৩২ বছর বয়সে আট সন্তানের মা by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কাগজেই
৩২
বছরেই ফাইমা হয়েছেন আট সন্তানের মা। এর মধ্যে ২ সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
বিয়ের দু’বছর অন্তর অন্তর সন্তান জন্ম দিয়েছেন ফাইমা দম্পতি। এখন এই
পরিবারের নুন আনতে পান্তা পুড়ায়। এত সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন
করছেন। থাকেন রাজধানীর হাজারীবাগের বৌবাজার বস্তির পাশে; ছোট্ট একটি কক্ষে,
কচির বাড়িতে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কোন সুবিধার কথাই জানেন না তিনি।
অন্যদিকে, তার পাশে সনাতনগড় ‘নয় ভাই বস্তিতে’ থাকেন হাসি। তার বয়স ২৮ বছর।
এ বয়সেই ছয় সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। অল্প বয়সে বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে আজ
তার নিজের জীবনই হুমকির মুখে। অপুষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীতে ভুগছেন হাসি।
সারাক্ষণ শুয়ে থাকেন। তার শরীরটা দেখতে অনেকটা কঙ্কালের মতো। দেখভাল করছেন
তার এক আত্মীয়।
শুধু ফাইমা ও হাসি নয়, স্বয়ং রাজধানীর মধ্যেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন বহু দম্পতি। কালেভদ্রে যেটুকুও পান তা এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে। অনেকে আবার টাকার অভাবে এনজিওদের পন্থায় পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি নিতে পারেন না। ফলে থমকে যেতে বসেছে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, এমনই মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দম্পতিদের কাছে পৌঁছায় না বলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরকারি কোন ধরনের সুবিধা না পেয়ে তারা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে। রাজধানীর এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মাঠকর্মীরা সহজে যান না বলে অভিযোগ আছে। সরকারের এই কর্মসূচি এখন অনেকটা গৌন কি-না তাও প্রশ্ন রাখছেন অনেকে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দানের অভাব, উপকরণ বিতরণে অপ্রতুলতা ম্লান করে দিতে পারে বাংলাদেশের এক্ষেত্রের পূর্বের অর্জনকে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে। সরকারি হাসপাতালের আন্তরিকতা, মাঠকর্মী বৃদ্ধি ও নতুন নীতিমালারও প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৬১ দশমিক ২ শতাংশে উপনীত হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই হার সন্তোষজনক নয়। ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখাতে জনবলও বাড়াতে হবে। অনেক মাঠকর্মী আছেন যারা মাঠে সঠিকভাবে কাজ করেন না। অনেকে মাঠেই যান না। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাইরের একটি দাতা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, নানাবিধ কারণে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কিছুটা থমকে আছে। এই সেক্টরকে সরকার ভালোভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সেইভাবে বাজেটও দেয় না। এটি একাডেমি জায়গা। অন্য জায়গা থেকে লোক এসে কাজ বোঝার আগেই আবার চলে যান। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এখানে অনেক সুবিধাবাদী গ্রুপ আছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। পদোন্নতি না থাকায় হতাশ তারা।
পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যকণিকা ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে টিএফআর বা মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সিপিআর বা কনট্রাসেপটিভ প্রিভিলেজ রেট ৬১ দশমিক ২ শতাংশ। পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রসঙ্গত, জাতীয়ভাবে টিএফআর ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল ১৯৭১-৭৫ সালে, ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল ১৯৯১-৯৩ সালে, ৩ শতাংশ ছিল ২০০১-০৩ সালে, ২ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল ২০১১ সালে এবং যা এখনও স্থির রয়েছে। অন্যদিকে, সিপিআর ছিল ১৯৭৫ সালে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০০০ সালে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ৬১ দশমিক ২ শতাংশ এবং যা এখনও আছে। বিভাগীয় শহরগুলোর এই চিত্রে দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকায় মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং সিপিআর ৬১ শতাংশ। খুলনায় মোট প্রজনন হার ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সিপিআর ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সিলেটে মোট প্রজনন হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ ও সিপিআর ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ ও সিপিআর ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ। রাজশাহীতে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১ শতাংশ ও সিপিআর ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ, বরিশালে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ ও সিপিআর ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ, রংপুর বিভাগে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১ শতাংশ ও সিপিআর ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিজস্ব হিসাবে, চলতি বছরে জুলাই মাসে সিএআর (সক্ষম দম্পতি ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণকারীর হার ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ)। এ বছর ৭ই থেকে ১২ই নভেম্বর সেবা ও প্রচার সপ্তাহ উপলক্ষে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সেবাগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক সাড়া পেয়েছে। এতে সারা দেশে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন (নারী-পুরুষ মিলে) ১০ হাজার ৮৬৬ জন। এরমধ্যে নারী ৬ হাজার ৮২৬, পুরুষ ৪ হাজার ৩৮ জন। দীর্ঘমেয়াদি আইইউডি নিয়েছেন ২৮ হাজার ৭২০ জন এবং এমপ্লান্ট (হাতে কাঠি লাগানো) নিয়েছেন ৩৪ হাজার ৬০ জন। সূত্রমতে, মাতৃমৃত্যুর হারের দিক থেকে প্রতি লাখে ১৪৩ জন জীবিত জন্ম লক্ষ্য থাকলেও আছে ১৭০ জন। তবে, এটা আগে ছিল ১৯৪ জন। আর শিশুমৃত্যু হারের দিক থেকে প্রতি হাজারে ৪৮ জন জীবিত জন্মের টার্গেট ছিল। তা অর্জন করে দাঁড়িয়েছে ৪৬ জনে। এটা আগে ছিল ৩১ জন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে নারী সন্তান ধারণে দীর্ঘ প্রজননকাল পাচ্ছে। বেশি সন্তান জন্মদানের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আঠারো বছরের আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে। যা পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশি। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও ধারণার কারণে অনেক মেয়ে শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বলে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় উঠে এসেছে। সমপ্রতি সংস্থাটির কর্মকর্তারা গবেষণার এই ফলাফল তুলে ধরেন। গবেষণার প্রতিবেদনের ফলাফল উল্লেখ করে তারা বলেন, এশিয়ার তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার গ্রামাঞ্চলের বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার বেশ উদ্বেগজনক।
গাইনি বিশেষজ্ঞরা বলেন, লোকজন মনে করে যেহেতু তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো তাই বেশি সন্তান হলে সমস্যা নেই। অধিক জন্মহারের জন্য পুত্রসন্তান নেয়ার আকাঙক্ষাকেই দায়ী করেন তারা। এক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের তাদের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া এবং স্থায়ী বন্ধ্যাকরণের হার বৃদ্ধির উপর জোর দেন তারা। পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পরিদর্শকরা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী দম্পতির সংখ্যা তাদের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রার) খাতায় বাড়িয়ে লিখে থাকেন। একই সঙ্গে অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকরা ষাটোর্ধ্ব নারী ও পুরুষদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করাচ্ছেন। এক হাজার টাকা ভাতা ও শাড়ি এবং লুঙ্গির লোভ দেখিয়ে তাদের এ বন্ধ্যাকরণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের নারীর আর সন্তান ধারণ ক্ষমতা থাকে না।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা জানান, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকদের রয়েছে আন্তরিকতার অভাব। মাঠে গিয়ে তারা গ্রহীতাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করতে ঠিকমতো কাউন্সেলিং করতে পারছেন না। মাঠকর্মীদের কাজে দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
