অস্বস্তিতে ঢাকা
ভারতের
পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে ঢাকায়
অস্বস্তি বাড়ছে। দেশটির ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দল বিজেপি নেতারা এনআরসি
নিয়ে বাংলাদেশকে জড়িয়ে প্রতিনিয়ত কথাবার্তা বলছেন, যা মোটেও স্বস্তিদায়ক
নয়- অনানুষ্ঠানিক আলাপে ঢাকার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা এমনটাই বলছেন। তবে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন গতকাল গণমাধ্যমকে দেয়া তাৎক্ষণিক
প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, দিল্লির বিদেশমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর ক’দিন আগে
বাংলাদেশ সফরে তাকে আশ্বস্ত করেছে, যে এটা একান্তভাবেই ভারতের অভ্যন্তরীণ
ইস্যু। এ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। এতে বাংলাদেশ
আক্রান্ত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই বলে জয়শঙ্করকে উদ্বৃত করে বলেন মোমেন। গতকাল
ভারতীয় মিডিয়া ‘টাইমস নাও’-এর সঙ্গে আলাপে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ভারতের
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকার বৈঠকে এনআরসি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার কথা
স্বীকার করেন এবং তাকে উদ্বৃত করেন। সংবাদ মাধ্যমটির অপর এক প্রশ্নের জবাবে
মোমেন বলেন, আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার ফর সিটিজেন বা এনআরসি থেকে বাদ পড়া
ব্যক্তিরা ‘বাংলাদেশি’ বা বাংলাদেশ থেকে গেছেন বলে মনে করেন না তিনি।
সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী তার ব্যাখ্যাও দেন।
বলেন, যদি কেউ এই এলাকা থেকে গিয়ে থাকে তবে তা গেছে ১৯৭১ বা তার আরও আগে। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের আগেও অনেকে গেছে। তারা বছরের পর বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। ফলে আমি এদের ‘বাংলাদেশি’ বলে মনে করি না। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও কেউ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেতে পারে বলেও মনে করেন না তিনি। মন্ত্রী বলেন, তাদের বাংলাদেশ থেকে ভারতে (অভিবাসী হওয়ার) যাওয়ার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশেই তো তারা অনেক ভাল আছে। তাছাড়া তারা ভারতে (আসামে) যাবে কেন? সেখানে কোন আকর্ষণীয় কিছু নেই। বরং বাংলাদেশে মানুষের গড় আয় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশী। ফলে সেখানে কোন বাংলাদেশি যেতে পারে এটা আমার মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে ঢাকার বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত বিবিসি বাংলার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাবে মন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, এনআরসি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিজেপি নেতাদের বক্তব্যে বাংলাদেশেও যে উদ্বেগ বা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে সে বিষয়েই দিল্লির বিদেশমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন বিবিসি বাংলার প্রতিনিধি। কিন্তু এ নিয়ে মন্ত্রী কথা বাড়াননি। ঢাকার কর্মকর্তারা বলেন, এ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কোন কারণ নেই- দিল্লির বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেটাই কী বোঝাতে চেয়েছেন প্রকাশ্যে তা তার জবাবে স্পষ্ট হয়নি, ফলে অস্বস্তি রয়েই গেছে।
এনআরসি যে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘গলার কাঁটা’ হচ্ছে সেটি খোলাসা করে বলতে শুরু করেছেন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এখনই এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বিশেষতঃ বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিয়ে বোঝাপাড়া শেষ করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশকে অদূর ভবিষ্যতে মাশুল দিতে হবে। এনআরসি নিয়ে বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত রিপোর্ট করছে। এটি যে বড় ইস্যু হতে যাচ্ছে তার আভাস রয়েছে ওই সব রিপোর্টে। তবে এখনই যে এদের ‘বিদেশি’ বলে অন্য দেশের সীমান্তে ঠেলে দেয়ার কোন লক্ষণ নেই- সেটিও স্পষ্ট করা হয়েছে ওই সব রিপোর্টে। আসাম সরকারের বরাতে বিবিসি’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে- আসাম সরকার জানিয়েছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ লোককে এখনই ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হবে না, কিংবা গ্রেপ্তারও করা হবে না। তবে তাদের সরকারি ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনালে’ আবেদন করতে হবে ১২০ দিনের মধ্যে। ট্রাইব্যুনালের বিচারে যারা ‘বিদেশি’ সাব্যস্ত হন, তারপর তারা হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করার সূযোগ পাবেন। ফলে আইনি দীর্ঘ পথেই যে ইস্যুটির নিষ্পত্তি এবং সেটা যে পোক্ত বা শক্ত আইনি মোড়কে সামনে আসছে সেই আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো। এনআরসি