ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে সৌদি আরব

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রতিদিনই দেশ-বিদেশে খবর হচ্ছেন। মূলত এ খবরগুলো অব্যবস্থা ও বিদ্বেষের। কার্যত তিনি এখনো সরকার গঠন-প্রক্রিয়াই শেষ করতে পারেননি। নিয়োগ দেওয়া হয়নি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে। তবে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া সূচনাতেই সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন তিনি। আদালতের নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর করা যায়নি। তবে দ্বার বন্ধ হয় শরণার্থীদের জন্য। তদুপরি এক কোটির অধিক অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়নের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। ভুলে গেছেন তাঁর পিতামহ জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন। তাঁর বর্তমান স্ত্রী একজন স্লোভেনিয়ান অভিবাসী। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটি বিভাজনমূলক অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছেন তিনি। তবে এ অবস্থা মেনে নিচ্ছে না সে দেশের প্রগতিশীল সমাজ। গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থাসহ অনেকেরই নিয়ত কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ধরনের একজন প্রেসিডেন্টের অমানবিক আচরণের সক্রিয় বিরোধিতা করা। তারা সভা-সমিতি করে বা বিবৃতি দিয়েই শেষ করছে না দায়িত্ব। পাশাপাশি আদালতে চালাচ্ছে আইনি লড়াই। পশ্চিম ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালের মিত্র। তারাও ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব নীতির সঙ্গে একমত নয়, এমনটা অনেকে প্রকাশ্যেই জানাচ্ছে। মেক্সিকো সীমান্তে দুর্ভেদ্য দেয়াল নির্মাণের হুমকি দিয়ে চলেছেন ট্রাম্প।
কিন্তু নেই কোনো নকশা, প্রাক্কলন বা এর প্রয়োজনীয় অর্থের মঞ্জুরি। কার্যত তিনি গুটিকয় দেশ বাদে সারা বিশ্বে শান্তিবাদী মানুষের কাছে অনেকটা আতঙ্কের ব্যক্তি হিসেবেই নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সফল হয়েছেন। এখনো বাকি রয়েছে দীর্ঘ পথচলা। এরই মধ্যে ইসরায়েলের মতো দু-একটি দেশ তাঁর সমর্থনেও নেমেছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের মতো মুসলিম দেশও কিন্তু সম্প্রতি ট্রাম্পের এসব নীতিকে সমর্থন জানায় প্রকাশ্যে। সৌদি সরকারের এ আচরণে আমরা বেদনাহত হলেও বিস্মিত নই। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সৌদি রাজপরিবার কোনো কোনো প্রতিবেশীর রোষানলে আছে। তারা নিরাপত্তাহীন বলে নিজেদের মনে করে। কিন্তু জনগণের কাছে নিজেদের অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টা নিচ্ছে না। মেটাবে না ইরানসহ কতিপয় দেশের সঙ্গে বিবাদও। এ অবস্থায় তারা টিকে থাকতে মার্কিন সমরশক্তির ওপর নির্ভর করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সৌদি আরব মুসলিম উম্মাহর নেতা হিসেবে পরিচিত। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজের (ওআইসি) ওপর রয়েছে তাদের ব্যাপক প্রভাব। অফুরন্ত তেলভান্ডারের জন্য প্রাচুর্য তো আছেই। আমাদের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও রয়েছে অনেকটা গভীরেই। মুসলিম বিশ্বের দুটি পবিত্র স্থান সে দেশে। এসব স্থানে আমাদের দেশ থেকে বহু মুসলমান হজ ও ওমরাহ করতে যান। ব্যবস্থাপনা মোটামুটি ভালো। তবে মাঝেমধ্যে চরম খামখেয়ালির জন্য প্রাণ হারান অনেকেই। বছর দুই আগে এরূপ একটি বিয়োগান্ত ঘটনার শিকার কারও কারও পরিবার এখন পর্যন্ত মৃত্যুসনদও পায়নি। ফলে কঠিন সংকটে আছে তারা। অন্যদিকে আমাদের প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি সে দেশে নিয়োজিত। আমরা তাঁদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছি। অন্যদিকে সে মানুষগুলো তাঁদের জীবন-যৌবন নিঃশেষ করছেন সৌদি জনগণের সেবায় ও তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে। এমন অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত নীতির প্রতি তাদের প্রকাশ্য সমর্থন আমাদের বেদনাহত করেছে। ইরান তো বিরোধিতা করেই চলেছে। তাদের কী করবে যুক্তরাষ্ট্র! একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিমবিদ্বেষের মূলে রয়েছে এ সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের সন্ত্রাসী তৎপরতা। মূলধারার সঙ্গে তারা সম্পর্কহীন। বিধ্বংসী ভূমিকা নিয়ে নিজেরা নিঃশেষিত হচ্ছে।