কেইস স্টাডি এক: ৩২ বছর বয়সেই ফাইমা আট সন্তানের মা হয়েছে। বিয়ের দু’বছর অন্তর অন্তর বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন ফাইমা দম্পতি। এখন এই পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ছয় সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আটজনের মধ্যে দু’সন্তান মারা গেছে। চার মেয়ে, দুই ছেলে। কোন সন্তানই পড়াশোনা করছে না। থাকেন রাজধানীর হাজারীবাগের বৌবাজার বেড়িবাঁধের বস্তির পাশে; কচির বাড়িতে ছোট্ট একটি কক্ষে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কোন সুবিধাই পাননি তিনি। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করার কলাকৌশল না জানাকেই দায়ী করছেন ফাইমা। তবে, অনেক দুয়ার ঘুরে এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণের কপাটি পদ্ধতি নিয়েছেন অল্প কয়েকদিন আগে। তা আবার বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে। টাকার অভাবেও তিনি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নিতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন। সরজমিন ফাইমার কক্ষে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি জানান, ধানমণ্ডিতে আসার আগে যাত্রাবাড়ীর ডেমরায় থাকতেন। বেশির ভাগ সন্তান ওখানেই জন্ম নিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ওখানেও কোন সরকারি লোক (পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী) আসতো না, এখানেও না। তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। স্বামী আবদুল বারেক রিকশা চালান। দু’টি কিডনি নষ্ট তার। ফাইমার সঙ্গে আলাপকালে পাশের ঘরের ষাটোর্ধ্ব আলতাফ আকন্দও অভিযোগ করে বললেন, সরকারি কোন পরিবার পরিকল্পনার লোক এখানে আসে না। ফলে পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি কিভাবে জানবে বলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন।
কেইস স্টাডি দুই: শরীরে কোন শক্তি নেই। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকেন। কঙ্কালের মতো অবস্থা। অপুষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীতে ভুগছেন হাসি বিবি। অল্প বয়সে বেশি সন্তানের জন্ম দিয়ে আজ তার নিজের জীবনই হুমকির মুখে পড়েছে। ২৮ বছর বয়সেই ছয় সন্তানের মা। চার সন্তান মারা গেছে। সাড়ে তিন মাস আগে মিন নামের একটি কন্যা সন্তানের আগমন ঘটেছে তাদের পরিবারে। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তাদের। প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়াই যেন এই দম্পতির লক্ষ্য। কোন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেননি তারা। ইচ্ছাও নেই বলে তাদের এক আত্মীয়া জানিয়েছেন। নিকট এই আত্মীয়া হাসির ঘরে বসেই এই প্রতিবেদককে বললেন, হাসির স্বামীর এসব পদ্ধতির ব্যাপারে মোটেই আগ্রহ নেই। এছাড়া, এখানে কোন সরকারি লোক এসে বিষয়টি ভালোভাবে তুলেও ধরছে না। তাই তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ কি তাও বুঝছে না। হতদরিদ্র পরিবারটির দেখভাল করছেন তার নিকট এই আত্মীয়া। বেড়িবাঁধের সনাতনগড় ‘নয় ভাই বস্তিতে’ থাকেন হাসি দম্পতি। যা রাজধানীর হাজারীবাগস্থ বৌবাজারের কাছেই। হাসির স্বামী টিটু প্রাইভেট গাড়ি চালান। বস্তিতে এক হাজার টাকা দিয়ে মাটির ছোট্ট ঝুপরি ঘরে থাকেন তারা।
৩০ বছর বয়সী আসমাও থাকেন নগরীর একই বস্তিতে। তারও চার সন্তান। আসমা, হাসি ও ফাইমার মতো এ বস্তির বহু দম্পতির চার থেকে আট সন্তান রয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সুবিধা না পাওয়া, বাল্যবিবাহ এবং দরিদ্রতার কারণে তাদের অধিক সন্তান হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করার কলাকৌশল না জানাকেইও দায়ী করছেন তারা। অনেক নারী আবার বলছেন, এসব তারা পছন্দ করলেও স্বামী পছন্দ করে না। অশিক্ষিত দরিদ্র বস্তি পরিবারেই শুধু এ চিত্র নয়। কোথাও কোথাও এটি মধ্যবিত্ত, সচ্ছল পরিবারেরও প্রায় চিত্র দেখা মিলে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের যুক্তি সন্তান বেশি থাকলে বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে খাওয়াতে পারবে। আর সচ্ছল পরিবারের যুক্তি সম্পত্তির প্রতুলতায় সংসারে আর একটি সন্তান আসুক। এভাবেই বেড়ে চলেছে দেশের জনসংখ্যা।