর জীবনযাপন, অন্য কোথাও জীবনের নিশ্চয়তাহীন জীবনের চাইতে ভালো, এমনকি সে জীবন যদি হয় রাজকীয় জীবনও।
বড় মাত্রায় রোহিঙ্গা সংকট বিবেচনায় নিলে ২০১৭ সালেরটি তৃতীয় ঘটনা। এর আগে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাচক্রে দু’বারই বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। এবং দু’বারই বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পেরেছিল। অন্যান্য অনেক কূটনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই এই সাফল্য খুব জোর গলায় দাবি করতে পারে।
অথচ এবার রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে আমরা একের পর এক কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছি। রোহিঙ্গাদের ওপরে ভয়ঙ্কর নিপীড়ন চালিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা নিয়ে যখন হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে জাতিসংঘসহ সারা পৃথিবী সোচ্চার, তখন আমরা দেখলাম অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে একটা দ্বিপক্ষীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষর করলো। জাতিসংঘসহ অনেক দেশই তখন বাংলাদেশের এই চুক্তি স্বাক্ষর করা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
বলা বাহুল্য এই স্বাক্ষর করাটা, বিষয়টাকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে পরিণত করে। এতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যাপারে মিয়ানমারকে কোথাও কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলে তারা এই অ্যারেঞ্জমেন্টকেই সামনে নিয়ে এসে বলে এটা আমাদের দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়।
অবাক ব্যাপার এই সরকারই আবার যখন বাংলাদেশে কোনও শক্তিশালী দেশের মন্ত্রী বা সরকারপ্রধান সফরে আসেন তখন বাংলাদেশ থেকে প্রত্যেককে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কাজ করার অনুরোধ জানানো হয়। সেই তথাকথিত অ্যারেঞ্জমেন্ট যদি অকার্যকর প্রমাণিত হয় (এটা আসলে প্রমাণিত হয়েছে অনেক আগেই) তাহলে এই তথাকথিত অ্যারেঞ্জমেন্ট আগেই বাতিল করা হয়নি কেন?
এই পরিস্থিতিতেই আরও অবিশ্বাস্য ঘটনা আছে। গত বছর বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নতুন চুক্তি করে, তাতে সপ্তাহে ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়। সহজ পাটিগণিত বলে এই সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হলে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে সময় লাগবে ১৫ বছরের বেশি। এভাবেই একের পর এক যাচ্ছেতাই চুক্তি করার নামে বাংলাদেশ সরকার মূলত মিয়ানমার সরকারের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা শব্দটিও ব্যবহার করে না। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির এরচেয়ে বড় উদাহরণ খুব বেশি নেই।
ইতিহাস বোধসম্পন্ন এবং ভূরাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখা একজন মানুষ রোহিঙ্গা ইস্যুর জটিলতা সম্পর্কে না বোঝার কারণ নেই। রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো নানারকম স্বার্থের হিসাবে জড়িয়ে পড়েছে। মালাক্কা প্রণালী বাইপাস করার স্বার্থে বিকল্প সমুদ্রবন্দর (কিউকপিউ) তৈরি করে জ্বালানি পরিবহন, রাখাইন প্রদেশের ওপর দিয়ে চীন পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি পাইপলাইন এবং রাখাইন প্রদেশের নানা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি এসব কারণে চীনের খুব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ আছে। আবার ভারতের পূর্বের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে বিকল্প একটা পরিবহন পথের জন্য রাখাইনের সিত্তাউ বন্দর ব্যবহার করে কালাদান প্রজেক্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার যেহেতু এই দুই দেশ সেখানে জড়িয়েছে, তাই আরো অনেক দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট না করার স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অনেক রক্ষণশীলভাবে কথা বলছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কখনও ন্যায়নীতি বা মানবিকতার সঙ্গে জড়িত না, এটা একেবারেই স্বার্থের হিসাব। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো যে মিয়ানমারকে ছাড় দিচ্ছে, সেটা শুধু তাদের স্বার্থের কারণে। প্রশ্ন হলো একই দেশগুলো কেন আমাদের স্বার্থ দেখছে না? ভারত চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তো ব্যবসাসহ নানা রকম স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেটা মিয়ানমারের তুলনায় অনেক বেশিও। কিন্তু আমরা তো কাউকে পাশে পেলাম না।
আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে ব্যালট পেপারে একটি সিল পড়ার আগেই নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে তো নির্বাচনের আগের দিন রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ন্যক্কারজনকভাবে ক্ষমতায় থেকে যায়। এভাবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কারণে তাদের পেছনে যেহেতু জনগণের শক্তি নেই, তাই নৈতিকভাবে দুর্বল সরকারটি কোনও শক্তিশালী দেশের সঙ্গে দরকষাকষিতে মোটেও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে না। তাদের মনে সারাক্ষণ ভয় কাজ করে, দেশের পক্ষে জনগণের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে গিয়ে তারা গদিচ্যুত হয়ে পড়ে কিনা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় আজ এর ওপর কাল তার ওপর চাপিয়ে নানা কিছু সরকার করতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এই সরকার কিছু করতে পারবে না, এটা আমি স্পষ্টভাবেই বলতে চাই। এরকম ম্যান্ডেটহীন একটা সরকার যেকোনও আন্তরাষ্ট্রিক দরকষাকষিতে ন্যূনতম সুবিধা করতে পারবে, এরকম বিভ্রমে সরকারের অনুগত তথাকথিত কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরা ভুগলেও আমি ভুগি না।
