সালাউদ্দিন কাদের মুজাহিদের শেষ প্রহর
কনডেম
সেলের পাশাপাশি কক্ষেই রাখা হয়েছিলো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান
মোহাম্মদ মুজাহিদকে। শনিবার রাত ৮টার পর জানানো হয় ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের
বিষয়টি। এর আগেই দুই পরিবারের সদস্যদের আসতে বলা হয় শেষ সাক্ষাতের জন্য।
ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের আগেই তাদের রাতের খাবার দেয়া হয়েছিল। অল্প কিছু
খাবার দু’জন খেয়েছিলেন। রাতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন এক
আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ফাঁসির মঞ্চে যাবার আগে অনেকটা
ধির-স্থির ছিলেন সালাহউদ্দিন ও মুজাহিদ। নির্বিকারভাবে হেঁটে যান মঞ্চে।
বাধা সৃষ্টি করেননি। জোরে জোরে পড়ছিলেন দোয়া। জেল কর্তৃপক্ষ ও ফাঁসির মঞ্চে
উপস্থিত থাকা কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জেল সূত্র জানায়, শনিবার বিকালের দিকেই দুজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দুই চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কুমার ও ডা. আহসান হাবিব তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। এসময় স্বাভাবিক ছিলেন তারা। চিকিৎসকদের সঙ্গে তারা কথাও বলেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। রাত সাড়ে ৭টার দিকে তাদের খাবার দেয়া হয়। খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল। খাবারের কিছু অংশ দুজনই খেয়েছেন। রাত ৮টার পর তাদের জানানো হয় রাতের মধ্যেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এরপরই খবর দেয়া হয় দুজনের পরিবারের সদস্যদের। রাতে প্রথমে সালাহউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা কারা অভ্যন্তরে ঢোকেন। এসময় সেখানে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরিবারের সদস্যরা অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মনোবল শক্ত রেখে পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেককেই নানারকম নির্দেশনা দিয়ে যান সালাউদ্দিন। বলেন, আল্লাহ ছাড়া আমি কারও কাছে মাথা নত করিনি। তোমরাও করো না। পরিবারের সদস্যরা বেরিয়ে গেলে ভেতরে প্রবেশ করেন মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা। আবারও একই রকম দৃশ্যের অবতারণা হয় সেখানে। মুজাহিদও সবাইকে ধৈর্য ধরার কথা বলেন। নির্দেশনা দেন পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করতে পরিবারকে নির্দেশনা দেন মুজাহিদও। এ সময় অনেকটা অবিচল ছিলেন তিনি।
কারা সূত্র জানায়, রাত ১২টার দিকে কারা মসজিদের ইমাম দু’জনকে তওবা পড়াতে যান। অজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন দুজনই। দুজনের হাতেই ছিল তসবিহ। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে জল্লাদ শাজাহান ও রাজুর নেতৃত্বে চার জন করে জল্লাদ ঢোকেন পৃথক দুই সেলে। তারা দু’জনেরই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন। পরান যমটুপি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ সময় বলেন, আমি শেষ বিচারের আশায় থাকবো। তোমরাও সেদিন সাক্ষী হবে। আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ সবই জানেন। এসময়ও তিনি আল্লাহু আকবর বলে শব্দ করেন। পরে দোয়া পড়তে পড়তে যমটুপি পরেন তিনি। যমটুপি পড়ানোর পর দুজনকেই হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চের দিকে। এদিকে একই মঞ্চে পাশাপাশি দুটি কপিকল সেট করে দুটি ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত রাখা হয় আগে থেকেই। পুরো মঞ্চ এলাকা ঘেরাও করে রাখা হয় সামিয়ানা দিয়ে। আগেই জ্বালিয়ে রাখা হয় উজ্জ্বল আলো। দুজনকে ফাঁসির মঞ্চে হাঁটিয়ে নেয়ার সময় কোন বাধা সৃষ্টি করেননি তারা। দুই জল্লাদ দুদিক থেকে দুই বাহু ধরে ও পেছন থেকে দুজন ঠেলে নিয়ে যান মঞ্চে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তোলা হয় মঞ্চে। গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে লিভারের হাতল ধরে দাঁড়ান জল্লাদ শাজাহান। এদিকে রুমাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। ১২টা ৫৫ মিনিটে রুমাল হাত থেকে পড়তেই লিভার টেনে দেন জল্লাদ। মঞ্চের আশেপাশে তখন পিনপতন নীরবতা। মঞ্চের নিচের পাটাতন সরে যেতেই দুজনের শরীর নিচে নেমে যায় কুয়ায়। সিভিল সার্জন আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে চিকিৎসকরা মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর পরবর্তী কার্যক্রম সাড়া হয় দ্রুতগতিতে।