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবী এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, বস্তি, হাওর ও চর এলাকায় প্রজনন হার বেশি। দরিদ্র ও হতদরিদ্র হওয়ার কারণে এখানে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়। বস্তিগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এনজিওদের নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকা দেখেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। টিএফআর এখন স্থিতিশীল আছে। আগেও এ রকম অভিযোগ ছিল। এখনও আছে। ৯০-দশকের দিকে একই রকম ছিল। তিনি বলেন, ৬ বা ৭ থেকে কমানো সহজ। কিন্তু ২ দশমিক ৩ থেকে ১ বা ২ কমানো অত সহজ নয়। দেশের সব বিভাগে একই চিত্র দেখা যায় না। ধীরগতিতে এগুচ্ছে। তাতে উদ্বেগের কিছুই নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন হয়েছে। নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নিয়ে তা কমানো যায় বলে এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন। অথবা পুরনো কর্মসূচিকে ভিন্নভাবে আরও কিভাবে সাড়া জাগানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। কিছু জায়গাকে আওতায় আনা যায় না। ওই সব জায়গাকে এড্রেস করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে ক্রাস প্রোগ্রাম নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নূর হোসেন তালুকদার মানবজমিনকে বলেন, টিএফআর ২-এ নামানোই এখন টার্গেট। সিলেট ও চট্টগ্রামে ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য এই দু’টি বিভাগে এই সংখ্যা বেশি। ওখানে এনজিওদের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বস্তি, নদীভাঙা এলাকার হতদরিদ্র ২৫ শতাংশ লোকই আমাদের মূল লক্ষ্য। নারীদের কাছে দশ বছর মেয়াদি পদ্ধতি হিসেবে আইইউডি (ইন্ট্রা ইউট্যারিন ডিভাইস) এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। ঢাকার বস্তিতে এনজিওরা কাজ করে। মাঠকর্মীদের মাঠে না যাওয়া এবং তৎপরতায় ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে মহাপরিচালক বলেন, তাদেরকে প্রশাসনিকভাবে জবাবদিহিতায় আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কর্মীরা মাঠে না গেলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি স্থবির তো হবেই। কর্মীরা না গেলে মানুষ সচেতন হবে না। সেবা গ্রহণকারীর দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। মুটিভেটেড (অনুপ্রাণিত) করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত মাঠকর্মীরা ইচ্ছামতো ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে দেন এমন অভিযোগের বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেন। দাতা সংস্থাগুলোও এক্ষেত্রে তাদের বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শুধু ফাইমা ও হাসি নয়, স্বয়ং রাজধানীর মধ্যেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন বহু দম্পতি। কালেভদ্রে যেটুকুও পান তা এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে। অনেকে আবার টাকার অভাবে এনজিওদের পন্থায় পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি নিতে পারেন না। ফলে থমকে যেতে বসেছে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, এমনই মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দম্পতিদের কাছে পৌঁছায় না বলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরকারি কোন ধরনের সুবিধা না পেয়ে তারা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে। রাজধানীর এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মাঠকর্মীরা সহজে যান না বলে অভিযোগ আছে। সরকারের এই কর্মসূচি এখন অনেকটা গৌন কি-না তাও প্রশ্ন রাখছেন অনেকে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দানের অভাব, উপকরণ বিতরণে অপ্রতুলতা ম্লান করে দিতে পারে বাংলাদেশের এক্ষেত্রের পূর্বের অর্জনকে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে। সরকারি হাসপাতালের আন্তরিকতা, মাঠকর্মী বৃদ্ধি ও নতুন নীতিমালারও প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৬১ দশমিক ২ শতাংশে উপনীত হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই হার সন্তোষজনক নয়। ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখাতে জনবলও বাড়াতে হবে। অনেক মাঠকর্মী আছেন যারা মাঠে সঠিকভাবে কাজ করেন না। অনেকে মাঠেই যান না। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাইরের একটি দাতা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, নানাবিধ কারণে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কিছুটা থমকে আছে। এই সেক্টরকে সরকার ভালোভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সেইভাবে বাজেটও দেয় না। এটি একাডেমি জায়গা। অন্য জায়গা থেকে লোক এসে কাজ বোঝার আগেই আবার চলে যান। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এখানে অনেক সুবিধাবাদী গ্রুপ আছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। পদোন্নতি না থাকায় হতাশ তারা।
পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যকণিকা ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে টিএফআর বা মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সিপিআর বা কনট্রাসেপটিভ প্রিভিলেজ রেট ৬১ দশমিক ২ শতাংশ। পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রসঙ্গত, জাতীয়ভাবে টিএফআর ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল ১৯৭১-৭৫ সালে, ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল ১৯৯১-৯৩ সালে, ৩ শতাংশ ছিল ২০০১-০৩ সালে, ২ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল ২০১১ সালে এবং যা এখনও স্থির রয়েছে। অন্যদিকে, সিপিআর ছিল ১৯৭৫ সালে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০০০ সালে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ৬১ দশমিক ২ শতাংশ এবং যা এখনও আছে। বিভাগীয় শহরগুলোর এই চিত্রে দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকায় মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং সিপিআর ৬১ শতাংশ। খুলনায় মোট প্রজনন হার ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সিপিআর ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সিলেটে মোট প্রজনন হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ ও সিপিআর ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ ও সিপিআর ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ। রাজশাহীতে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১ শতাংশ ও সিপিআর ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ, বরিশালে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ ও সিপিআর ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ, রংপুর বিভাগে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১ শতাংশ ও সিপিআর ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিজস্ব হিসাবে, চলতি বছরে জুলাই মাসে সিএআর (সক্ষম দম্পতি ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণকারীর হার ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ)। এ বছর ৭ই থেকে ১২ই নভেম্বর সেবা ও প্রচার সপ্তাহ উপলক্ষে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সেবাগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক সাড়া পেয়েছে। এতে সারা দেশে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন (নারী-পুরুষ মিলে) ১০ হাজার ৮৬৬ জন। এরমধ্যে নারী ৬ হাজার ৮২৬, পুরুষ ৪ হাজার ৩৮ জন। দীর্ঘমেয়াদি আইইউডি নিয়েছেন ২৮ হাজার ৭২০ জন এবং এমপ্লান্ট (হাতে কাঠি লাগানো) নিয়েছেন ৩৪ হাজার ৬০ জন। সূত্রমতে, মাতৃমৃত্যুর হারের দিক থেকে প্রতি লাখে ১৪৩ জন জীবিত জন্ম লক্ষ্য থাকলেও আছে ১৭০ জন। তবে, এটা আগে ছিল ১৯৪ জন। আর শিশুমৃত্যু হারের দিক থেকে প্রতি হাজারে ৪৮ জন জীবিত জন্মের টার্গেট ছিল। তা অর্জন করে দাঁড়িয়েছে ৪৬ জনে। এটা আগে ছিল ৩১ জন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে নারী সন্তান ধারণে দীর্ঘ প্রজননকাল পাচ্ছে। বেশি সন্তান জন্মদানের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আঠারো বছরের আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে। যা পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশি। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও ধারণার কারণে অনেক মেয়ে শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বলে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় উঠে এসেছে। সমপ্রতি সংস্থাটির কর্মকর্তারা গবেষণার এই ফলাফল তুলে ধরেন। গবেষণার প্রতিবেদনের ফলাফল উল্লেখ করে তারা বলেন, এশিয়ার তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার গ্রামাঞ্চলের বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার বেশ উদ্বেগজনক।