কথাটা মনে পড়লো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটা মন্তব্য দেখে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে ব্যর্থ হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার যাবতীয় রাগ চাপিয়ে দেন রোহিঙ্গাদের ওপরে। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন—‘এখন তো তারা খুব সুখে আছে। কিন্তু সুখে খুব বেশিদিন থাকবে না।’ শুধু সেটাও না, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা অনেক দেশি-বিদেশি সংস্থার বিরুদ্ধেও তিনি বিষোদগার করেছেন, নজরদারিসহ ব্যবস্থা গ্রহণের এক ধরনের হুমকিও দিয়েছেন। অনুমান করি রোহিঙ্গা এবং ওইসব সংস্থার ওপরে রাগ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাজনিত মেজাজ খারাপ কিছুটা হলেও তার কমেছে।
এমন একটা জাতিগোষ্ঠী প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন তারা আরামে আছে যারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। কুতুপালংয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই মানুষগুলো, পাহাড় কেটে তৈরি করা এই শিবির অতিবৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে মুহূর্তেই শত শত বা হাজার হাজার মানুষ মাটিচাপা পড়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতেও আছে। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী তারা ‘আরামে আছে’। পৃথিবীর ইতিহাস বলে চূড়ান্তভাবে নিপীড়িত না হলে কেউ কখনও নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থীর জীবন বেছে নেয় না।
কতটা অমানবিক হলে, কতটা অসংবেদনশীল হলে একজন মানুষ এরকম একটা মন্তব্য করতে পারেন, সেটা ভাবতেও অবাক লাগে। অথচ এদের আশ্রয় দিয়েই খুব বাহবা কুড়ানো হয়েছিল মানবতার সেবা করার। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর অনেকে এটাকে ‘নোবেল’ পাওয়ার যোগ্য হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
একটা সুখ অবশ্য রোহিঙ্গাদের আছে—তাদের বেঁচে থাকাজনিত সুখ। হোক একেবারে মানবেতর জীবন, তবুও কোনও সেনাবাহিনী এসে নির্বিচারে তাদের মেরে ফেলবে না, গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ঝলসে দেবে না, কিংবা তাদের নারীরা গণধর্ষণের শিকার হবে না কোনও সেনাবাহিনী বা আরেক জাতিগোষ্ঠী দ্বারা। মায়ের কোল থেকে দুধের শিশুকে কেড়ে নিয়ে কেউ শূন্যে ছুড়ে উল্লাস করবে না, মায়ের চোখের সামনে সন্তান কিংবা স্ত্রীর সামনে স্বামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করবে না।
আমরা কেন এটা আশা করি বিনা শর্তে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারবে, যেখানকার দুঃসহ স্মৃতি দগদগে ঘায়ের মতো এখনও তাদের তাড়া করে ফেরে! তাদের নাগরিকত্ব পাওয়া, তাদের জমিজমা ফেরত পাওয়া, ক্ষতিপূরণ পাওয়া, নিজভূমে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া, রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন, অপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার এসব নিশ্চয়তা না পেলে কেন তারা ফেরত যাবে? আমি যদি রোহিঙ্গা হতাম তাহলে তো আমি শর্তহীনভাবে ফেরত যেতাম না। জীবনের নিশ্চয়তাটুকু থাকলে মানবেতর জীবনযাপন, অন্য কোথাও জীবনের নিশ্চয়তাহীন জীবনের চাইতে ভালো, এমনকি সে জীবন যদি হয় রাজকীয় জীবনও।
বড় মাত্রায় রোহিঙ্গা সংকট বিবেচনায় নিলে ২০১৭ সালেরটি তৃতীয় ঘটনা। এর আগে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাচক্রে দু’বারই বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। এবং দু’বারই বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পেরেছিল। অন্যান্য অনেক কূটনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই এই সাফল্য খুব জোর গলায় দাবি করতে পারে।
অথচ এবার রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে আমরা একের পর এক কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছি। রোহিঙ্গাদের ওপরে ভয়ঙ্কর নিপীড়ন চালিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা নিয়ে যখন হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে জাতিসংঘসহ সারা পৃথিবী সোচ্চার, তখন আমরা দেখলাম অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে একটা দ্বিপক্ষীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষর করলো। জাতিসংঘসহ অনেক দেশই তখন বাংলাদেশের এই চুক্তি স্বাক্ষর করা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
বলা বাহুল্য এই স্বাক্ষর করাটা, বিষয়টাকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে পরিণত করে। এতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যাপারে মিয়ানমারকে কোথাও কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলে তারা এই অ্যারেঞ্জমেন্টকেই সামনে নিয়ে এসে বলে এটা আমাদের দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়।
অবাক ব্যাপার এই সরকারই আবার যখন বাংলাদেশে কোনও শক্তিশালী দেশের মন্ত্রী বা সরকারপ্রধান সফরে আসেন তখন বাংলাদেশ থেকে প্রত্যেককে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কাজ করার অনুরোধ জানানো হয়। সেই তথাকথিত অ্যারেঞ্জমেন্ট যদি অকার্যকর প্রমাণিত হয় (এটা আসলে প্রমাণিত হয়েছে অনেক আগেই) তাহলে এই তথাকথিত অ্যারেঞ্জমেন্ট আগেই বাতিল করা হয়নি কেন?