কারা মসজিদের ইমাম হাফেজ মনির হোসেন খান জানান, তিনি তওবা পড়াতে গিয়ে দেখেন মুজাহিদ কোরআন তেলাওয়াত করছেন। জানতে চাইলে জেলার নেসার আলম মুকুল বলেন, নিয়মানুসারেই দণ্ডিতদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের পুরো ঘটনার সময় ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন, ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার মুশফিকুর রহমান ও তানভীর আহমেদ, সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেছার আলম মুকুল, পুলিশ কর্মকর্তা শেখ নাজমুল আলম উপস্থিত ছিলেন। আইজি প্রিজন চৌধুরী ইফতেখার উদ্দিন নিজের বাসায় বসে পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিসি), উপ-কমিশনার (ডিবি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় দুজনই কোন বাধা সৃষ্টি করেননি। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে তারা মঞ্চে ওঠেন। একই মঞ্চে একসঙ্গে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এদিকে আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরায় কঠোর পুলিশি প্রহরায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর পুলিশ কঠোর নিরাপত্তায় ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে রাউজানের উদ্দেশে রওনা হয়। রোববার সকাল পৌনে নয়টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লাশ তার গ্রামের বাড়ি রাউজানের গহিরায় বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এর আগে সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে আসেন। ৯টা ২২ মিনিটে বক্স আলী চৌধুরী বাড়ি জামে মসজিদের উত্তর পাশে পুকুরের পশ্চিম পাশে খালি জায়গাতে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমীর ফটিকছড়ি বাবুনগর মাদরাসার প্রিন্সিপাল শায়খুল উলামা হযরত বাবুনগরী। নামাজে জানাজায় ১১ কাতার মানুষ অংশ নেয়। একেকটি কাতারে ৫০ জনেরও বেশি দাঁড়াতে দেখা যায়। জানাজা শেষে রীতি অনুযায়ী নামাজে জানাজায় জিজ্ঞাসা করা হলে এই লোকটি কেমন ছিলেন সকলে এক বাক্যে বলে ওঠেন উনি খুব ভালো লোক ছিলেন। এরকম ৩ বার উচ্চারণ করা হয়। এরপর খাটিয়া করে লাশ পারিবারিক কবরস্থানে নেয়া হয়। তারপর ৯টা ২৮ মিনিটে যখন সালাউদ্দিন কাদেরের মরদেহ খাটিয়া থেকে নামিয়ে কবরে শোয়ানো হয় তখন স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা অঝোরে কান্নাকাটি করেন। ৯টা ৩৩ মিনিটে কবরের পাশে মাত্র ২৭ মিনিটের মধ্যে দাফনের কাজ সমাপ্ত হয়। গত কয়েক মাস আগে মারা যাওয়া ছোটভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবরের পশ্চিম পাশে তাকে দাফন করা হয়। ৯টা ৫৫ মিনিটে দাফন শেষে কবর পাশে মরহুমের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এর আগে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কয়েকশত সাংবাদিককে কবরে সমাহিত করার চিত্র যাতে ধারণ করতে না পারে সে জন্য পুলিশ সাংবাদিকদের অবরুদ্ধ করে রাখে।
স্বজনরা জানান, অ্যাম্বুলেন্সে করে সালাহউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে আসার পর পরিবারের সদস্যরা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গোসল করাতে চাইলে তাতে বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গোসল দিতে ব্যর্থ হন স্বজনরা।
নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা-রাউজান
এদিকে লাশ দাফন ও জানাজাকে কেন্দ্র করে শনিবার রাতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি গহিরা সহ রাউজানের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন ছিল। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সোমবার পর্যন্ত থাকবে বলে রাউজান পুলিশ সূত্রে জানা যায়। আশেপাশের এলাকায় শনিবার রাত থেকে ১০ প্লাটুন পুলিশ ও দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। রোববার সকালে আরও ১০ প্লাটুন পুলিশ ও দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে থানার পুলিশ সূত্রে জানা যায়।