গাইনি বিশেষজ্ঞরা বলেন, লোকজন মনে করে যেহেতু তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো তাই বেশি সন্তান হলে সমস্যা নেই। অধিক জন্মহারের জন্য পুত্রসন্তান নেয়ার আকাঙক্ষাকেই দায়ী করেন তারা। এক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের তাদের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া এবং স্থায়ী বন্ধ্যাকরণের হার বৃদ্ধির উপর জোর দেন তারা। পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পরিদর্শকরা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী দম্পতির সংখ্যা তাদের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রার) খাতায় বাড়িয়ে লিখে থাকেন। একই সঙ্গে অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকরা ষাটোর্ধ্ব নারী ও পুরুষদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করাচ্ছেন। এক হাজার টাকা ভাতা ও শাড়ি এবং লুঙ্গির লোভ দেখিয়ে তাদের এ বন্ধ্যাকরণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের নারীর আর সন্তান ধারণ ক্ষমতা থাকে না।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা জানান, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকদের রয়েছে আন্তরিকতার অভাব। মাঠে গিয়ে তারা গ্রহীতাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করতে ঠিকমতো কাউন্সেলিং করতে পারছেন না। মাঠকর্মীদের কাজে দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
কেইস স্টাডি এক: ৩২ বছর বয়সেই ফাইমা আট সন্তানের মা হয়েছে। বিয়ের দু’বছর অন্তর অন্তর বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন ফাইমা দম্পতি। এখন এই পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ছয় সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আটজনের মধ্যে দু’সন্তান মারা গেছে। চার মেয়ে, দুই ছেলে। কোন সন্তানই পড়াশোনা করছে না। থাকেন রাজধানীর হাজারীবাগের বৌবাজার বেড়িবাঁধের বস্তির পাশে; কচির বাড়িতে ছোট্ট একটি কক্ষে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কোন সুবিধাই পাননি তিনি। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করার কলাকৌশল না জানাকেই দায়ী করছেন ফাইমা। তবে, অনেক দুয়ার ঘুরে এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণের কপাটি পদ্ধতি নিয়েছেন অল্প কয়েকদিন আগে। তা আবার বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে। টাকার অভাবেও তিনি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নিতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন। সরজমিন ফাইমার কক্ষে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি জানান, ধানমণ্ডিতে আসার আগে যাত্রাবাড়ীর ডেমরায় থাকতেন। বেশির ভাগ সন্তান ওখানেই জন্ম নিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ওখানেও কোন সরকারি লোক (পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী) আসতো না, এখানেও না। তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। স্বামী আবদুল বারেক রিকশা চালান। দু’টি কিডনি নষ্ট তার। ফাইমার সঙ্গে আলাপকালে পাশের ঘরের ষাটোর্ধ্ব আলতাফ আকন্দও অভিযোগ করে বললেন, সরকারি কোন পরিবার পরিকল্পনার লোক এখানে আসে না। ফলে পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি কিভাবে জানবে বলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন।
কেইস স্টাডি দুই: শরীরে কোন শক্তি নেই। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকেন। কঙ্কালের মতো অবস্থা। অপুষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীতে ভুগছেন হাসি বিবি। অল্প বয়সে বেশি সন্তানের জন্ম দিয়ে আজ তার নিজের জীবনই হুমকির মুখে পড়েছে। ২৮ বছর বয়সেই ছয় সন্তানের মা। চার সন্তান মারা গেছে। সাড়ে তিন মাস আগে মিন নামের একটি কন্যা সন্তানের আগমন ঘটেছে তাদের পরিবারে। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তাদের। প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়াই যেন এই দম্পতির লক্ষ্য। কোন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেননি তারা। ইচ্ছাও নেই বলে তাদের এক আত্মীয়া জানিয়েছেন। নিকট এই আত্মীয়া হাসির ঘরে বসেই এই প্রতিবেদককে বললেন, হাসির স্বামীর এসব পদ্ধতির ব্যাপারে মোটেই আগ্রহ নেই। এছাড়া, এখানে কোন সরকারি লোক এসে বিষয়টি ভালোভাবে তুলেও ধরছে না। তাই তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ কি তাও বুঝছে না। হতদরিদ্র পরিবারটির দেখভাল করছেন তার নিকট এই আত্মীয়া। বেড়িবাঁধের সনাতনগড় ‘নয় ভাই বস্তিতে’ থাকেন হাসি দম্পতি। যা রাজধানীর হাজারীবাগস্থ বৌবাজারের কাছেই। হাসির স্বামী টিটু প্রাইভেট গাড়ি চালান। বস্তিতে এক হাজার টাকা দিয়ে মাটির ছোট্ট ঝুপরি ঘরে থাকেন তারা।