এই পরিস্থিতিতেই আরও অবিশ্বাস্য ঘটনা আছে। গত বছর বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নতুন চুক্তি করে, তাতে সপ্তাহে ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়। সহজ পাটিগণিত বলে এই সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হলে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে সময় লাগবে ১৫ বছরের বেশি। এভাবেই একের পর এক যাচ্ছেতাই চুক্তি করার নামে বাংলাদেশ সরকার মূলত মিয়ানমার সরকারের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা শব্দটিও ব্যবহার করে না। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির এরচেয়ে বড় উদাহরণ খুব বেশি নেই।
ইতিহাস বোধসম্পন্ন এবং ভূরাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখা একজন মানুষ রোহিঙ্গা ইস্যুর জটিলতা সম্পর্কে না বোঝার কারণ নেই। রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো নানারকম স্বার্থের হিসাবে জড়িয়ে পড়েছে। মালাক্কা প্রণালী বাইপাস করার স্বার্থে বিকল্প সমুদ্রবন্দর (কিউকপিউ) তৈরি করে জ্বালানি পরিবহন, রাখাইন প্রদেশের ওপর দিয়ে চীন পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি পাইপলাইন এবং রাখাইন প্রদেশের নানা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি এসব কারণে চীনের খুব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ আছে। আবার ভারতের পূর্বের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে বিকল্প একটা পরিবহন পথের জন্য রাখাইনের সিত্তাউ বন্দর ব্যবহার করে কালাদান প্রজেক্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার যেহেতু এই দুই দেশ সেখানে জড়িয়েছে, তাই আরো অনেক দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট না করার স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অনেক রক্ষণশীলভাবে কথা বলছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কখনও ন্যায়নীতি বা মানবিকতার সঙ্গে জড়িত না, এটা একেবারেই স্বার্থের হিসাব। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো যে মিয়ানমারকে ছাড় দিচ্ছে, সেটা শুধু তাদের স্বার্থের কারণে। প্রশ্ন হলো একই দেশগুলো কেন আমাদের স্বার্থ দেখছে না? ভারত চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তো ব্যবসাসহ নানা রকম স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেটা মিয়ানমারের তুলনায় অনেক বেশিও। কিন্তু আমরা তো কাউকে পাশে পেলাম না।
আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে ব্যালট পেপারে একটি সিল পড়ার আগেই নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে তো নির্বাচনের আগের দিন রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ন্যক্কারজনকভাবে ক্ষমতায় থেকে যায়। এভাবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কারণে তাদের পেছনে যেহেতু জনগণের শক্তি নেই, তাই নৈতিকভাবে দুর্বল সরকারটি কোনও শক্তিশালী দেশের সঙ্গে দরকষাকষিতে মোটেও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে না। তাদের মনে সারাক্ষণ ভয় কাজ করে, দেশের পক্ষে জনগণের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে গিয়ে তারা গদিচ্যুত হয়ে পড়ে কিনা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় আজ এর ওপর কাল তার ওপর চাপিয়ে নানা কিছু সরকার করতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এই সরকার কিছু করতে পারবে না, এটা আমি স্পষ্টভাবেই বলতে চাই। এরকম ম্যান্ডেটহীন একটা সরকার যেকোনও আন্তরাষ্ট্রিক দরকষাকষিতে ন্যূনতম সুবিধা করতে পারবে, এরকম বিভ্রমে সরকারের অনুগত তথাকথিত কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরা ভুগলেও আমি ভুগি না।
রুমিন ফারহানা |
>>>লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য
No comments