জানাজায় অংশগ্রহণে বাধা: আওয়ামী লীগের সমর্থকরা গহিরার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ির রাস্তার অভিমুখে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিএনপির সমর্থক ও সাধারণ জনগণকে জানাজায় অংশ নিতে বাধা প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন রাউজান পৌর মেয়র আবদুল্লাহ আল হাছান।
আমাদের ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, ফাঁসির রায় কার্যকরের পর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুরে মুজাহিদের নিজ বাড়ির অদূরে তার গড়া একটি মাদরাসা প্রাঙ্গণে দাফন করা হয় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুজাহিদের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ফরিদপুর শহরে তার নিজ বাড়িতে পৌঁছে। সেখানে প্রশাসনের কাছ থেকে লাশ গ্রহণ করেন মুজাহিদের ছোট ছেলে আলী আহসান মাহবুব। এরপর পৌনে ৭টায় লাশের জানাজা শেষে সোয়া ৭টায় মুজাহিদের বাড়ির পশ্চিম পাশে তার প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডার গার্টেন মাদরাসা প্রাঙ্গণে তার লাশ দাফন করা হয়।
জানাজা পরিচালনা করেন বড় ভাই আলী আহসান মো. খালেজ। এসময় মুজাহিদের ছেলে আলী আহম্মেদ তাজদিদ, জেলা জামায়াতে নায়েবে আমীর আব্দুর তাওয়াব, এ অঞ্চলের জামায়াতের আমীর দেলোয়ার হোসেন, জেলা জামায়াত সেক্রেটারিসহ তার পরিবারের সদস্যসহ আশেপাশের লোকজন মুজাহিদের জানাজায় অংশ নেন।
মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে জেনে তার বাড়ির সামনে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে শত শত মানুষ অবস্থান নেয়। রাতভর তারা প্রতীক্ষায় থাকেন কখন লাশ আসবে। লাশ আসার পর সকাল পৌনে সাতটায় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বহিরাগত কাউকেই জানাজা ও দাফন কাজে যেতে দেয়নি। শুধুমাত্র মুজাহিদের পরিবারের সদস্য, জেলা জামায়াতের নেতাকর্মীরা ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। এদিকে মুজাহিদের লাশ দাফন শেষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পশ্চিম খাবাসপুরে দাঁড়িয়ে থাকা জামায়াত কর্মীরা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিলে পুলিশ তাদেরকে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় পুলিশ দুই জামায়াত কর্মীকে আটক করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। মুজাহিদের ভাই ফরিদপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর আলী আহসান মো. খালেজ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ সাজানো মামলায় সাজানো সাক্ষীতে আমার ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমার ভাই একজন সৎ মানুষ। মুজাহিদের ছেলে আলী আহসান মাহবুব বলেছেন, আমার পিতাকে ষড়যন্ত্র ভাবে মামলায় জড়িয়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। সরকার আমার পিতাকে তার দল, পরিবার সর্বোপরি সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। জেলা জামায়াতে আমীর আব্দুল তাওয়াব ও জেলা সেক্রেটারি বদরউদ্দীন বলেন, আমরা আগামীকাল সোমবার হরতালে ডাক দিয়েছি।
‘প্রাণভিক্ষা কোন মানুষের কাছে নয়’
গতকাল সকালে চট্টগ্রামের রাউজানে দাফনের পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন তার বড় ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, আব্বা বলেছেন, প্রাণভিক্ষা বা ক্ষমা চাইলে আল্লাহর কাছে চাইবো, কোন মানুষের কাছে নয়। শেষ দেখায় প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ওই কথা বলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ফাঁসি কার্যকরের আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি আরও বলেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে হুম্মাম বলেন, বলা হচ্ছে- বাবা প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। তাকে মানুষ বাংলার বাঘ হিসেবে চিনে। তিনি কখনও প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। আমি যখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম বাবা বলেছেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করতে পারে না। ১০ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অবৈধ রায়ে বাবাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তবু আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি। দেশে এখন এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেখানে অনেক খুন-গুম হচ্ছে। অনেকে আপনজনের মরদেহ খুঁজে পাচ্ছে না। আমরা ভাগ্যবান যে সম্মানের সঙ্গে বাবাকে দাফন করতে পেরেছি। তিনি বলেন, একজন বেকসুর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের মানুষ অবশ্যই একদিন ন্যায়বিচারের ডাক দিবে। হুম্মাম বলেন, তিনি চট্টগ্রামের সিংহপুরুষ। ইংরেজিতে ‘লিগেসি’ বলে যা আছে তা টিকে থাকবে। এ হত্যার বিচার একদিন না একদিন হবে। চট্টগ্রামের মানুষ এ রায় কোনদিন মেনে নেবে না। সংবাদ সম্মেলনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেছেন- আমি যদি মার্সি (ক্ষমা) চাই, তবে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে চাইবো, কোন বান্দার কাছে নয়। সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রহমান চৌধুরীসহ তাদের আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। ওদিকে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শেষ দেখায় স্ত্রী তামান্না-ই জাহানকে ধৈর্য ধরতে এবং শান্ত থাকতে বলেছেন। শনিবার মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে স্বজনদের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে স্ত্রীকে এমন পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তার পুত্র আলী আহমেদ মাবরুর। গতকাল মানবজমিনকে মাবরুর বলেন, বিদায় বেলায় আব্বাকে একেবারেই শান্ত ও স্বাভাবিক দেখা গেছে। তবে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে তিনি বেশ রিএ্যাক্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবনের শেষ দিনও সরকার আমাকে নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার করেছে। এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে। মুজাহিদ স্বজনদের বলেছেন, আমি কোন অপরাধ করিনি। সরকার আমার কোন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তবু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছি সাক্ষ্যপ্রমাণবিহীন এমন ঢালাও অভিযোগ দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যে রকম অপরাধের কোন প্রমাণ নেই সে অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবো কেন। মুজাহিদ বলেছেন, প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি প্রচার করে সরকার আমাকে কাপুরুষ হিসেবে দেশ ও জাতি এমনকি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যারা আমাকে চিনে, আমার নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে অবগত তারা কখনও এসব বিশ্বাস করবে না। মাবরুর বলেন, আব্বা বলেছেন, ক্ষমাপ্রার্থনার নাটক করে সরকার দেশবাসী বিশেষ করে আমার দলের লোকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। হাশরের ময়দানে দেখা হবে- স্ত্রীকে এমন সান্ত্বনা দিয়ে বিদায়ের শেষ মুহূর্তে মুজাহিদ বলেছেন, সংসার জীবনে তোমার মতো ভাল স্ত্রী পেয়ে স্রষ্টার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রতি উত্তরে মুজাহিদ স্ত্রী তামান্না-ই জাহান স্বামীকে একজন ভাল এবং নির্দোষ মানুষ হিসেবে প্রশংসা করেন।
এদিকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ শনিবার মধ্যরাতে দেয়া বিবৃতিতে বলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মুজাহিদের সঙ্গে যে তামাশা করা হয়েছে এবং মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন বলে যে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে তাতে দেশবাসী ক্ষুব্ধ। মুজাহিদের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা শেষ সাক্ষাৎ করে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে দোষ স্বীকার করেননি, ক্ষমা প্রার্থনা করেননি এবং প্রাণভিক্ষাও চাননি। তিনি বলেন, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে যে দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলাদেশের জনগণ কখনও ভুলবে না। তিনি ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে জনগণের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। বর্তমান স্বৈরাচারী জালেম সরকার এরকম একজন সৎ, আল্লাহভীরু ও যোগ্য জাতীয় নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করায় জাতি গভীরভাবে শোকাহত ও ক্ষুব্ধ।