৩০ বছর বয়সী আসমাও থাকেন নগরীর একই বস্তিতে। তারও চার সন্তান। আসমা, হাসি ও ফাইমার মতো এ বস্তির বহু দম্পতির চার থেকে আট সন্তান রয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সুবিধা না পাওয়া, বাল্যবিবাহ এবং দরিদ্রতার কারণে তাদের অধিক সন্তান হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করার কলাকৌশল না জানাকেইও দায়ী করছেন তারা। অনেক নারী আবার বলছেন, এসব তারা পছন্দ করলেও স্বামী পছন্দ করে না। অশিক্ষিত দরিদ্র বস্তি পরিবারেই শুধু এ চিত্র নয়। কোথাও কোথাও এটি মধ্যবিত্ত, সচ্ছল পরিবারেরও প্রায় চিত্র দেখা মিলে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের যুক্তি সন্তান বেশি থাকলে বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে খাওয়াতে পারবে। আর সচ্ছল পরিবারের যুক্তি সম্পত্তির প্রতুলতায় সংসারে আর একটি সন্তান আসুক। এভাবেই বেড়ে চলেছে দেশের জনসংখ্যা।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবী এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, বস্তি, হাওর ও চর এলাকায় প্রজনন হার বেশি। দরিদ্র ও হতদরিদ্র হওয়ার কারণে এখানে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়। বস্তিগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এনজিওদের নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকা দেখেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। টিএফআর এখন স্থিতিশীল আছে। আগেও এ রকম অভিযোগ ছিল। এখনও আছে। ৯০-দশকের দিকে একই রকম ছিল। তিনি বলেন, ৬ বা ৭ থেকে কমানো সহজ। কিন্তু ২ দশমিক ৩ থেকে ১ বা ২ কমানো অত সহজ নয়। দেশের সব বিভাগে একই চিত্র দেখা যায় না। ধীরগতিতে এগুচ্ছে। তাতে উদ্বেগের কিছুই নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন হয়েছে। নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নিয়ে তা কমানো যায় বলে এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন। অথবা পুরনো কর্মসূচিকে ভিন্নভাবে আরও কিভাবে সাড়া জাগানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। কিছু জায়গাকে আওতায় আনা যায় না। ওই সব জায়গাকে এড্রেস করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে ক্রাস প্রোগ্রাম নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নূর হোসেন তালুকদার মানবজমিনকে বলেন, টিএফআর ২-এ নামানোই এখন টার্গেট। সিলেট ও চট্টগ্রামে ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য এই দু’টি বিভাগে এই সংখ্যা বেশি। ওখানে এনজিওদের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বস্তি, নদীভাঙা এলাকার হতদরিদ্র ২৫ শতাংশ লোকই আমাদের মূল লক্ষ্য। নারীদের কাছে দশ বছর মেয়াদি পদ্ধতি হিসেবে আইইউডি (ইন্ট্রা ইউট্যারিন ডিভাইস) এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। ঢাকার বস্তিতে এনজিওরা কাজ করে। মাঠকর্মীদের মাঠে না যাওয়া এবং তৎপরতায় ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে মহাপরিচালক বলেন, তাদেরকে প্রশাসনিকভাবে জবাবদিহিতায় আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কর্মীরা মাঠে না গেলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি স্থবির তো হবেই। কর্মীরা না গেলে মানুষ সচেতন হবে না। সেবা গ্রহণকারীর দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। মুটিভেটেড (অনুপ্রাণিত) করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত মাঠকর্মীরা ইচ্ছামতো ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে দেন এমন অভিযোগের বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেন। দাতা সংস্থাগুলোও এক্ষেত্রে তাদের বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
No comments