নিয়ে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক আলী রিয়াজ মনে করেন- আসামে ভারত সরকারের করা এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের ভবিষ্যৎ আনুষ্ঠানিকভাবে আগামিকালই নির্ধারিত হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হওয়ার সূযোগ রাখা হয়েছে। সেখানে সুরাহা না পেলে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট। তার অর্থ হচ্ছে ভয়-ভীতি-আতঙ্কের মধ্যে তাদের আরও সময় কাটবে। ফরেনার্স ট্রাইবব্যুনালে আবেদন করার মধ্য দিয়ে ভারতে বসবাসকারী নাগরিকদের নিজেদেরই পরোক্ষভাবে স্বীকার করতে হবে তাঁরা ‘নাগরিক নন’- বিদেশি। ট্রাইব্যুনালের নামকরণের মধ্যেই একটা রাজনীতি প্রবেশ করানো হয়েছে, উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয়না। প্রায় একই ধরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল বলেও কালকের ফেসবুকে দেয়া প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত লেখায় স্মরণ করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওই বিশ্লেষক। আলী রিয়াজ লিখেন- “ভারতে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার সময়েই সীমান্ত পেরিয়ে মানুষজন বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে বলে অনুমান করা যায়। ভারতের সরকার বলবে যে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করেনি। তবে ‘পুশ ব্যাক’ করার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এই আশঙ্কা বজায় রেখে ভারত এখন বাংলাদেশের মাথার ওপরে ‘ডেমোক্লিসের তরবারি’ ঝুলিয়ে দিলো। সেই ঝুলন্ত তরবারির কারণে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে আর কী কী সুবিধা নেবে বা বাংলাদেশ সরকার কি ভূমিকা নেবে সেটাই আগামীতে দেখার বিষয়।” আসামের চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তালিকায় বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের অনিশ্চিত জীবন ভারতের কিছু রাজনীতিবিদের ‘রাজনৈতিক খেলার’ অংশ হিসেবে বলে প্রচার আছে। এ নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিতর্ক আছে। এরা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে আসামের রাজনীতিতে যে স্লোগান রয়েছে তা নিয়েও ঢাকার আপত্তি নেই। কিন্তু ওই লোকগুলোকে সত্যিই যদি সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা হয় তা দুই দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফয়েজ আহমেদ মনে করেন- বেশি উদ্বিগ্নতা দেখানোর মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তবে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তিনি বলেন, ভারত যদি মিয়ানমারের মতো তাদের লোকগুলোকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে দেশটির সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম তৌহিদ হোসেনের মতে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়ে থাকলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু শঙ্কার জায়গা তৈরি হয় যখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথা বলেন এবং বাদপড়া লোকগুলো ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কারণ আমরা চাই না অমিত শাহ ও তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এই লোকগুলো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসুক। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশ কার্ড যেন ব্যবহার করা না হয় সেজন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলের মতে, আসামে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষজনের সংখ্যা বাড়তে বা কমতে পারে। এদের অনেককে জোর করে বা মানবেতর পরিস্থিতিতে রেখে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হতে পারে। এই চাপ মাথার উপর ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশ থেকে আরো নানান একতরফা সুবিধা নেয়ার চেষ্টা হতে পারে। ভারত এমন কিছু করলে সরকারকে শক্ত থাকতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে দেশের স্বার্থ বোঝে বাংলাদেশের মানুষ। দেশের জন্য শক্ত অবস্থান নিলে দল মত নির্বিশেষে সবাই থাকবে সরকারের পক্ষে। সরকারকে তাই স্পষ্টভাবে বলতে হবে ১৯ লাখ বা ভারতের কোন অধিবাসীর দায় বাংলাদেশ নেবে না।
অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক, নাগরিকত্ব চিহ্নিতকরণের প্রস্তাব: এদিকে গত মাসে (৭ই আগস্ট) নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সপ্তম বৈঠকে ‘সীমান্তে অনুপ্রবেশ’ ইস্যুতে দুই পক্ষের মতানৈক্য স্পষ্ট হয়েছে মর্মে খবর বেরিয়েছে। দিল্লির ডেটলাইনে প্রচারিত সংবাদে বলা হয়েছে- মতানৈক্যের কারণেই ওই বৈঠকে যৌথ বিবৃতি প্রচার করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তবে ঢাকার কর্মকর্তারা এটি মানছেন না। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার দাবি যৌথ বিবৃতি সব সময় হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যে সংবাদ প্রচার হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক নয় বলে দাবি করেন সেগুনবাগিচার ওই কর্মকর্তা। তবে ওই বৈঠকে যে নানা বিষয়ে আলোচনা, বিতর্ক এবং কিছু কিছু বিষয়ে ভিন্নমত হয়েছে তা স্বীকার করেন ঢাকার প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, জাতীয় স্বার্থে সব সময় একমত হওয়া যায় না। কূটনৈতিক অঙ্গনে এখন বলাবলি আছে ‘অনুপ্রবেশ ঠেকানো’র বিষয়ে দিল্লি বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী বা ভারতের কোন লোক বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকলে বা ধরা পড়লে তাকে ফেরতে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের একটি ম্যাকানিজম বা কাঠামো চুক্তির আগ্রহ রয়েছে দিল্লির। এ নিয়ে একটি প্রস্তাবও ঢাকার বিবেচনায় পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এটি এআরসির সঙ্গে যুক্ত নয় বলে দাবি দায়িত্বশীলদের।
বলেন, যদি কেউ এই এলাকা থেকে গিয়ে থাকে তবে তা গেছে ১৯৭১ বা তার আরও আগে। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের আগেও অনেকে গেছে। তারা বছরের পর বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। ফলে আমি এদের ‘বাংলাদেশি’ বলে মনে করি না। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও কেউ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেতে পারে বলেও মনে করেন না তিনি। মন্ত্রী বলেন, তাদের বাংলাদেশ থেকে ভারতে (অভিবাসী হওয়ার) যাওয়ার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশেই তো তারা অনেক ভাল আছে। তাছাড়া তারা ভারতে (আসামে) যাবে কেন? সেখানে কোন আকর্ষণীয় কিছু নেই। বরং বাংলাদেশে মানুষের গড় আয় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশী। ফলে সেখানে কোন বাংলাদেশি যেতে পারে এটা আমার মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে ঢাকার বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত বিবিসি বাংলার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাবে মন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, এনআরসি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিজেপি নেতাদের বক্তব্যে বাংলাদেশেও যে উদ্বেগ বা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে সে বিষয়েই দিল্লির বিদেশমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন বিবিসি বাংলার প্রতিনিধি। কিন্তু এ নিয়ে মন্ত্রী কথা বাড়াননি। ঢাকার কর্মকর্তারা বলেন, এ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কোন কারণ নেই- দিল্লির বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেটাই কী বোঝাতে চেয়েছেন প্রকাশ্যে তা তার জবাবে স্পষ্ট হয়নি, ফলে অস্বস্তি রয়েই গেছে।
এনআরসি যে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘গলার কাঁটা’ হচ্ছে সেটি খোলাসা করে বলতে শুরু করেছেন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এখনই এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বিশেষতঃ বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিয়ে বোঝাপাড়া শেষ করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশকে অদূর ভবিষ্যতে মাশুল দিতে হবে। এনআরসি নিয়ে বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত রিপোর্ট করছে। এটি যে বড় ইস্যু হতে যাচ্ছে তার আভাস রয়েছে ওই সব রিপোর্টে। তবে এখনই যে এদের ‘বিদেশি’ বলে অন্য দেশের সীমান্তে ঠেলে দেয়ার কোন লক্ষণ নেই- সেটিও স্পষ্ট করা হয়েছে ওই সব রিপোর্টে। আসাম সরকারের বরাতে বিবিসি’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে- আসাম সরকার জানিয়েছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ লোককে এখনই ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হবে না, কিংবা গ্রেপ্তারও করা হবে না। তবে তাদের সরকারি ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনালে’ আবেদন করতে হবে ১২০ দিনের মধ্যে। ট্রাইব্যুনালের বিচারে যারা ‘বিদেশি’ সাব্যস্ত হন, তারপর তারা হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করার সূযোগ পাবেন। ফলে আইনি দীর্ঘ পথেই যে ইস্যুটির নিষ্পত্তি এবং সেটা যে পোক্ত বা শক্ত আইনি মোড়কে সামনে আসছে সেই আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো। এনআরসি নিয়ে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক আলী রিয়াজ মনে করেন- আসামে ভারত সরকারের করা এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের ভবিষ্যৎ আনুষ্ঠানিকভাবে আগামিকালই নির্ধারিত হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হওয়ার সূযোগ রাখা হয়েছে। সেখানে সুরাহা না পেলে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট। তার অর্থ হচ্ছে ভয়-ভীতি-আতঙ্কের মধ্যে তাদের আরও সময় কাটবে। ফরেনার্স ট্রাইবব্যুনালে আবেদন করার মধ্য দিয়ে ভারতে বসবাসকারী নাগরিকদের নিজেদেরই পরোক্ষভাবে স্বীকার করতে হবে তাঁরা ‘নাগরিক নন’- বিদেশি। ট্রাইব্যুনালের নামকরণের মধ্যেই একটা রাজনীতি প্রবেশ করানো হয়েছে, উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয়না। প্রায় একই ধরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল বলেও কালকের ফেসবুকে দেয়া প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত লেখায় স্মরণ করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওই বিশ্লেষক। আলী রিয়াজ লিখেন- “ভারতে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার সময়েই সীমান্ত পেরিয়ে মানুষজন বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে বলে অনুমান করা যায়। ভারতের সরকার বলবে যে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করেনি। তবে ‘পুশ ব্যাক’ করার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এই আশঙ্কা বজায় রেখে ভারত এখন বাংলাদেশের মাথার ওপরে ‘ডেমোক্লিসের তরবারি’ ঝুলিয়ে দিলো। সেই ঝুলন্ত তরবারির কারণে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে আর কী কী সুবিধা নেবে বা বাংলাদেশ সরকার কি ভূমিকা নেবে সেটাই আগামীতে দেখার বিষয়।” আসামের চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তালিকায় বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের অনিশ্চিত জীবন ভারতের কিছু রাজনীতিবিদের ‘রাজনৈতিক খেলার’ অংশ হিসেবে বলে প্রচার আছে। এ নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিতর্ক আছে। এরা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে আসামের রাজনীতিতে যে স্লোগান রয়েছে তা নিয়েও ঢাকার আপত্তি নেই। কিন্তু ওই লোকগুলোকে সত্যিই যদি সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা হয় তা দুই দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফয়েজ আহমেদ মনে করেন- বেশি উদ্বিগ্নতা দেখানোর মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তবে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তিনি বলেন, ভারত যদি মিয়ানমারের মতো তাদের লোকগুলোকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে দেশটির সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম তৌহিদ হোসেনের মতে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়ে থাকলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু শঙ্কার জায়গা তৈরি হয় যখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথা বলেন এবং বাদপড়া লোকগুলো ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কারণ আমরা চাই না অমিত শাহ ও তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এই লোকগুলো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসুক। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশ কার্ড যেন ব্যবহার করা না হয় সেজন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলের মতে, আসামে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষজনের সংখ্যা বাড়তে বা কমতে পারে। এদের অনেককে জোর করে বা মানবেতর পরিস্থিতিতে রেখে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হতে পারে। এই চাপ মাথার উপর ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশ থেকে আরো নানান একতরফা সুবিধা নেয়ার চেষ্টা হতে পারে। ভারত এমন কিছু করলে সরকারকে শক্ত থাকতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে দেশের স্বার্থ বোঝে বাংলাদেশের মানুষ। দেশের জন্য শক্ত অবস্থান নিলে দল মত নির্বিশেষে সবাই থাকবে সরকারের পক্ষে। সরকারকে তাই স্পষ্টভাবে বলতে হবে ১৯ লাখ বা ভারতের কোন অধিবাসীর দায় বাংলাদেশ নেবে না।
অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক, নাগরিকত্ব চিহ্নিতকরণের প্রস্তাব: এদিকে গত মাসে (৭ই আগস্ট) নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সপ্তম বৈঠকে ‘সীমান্তে অনুপ্রবেশ’ ইস্যুতে দুই পক্ষের মতানৈক্য স্পষ্ট হয়েছে মর্মে খবর বেরিয়েছে। দিল্লির ডেটলাইনে প্রচারিত সংবাদে বলা হয়েছে- মতানৈক্যের কারণেই ওই বৈঠকে যৌথ বিবৃতি প্রচার করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তবে ঢাকার কর্মকর্তারা এটি মানছেন না। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার দাবি যৌথ বিবৃতি সব সময় হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যে সংবাদ প্রচার হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক নয় বলে দাবি করেন সেগুনবাগিচার ওই কর্মকর্তা। তবে ওই বৈঠকে যে নানা বিষয়ে আলোচনা, বিতর্ক এবং কিছু কিছু বিষয়ে ভিন্নমত হয়েছে তা স্বীকার করেন ঢাকার প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, জাতীয় স্বার্থে সব সময় একমত হওয়া যায় না। কূটনৈতিক অঙ্গনে এখন বলাবলি আছে ‘অনুপ্রবেশ ঠেকানো’র বিষয়ে দিল্লি বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী বা ভারতের কোন লোক বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকলে বা ধরা পড়লে তাকে ফেরতে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের একটি ম্যাকানিজম বা কাঠামো চুক্তির আগ্রহ রয়েছে দিল্লির। এ নিয়ে একটি প্রস্তাবও ঢাকার বিবেচনায় পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এটি এআরসির সঙ্গে যুক্ত নয় বলে দাবি দায়িত্বশীলদের।
No comments