জেল সূত্র জানায়, শনিবার বিকালের দিকেই দুজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দুই চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কুমার ও ডা. আহসান হাবিব তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। এসময় স্বাভাবিক ছিলেন তারা। চিকিৎসকদের সঙ্গে তারা কথাও বলেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। রাত সাড়ে ৭টার দিকে তাদের খাবার দেয়া হয়। খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল। খাবারের কিছু অংশ দুজনই খেয়েছেন। রাত ৮টার পর তাদের জানানো হয় রাতের মধ্যেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এরপরই খবর দেয়া হয় দুজনের পরিবারের সদস্যদের। রাতে প্রথমে সালাহউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা কারা অভ্যন্তরে ঢোকেন। এসময় সেখানে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরিবারের সদস্যরা অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মনোবল শক্ত রেখে পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেককেই নানারকম নির্দেশনা দিয়ে যান সালাউদ্দিন। বলেন, আল্লাহ ছাড়া আমি কারও কাছে মাথা নত করিনি। তোমরাও করো না। পরিবারের সদস্যরা বেরিয়ে গেলে ভেতরে প্রবেশ করেন মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা। আবারও একই রকম দৃশ্যের অবতারণা হয় সেখানে। মুজাহিদও সবাইকে ধৈর্য ধরার কথা বলেন। নির্দেশনা দেন পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করতে পরিবারকে নির্দেশনা দেন মুজাহিদও। এ সময় অনেকটা অবিচল ছিলেন তিনি।
কারা সূত্র জানায়, রাত ১২টার দিকে কারা মসজিদের ইমাম দু’জনকে তওবা পড়াতে যান। অজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন দুজনই। দুজনের হাতেই ছিল তসবিহ। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে জল্লাদ শাজাহান ও রাজুর নেতৃত্বে চার জন করে জল্লাদ ঢোকেন পৃথক দুই সেলে। তারা দু’জনেরই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন। পরান যমটুপি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ সময় বলেন, আমি শেষ বিচারের আশায় থাকবো। তোমরাও সেদিন সাক্ষী হবে। আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ সবই জানেন। এসময়ও তিনি আল্লাহু আকবর বলে শব্দ করেন। পরে দোয়া পড়তে পড়তে যমটুপি পরেন তিনি। যমটুপি পড়ানোর পর দুজনকেই হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চের দিকে। এদিকে একই মঞ্চে পাশাপাশি দুটি কপিকল সেট করে দুটি ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত রাখা হয় আগে থেকেই। পুরো মঞ্চ এলাকা ঘেরাও করে রাখা হয় সামিয়ানা দিয়ে। আগেই জ্বালিয়ে রাখা হয় উজ্জ্বল আলো। দুজনকে ফাঁসির মঞ্চে হাঁটিয়ে নেয়ার সময় কোন বাধা সৃষ্টি করেননি তারা। দুই জল্লাদ দুদিক থেকে দুই বাহু ধরে ও পেছন থেকে দুজন ঠেলে নিয়ে যান মঞ্চে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তোলা হয় মঞ্চে। গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে লিভারের হাতল ধরে দাঁড়ান জল্লাদ শাজাহান। এদিকে রুমাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। ১২টা ৫৫ মিনিটে রুমাল হাত থেকে পড়তেই লিভার টেনে দেন জল্লাদ। মঞ্চের আশেপাশে তখন পিনপতন নীরবতা। মঞ্চের নিচের পাটাতন সরে যেতেই দুজনের শরীর নিচে নেমে যায় কুয়ায়। সিভিল সার্জন আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে চিকিৎসকরা মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর পরবর্তী কার্যক্রম সাড়া হয় দ্রুতগতিতে।