বিশ্বসমাজে খাটো করছে নিজ সম্প্রদায়কে। তবে বিবেকসম্পন্ন মানুষ কখনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজের দায় গোটা সমাজের দিকে ঠেলে দেয় না। সম্প্রতি ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই সন্ত্রাসীরা প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। হামলাকারী ও তাদের দোসর ব্যতীত অন্যদের দায়ী করেনি সেসব দেশ। ঠিক তেমনই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মতো মহাবিপর্যয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলমান এবং অভিবাসীরা নিরাপদ ছিলেন। এভাবে বিভেদের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি। আর সেই নাইন-ইলেভেনের মূল হোতা তো সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেন। এমনকি সেই আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেওয়া লোকগুলোও ছিল সৌদি আরবের। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় প্রথম সে দেশের নাগরিকদেরই আসার কথা, তা আসেনি। আসুক, এমনটাও আমরা চাই না। সে ক্ষেত্রে অন্য মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের যে নিষেধাজ্ঞা, তা সৌদি আরব সমর্থন করে কোন যুক্তিতে? নৈতিক দিক দিয়ে তো তাদের অবস্থানই দুর্বল। আর ওআইসি নামের সংগঠনটি একটা কাগুজে বিবৃতিও দিতে পারত, তা-ও আসেনি। সৌদির লোকেরা যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন—সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থাকলেও উভয় দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ভালোই থাকছে। এ অঞ্চলকে ঘিরে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি তেলের দাম ও উত্তোলন স্থিতিশীল রাখা এবং পারস্য উপসাগর হয়ে তেলের পরিবহন নির্বিঘ্ন করে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক স্বার্থ সমুন্নত রাখতে তাদের সৌদি আরবকে দরকার। বেশুমার সমরাস্ত্র বিক্রির বাজার হিসেবেও দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব বহন করে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে সৌদি আরবের টাকায়। এমনকি সে দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌদিদের অবস্থান তৃতীয় স্থানে। এ ধরনের প্রয়োজনীয়তা দুটো দেশকে কাছে টানলেও জরিপে দেখা গেছে, জনগণের ভাবনার জগৎ ভিন্ন। জরিপ অনেক হয়েছে। কোনো জরিপই নিরঙ্কুশ সঠিক তথ্য দিতে পারে না। তবু একটা ধারণা নেওয়া যায়। সৌদি আরবের জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে সরাসরি প্রতিকূল মনোভাব পোষণ করে শতকরা ৫১ ভাগ, এমনটি দেখা গেছে বিবিসির একটি জরিপে। ঠিক তেমনি ৫৭ শতাংশ মার্কিনি স্পষ্ট প্রতিকূল অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরবের। এত কিছু সত্ত্বেও একটি গণতান্ত্রিক, উদার, বহুত্ববাদী সমাজ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে একটি কর্তৃত্বপরায়ণ, পশ্চাৎমনা ও জনবিচ্ছিন্ন সৌদি সরকারকে। তেমনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট যখন তাঁর দেশের চেতনা ও জনমতের পরিপন্থী মুসলমান এবং অভিবাসীবিরোধী একটি সুস্পষ্ট অবস্থান নিলেন, তখন তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসে সৌদি আরব।
এমনকি ইরান ব্যতীত কোনো মুসলিম দেশ এর প্রতিবাদ করল না। অভিবাসী নিয়ে মাথাব্যথা যত ইউরোপ ও কানাডার। এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলো কার্যত তামাশা দেখছে। এই কি রাজনীতি? যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে সময়ে-সময়ে বিভাজনের চিহ্ন লক্ষণীয় হয়েছে। কোনো কোনো সরকার জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধেও গেছে। তখনই রুখে দাঁড়িয়েছে সে দেশের সমৃদ্ধ সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম। দেশটির মূল অধিবাসী ছিল রেড ইন্ডিয়ানরা। তারা আজ অনেকটা জাদুঘরের দর্শনীয় বস্তুর মতোই আছে। যা-ই হোক, তখনকার দারিদ্র্যপীড়িত ইউরোপই প্রথম আমেরিকাবাসী হয়। এ বিশাল ভূখণ্ড অধিকারে নিয়ে চাষাবাদ ও কলকারখানা চালানোর জন্য দরকার হয় লাখ লাখ শ্রমিক। অমানবিকভাবে ধরে আনা হয় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের। তাদের রাখে ক্রীতদাসের মর্যাদায়। এ ব্যবস্থাটিও যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী বলে শ্বেতাঙ্গদের একটি অংশই আন্দোলনে নামে। নেতৃত্ব দেন স্বয়ং দেশের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। দাসপ্রথা বিলোপের আইনি বিধান করলেও দক্ষিণের রাজ্যগুলো তা না মানায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধে জয়ী হন লিংকন আর মানবসভ্যতা। অল্প পরে তিনি প্রাণ হারালেও রেখে যান অমর কীর্তি। সে দাসপ্রথার উচ্ছেদ হলেও কৃষ্ণাঙ্গরা সমানাধিকার ফিরে পেয়েছে অনেক পরে।
এই মার্কিন সমাজ সর্বজনীন। রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার দুটো পঙ্ক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক:
‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।’
অভিবাসীরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণ। গড়ে তুলেছে দেশটিকে। করেছে ‘গ্রেট’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে দেশকে আরও গ্রেট করতে পারেন। তবে তাদের বাদ দিয়ে নয়, তা কখনো হবেও না। মার্কিন সমাজ হতে দেবে না। আর সৌদি আরবের মতো সমর্থন দেওয়া রাষ্ট্র ট্রাম্প আরও কিছু জোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু যাদের দেশ—যা কিছু করার, করবে তারাই। সৌদি আরব এমনটা করে নিজেদের খাটো করল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যা করতে চাইছেন, এমনটা কখনো হবে না। মার্কিন সমাজ তা হতে দেবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.