কারা মসজিদের ইমাম হাফেজ মনির হোসেন খান জানান, তিনি তওবা পড়াতে গিয়ে দেখেন মুজাহিদ কোরআন তেলাওয়াত করছেন। জানতে চাইলে জেলার নেসার আলম মুকুল বলেন, নিয়মানুসারেই দণ্ডিতদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের পুরো ঘটনার সময় ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন, ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার মুশফিকুর রহমান ও তানভীর আহমেদ, সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেছার আলম মুকুল, পুলিশ কর্মকর্তা শেখ নাজমুল আলম উপস্থিত ছিলেন। আইজি প্রিজন চৌধুরী ইফতেখার উদ্দিন নিজের বাসায় বসে পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিসি), উপ-কমিশনার (ডিবি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় দুজনই কোন বাধা সৃষ্টি করেননি। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে তারা মঞ্চে ওঠেন। একই মঞ্চে একসঙ্গে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এদিকে আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরায় কঠোর পুলিশি প্রহরায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর পুলিশ কঠোর নিরাপত্তায় ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে রাউজানের উদ্দেশে রওনা হয়। রোববার সকাল পৌনে নয়টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লাশ তার গ্রামের বাড়ি রাউজানের গহিরায় বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এর আগে সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে আসেন। ৯টা ২২ মিনিটে বক্স আলী চৌধুরী বাড়ি জামে মসজিদের উত্তর পাশে পুকুরের পশ্চিম পাশে খালি জায়গাতে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমীর ফটিকছড়ি বাবুনগর মাদরাসার প্রিন্সিপাল শায়খুল উলামা হযরত বাবুনগরী। নামাজে জানাজায় ১১ কাতার মানুষ অংশ নেয়। একেকটি কাতারে ৫০ জনেরও বেশি দাঁড়াতে দেখা যায়। জানাজা শেষে রীতি অনুযায়ী নামাজে জানাজায় জিজ্ঞাসা করা হলে এই লোকটি কেমন ছিলেন সকলে এক বাক্যে বলে ওঠেন উনি খুব ভালো লোক ছিলেন। এরকম ৩ বার উচ্চারণ করা হয়। এরপর খাটিয়া করে লাশ পারিবারিক কবরস্থানে নেয়া হয়। তারপর ৯টা ২৮ মিনিটে যখন সালাউদ্দিন কাদেরের মরদেহ খাটিয়া থেকে নামিয়ে কবরে শোয়ানো হয় তখন স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা অঝোরে কান্নাকাটি করেন। ৯টা ৩৩ মিনিটে কবরের পাশে মাত্র ২৭ মিনিটের মধ্যে দাফনের কাজ সমাপ্ত হয়। গত কয়েক মাস আগে মারা যাওয়া ছোটভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবরের পশ্চিম পাশে তাকে দাফন করা হয়। ৯টা ৫৫ মিনিটে দাফন শেষে কবর পাশে মরহুমের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এর আগে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কয়েকশত সাংবাদিককে কবরে সমাহিত করার চিত্র যাতে ধারণ করতে না পারে সে জন্য পুলিশ সাংবাদিকদের অবরুদ্ধ করে রাখে।
স্বজনরা জানান, অ্যাম্বুলেন্সে করে সালাহউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে আসার পর পরিবারের সদস্যরা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গোসল করাতে চাইলে তাতে বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গোসল দিতে ব্যর্থ হন স্বজনরা।
নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা-রাউজান
এদিকে লাশ দাফন ও জানাজাকে কেন্দ্র করে শনিবার রাতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি গহিরা সহ রাউজানের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন ছিল। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সোমবার পর্যন্ত থাকবে বলে রাউজান পুলিশ সূত্রে জানা যায়। আশেপাশের এলাকায় শনিবার রাত থেকে ১০ প্লাটুন পুলিশ ও দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। রোববার সকালে আরও ১০ প্লাটুন পুলিশ ও দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে থানার পুলিশ সূত্রে জানা যায়।
জানাজায় অংশগ্রহণে বাধা: আওয়ামী লীগের সমর্থকরা গহিরার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ির রাস্তার অভিমুখে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিএনপির সমর্থক ও সাধারণ জনগণকে জানাজায় অংশ নিতে বাধা প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন রাউজান পৌর মেয়র আবদুল্লাহ আল হাছান।
আমাদের ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, ফাঁসির রায় কার্যকরের পর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুরে মুজাহিদের নিজ বাড়ির অদূরে তার গড়া একটি মাদরাসা প্রাঙ্গণে দাফন করা হয় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুজাহিদের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ফরিদপুর শহরে তার নিজ বাড়িতে পৌঁছে। সেখানে প্রশাসনের কাছ থেকে লাশ গ্রহণ করেন মুজাহিদের ছোট ছেলে আলী আহসান মাহবুব। এরপর পৌনে ৭টায় লাশের জানাজা শেষে সোয়া ৭টায় মুজাহিদের বাড়ির পশ্চিম পাশে তার প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডার গার্টেন মাদরাসা প্রাঙ্গণে তার লাশ দাফন করা হয়।
জানাজা পরিচালনা করেন বড় ভাই আলী আহসান মো. খালেজ। এসময় মুজাহিদের ছেলে আলী আহম্মেদ তাজদিদ, জেলা জামায়াতে নায়েবে আমীর আব্দুর তাওয়াব, এ অঞ্চলের জামায়াতের আমীর দেলোয়ার হোসেন, জেলা জামায়াত সেক্রেটারিসহ তার পরিবারের সদস্যসহ আশেপাশের লোকজন মুজাহিদের জানাজায় অংশ নেন।
মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে জেনে তার বাড়ির সামনে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে শত শত মানুষ অবস্থান নেয়। রাতভর তারা প্রতীক্ষায় থাকেন কখন লাশ আসবে। লাশ আসার পর সকাল পৌনে সাতটায় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বহিরাগত কাউকেই জানাজা ও দাফন কাজে যেতে দেয়নি। শুধুমাত্র মুজাহিদের পরিবারের সদস্য, জেলা জামায়াতের নেতাকর্মীরা ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। এদিকে মুজাহিদের লাশ দাফন শেষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পশ্চিম খাবাসপুরে দাঁড়িয়ে থাকা জামায়াত কর্মীরা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিলে পুলিশ তাদেরকে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় পুলিশ দুই জামায়াত কর্মীকে আটক করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। মুজাহিদের ভাই ফরিদপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর আলী আহসান মো. খালেজ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ সাজানো মামলায় সাজানো সাক্ষীতে আমার ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমার ভাই একজন সৎ মানুষ। মুজাহিদের ছেলে আলী আহসান মাহবুব বলেছেন, আমার পিতাকে ষড়যন্ত্র ভাবে মামলায় জড়িয়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। সরকার আমার পিতাকে তার দল, পরিবার সর্বোপরি সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। জেলা জামায়াতে আমীর আব্দুল তাওয়াব ও জেলা সেক্রেটারি বদরউদ্দীন বলেন, আমরা আগামীকাল সোমবার হরতালে ডাক দিয়েছি।
‘প্রাণভিক্ষা কোন মানুষের কাছে নয়’
গতকাল সকালে চট্টগ্রামের রাউজানে দাফনের পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন তার বড় ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, আব্বা বলেছেন, প্রাণভিক্ষা বা ক্ষমা চাইলে আল্লাহর কাছে চাইবো, কোন মানুষের কাছে নয়। শেষ দেখায় প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ওই কথা বলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ফাঁসি কার্যকরের আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি আরও বলেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে হুম্মাম বলেন, বলা হচ্ছে- বাবা প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। তাকে মানুষ বাংলার বাঘ হিসেবে চিনে। তিনি কখনও প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। আমি যখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম বাবা বলেছেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করতে পারে না। ১০ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অবৈধ রায়ে বাবাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তবু আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি। দেশে এখন এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেখানে অনেক খুন-গুম হচ্ছে। অনেকে আপনজনের মরদেহ খুঁজে পাচ্ছে না। আমরা ভাগ্যবান যে সম্মানের সঙ্গে বাবাকে দাফন করতে পেরেছি। তিনি বলেন, একজন বেকসুর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের মানুষ অবশ্যই একদিন ন্যায়বিচারের ডাক দিবে। হুম্মাম বলেন, তিনি চট্টগ্রামের সিংহপুরুষ। ইংরেজিতে ‘লিগেসি’ বলে যা আছে তা টিকে থাকবে। এ হত্যার বিচার একদিন না একদিন হবে। চট্টগ্রামের মানুষ এ রায় কোনদিন মেনে নেবে না। সংবাদ সম্মেলনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেছেন- আমি যদি মার্সি (ক্ষমা) চাই, তবে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে চাইবো, কোন বান্দার কাছে নয়। সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রহমান চৌধুরীসহ তাদের আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। ওদিকে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শেষ দেখায় স্ত্রী তামান্না-ই জাহানকে ধৈর্য ধরতে এবং শান্ত থাকতে বলেছেন। শনিবার মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে স্বজনদের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে স্ত্রীকে এমন পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তার পুত্র আলী আহমেদ মাবরুর। গতকাল মানবজমিনকে মাবরুর বলেন, বিদায় বেলায় আব্বাকে একেবারেই শান্ত ও স্বাভাবিক দেখা গেছে। তবে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে তিনি বেশ রিএ্যাক্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবনের শেষ দিনও সরকার আমাকে নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার করেছে। এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে। মুজাহিদ স্বজনদের বলেছেন, আমি কোন অপরাধ করিনি। সরকার আমার কোন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তবু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছি সাক্ষ্যপ্রমাণবিহীন এমন ঢালাও অভিযোগ দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যে রকম অপরাধের কোন প্রমাণ নেই সে অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবো কেন। মুজাহিদ বলেছেন, প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি প্রচার করে সরকার আমাকে কাপুরুষ হিসেবে দেশ ও জাতি এমনকি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যারা আমাকে চিনে, আমার নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে অবগত তারা কখনও এসব বিশ্বাস করবে না। মাবরুর বলেন, আব্বা বলেছেন, ক্ষমাপ্রার্থনার নাটক করে সরকার দেশবাসী বিশেষ করে আমার দলের লোকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। হাশরের ময়দানে দেখা হবে- স্ত্রীকে এমন সান্ত্বনা দিয়ে বিদায়ের শেষ মুহূর্তে মুজাহিদ বলেছেন, সংসার জীবনে তোমার মতো ভাল স্ত্রী পেয়ে স্রষ্টার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রতি উত্তরে মুজাহিদ স্ত্রী তামান্না-ই জাহান স্বামীকে একজন ভাল এবং নির্দোষ মানুষ হিসেবে প্রশংসা করেন।
এদিকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ শনিবার মধ্যরাতে দেয়া বিবৃতিতে বলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মুজাহিদের সঙ্গে যে তামাশা করা হয়েছে এবং মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন বলে যে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে তাতে দেশবাসী ক্ষুব্ধ। মুজাহিদের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা শেষ সাক্ষাৎ করে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে দোষ স্বীকার করেননি, ক্ষমা প্রার্থনা করেননি এবং প্রাণভিক্ষাও চাননি। তিনি বলেন, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে যে দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলাদেশের জনগণ কখনও ভুলবে না। তিনি ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে জনগণের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। বর্তমান স্বৈরাচারী জালেম সরকার এরকম একজন সৎ, আল্লাহভীরু ও যোগ্য জাতীয় নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করায় জাতি গভীরভাবে শোকাহত ও ক্ষুব্ধ।
No comments