মাওবাদী ও ভারত -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনবিরোধী যুদ্ধ by অরুন্ধতী রায়
কন্দ সম্প্রদায়ের সর্বজনীন বিধানদাতা দেবতা নিয়াম রাজার বাসস্থান নিয়ামগিরি পাহাড় বিক্রি করা হয়েছে বেদান্ত নামের এক কোম্পানির কাছে। বেদান্ত বিশ্বের বৃহত্তম খনি করপোরেশনের অন্যতম। এর মালিক অনীল আগরওয়াল লন্ডনের যে প্রাসাদে বাস করেন, সেটির মালিক ছিলেন ইরানের শাহ।
এসব পাহাড় ধ্বংস হলে পাহাড়কে পরিবেষ্টিত করে রাখা বনও ধ্বংস হবে। এখানে জন্ম নেওয়া নদী-নালা ও ঝরনার প্রবাহও থেমে যাবে। সমতলে আর সেচের পানি মিলবে না। ভারতের আরণ্যক কেন্দ্রে বসবাসকারী লাখ লাখ আদিবাসীর জীবন আজ এভাবেই আক্রান্ত।
শহরের কিছু মানুষ বলবে, ‘তাতে কী? প্রগতির জন্য কাউকে না কাউকে তো কোরবানি হতেই হবে। এবার এদের পালা। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশকে দেখুন—তারাও এ রকম উচ্ছেদ করেছে, আমাদের করতে দোষ কী?’ এমন ভাবনা থেকেই সরকার অপারেশন ‘সবুজ শিকার’ (গ্রিন হান্ট) ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধের ঘোষিত নিশানা মধ্য ভারতের অরণ্যের ভেতর গড়ে তোলা ‘মাওবাদী’ বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলো। কেবল মাওবাদীরাই বিদ্রোহী নয়। ভারতজুড়েই ভূমিহীন, দলিত, বাস্তুহারা, শ্রমিক, কৃষক, তাঁতি জনসাধারণ লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। তারা লড়ছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, জনগণের জমি ও সম্পদ করপোরেট কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার নীতির বিরুদ্ধে। তাদের শত্রুপক্ষ মহা প্রতাপশালী। দুই বছর আগে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাওবাদীদের ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি’ হিসেবে দাগিয়ে দেন। এ বছর ১৮ জুন লোকসভায় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদবহুল এলাকায় চরম বামপন্থার বিস্তার ঘটলে বিনিয়োগের পরিবেশের ওপর নির্ঘাত এর প্রভাব পড়বে।’
এই মাওবাদী কারা? এরা নিষিদ্ধঘোষিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)—সিপিআই (মাওবাদী)-এর সদস্য। ১৯৬৯ সালের নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অন্যতম উত্তরসূরি এই দল। মাওবাদীরা মনে করে, ভারতীয় সমাজের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে যাওয়া বৈষম্য দূর করার একমাত্র পথ ভারতীয় রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করা। ঝাড়খণ্ড ও বিহারে মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশে জনযুদ্ধ গ্রুপের বিপুল জনসমর্থন ছিল। ২০০৪ সালে অল্প দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারানগালে তাদের এক জমায়েতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।
মধ্য ভারতে মাওবাদীদের গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের প্রায় সবাই হতদরিদ্র ও দুর্ভিক্ষপীড়িত উপজাতীয়। তাদের সঙ্গে তুলনীয় কেবল সাহারা মরুর ভুখা মানুষেরা। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরও এসব মানুষের জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা আইনি অধিকারের সুযোগ আসেনি। দশকের পর দশক এরা নির্মম শোষণে বন্দী। ব্যবসায়ী ও মহাজনরা প্রতিনিয়ত এদের প্রতারিত করে, পুলিশ ও বন বিভাগের কর্মীরা মনে করেন, এদের নারীদের ধর্ষণ করা তাঁদের অধিকার। মাওবাদী কর্মীরাই প্রথম তাদের মর্যাদা দিয়েছে, দশকের পর দশক তারা এদের সঙ্গে থেকেছে, কাজ করেছে এবং একসঙ্গে লড়েছে।
যে সরকার হিংসা ও অবজ্ঞা ছাড়া এদের কিছুই দেয়নি, সেই সরকার এখন তাদের শেষ সম্বল জমিটুকুও ছিনিয়ে নিতে চায়। তারা সরকারের উন্নয়নের বুলিতে বিশ্বাস করে না। এ জন্যই তারা আজ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে মাওবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য ভারতীয় রাষ্ট্রের উচ্ছেদ হলেও এখন নেতারাও বুঝছেন যে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি অপুষ্ট আদিবাসীদের এই বাহিনী— যাদের অনেকেই জীবনে কখনো ট্রেন বা বাস বা এমনকি কোনো ছোট শহরও দেখেনি, তাদের লড়াই কেবলই টিকে থাকার জন্য। আর কিছু তারা বোঝে না।
২০০৮ সালে পরিকল্পনা কমিশন নিযুক্ত এক বিশেষজ্ঞ দল চরমপন্থী অধ্যুষিত এলাকায় উন্নয়নের চ্যালেঞ্জবিষয়ক এক প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে বলা হয়, ‘নকশাল (মাওবাদী) আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বীকৃতি দিতে হবে, যার শক্ত ভিত আছে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষক এবং আদিবাসীদের মধ্যে। এ আন্দোলনকে সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা, সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও স্থানীয় উন্নয়নের লড়াই হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’ এ বক্তব্য ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’র থেকে অনেক আলাদা।
যে জনগণ আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তারা টিভি দেখতে দেখতে (অথবা টিভির জন্য পারফর্ম করতে করতে) বা পত্রিকা পড়তে পড়তে বা কোনো এসএমএস জরিপে সময় ব্যয় করছে না। তারা মাঠে আছে। লড়াইয়ে আছে। তারা মনে করে, নিজেদের ঘরদোর ও জমিজিরাত রক্ষা করা তাদের অধিকার। তারা মনে করে ন্যায়বিচার প্রাপ্য তাদের।
এসব বিপজ্জনক মানুষদের হাত থেকে স্বচ্ছল নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকার বলছে, এ যুদ্ধ জিততে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। অদ্ভুত ব্যাপার যে ২৬/১১-তে মুম্বাই হামলার পরও সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলতে রাজি ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গেও কথা বলতে প্রস্তুত তারা। কিন্তু গরিবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশ্নে সরকারের অবস্থান কঠোর।
পুলিশের বিশেষ বাহিনী খুনের অনুমতি নিয়ে পাহাড়ে হন্যে হয়ে মাওবাদী খোঁজে; সেন্টাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ), বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ও কুখ্যাত নাগা ব্যাটালিয়ন ইতিমধ্যে গভীর বনের ভেতর গ্রামগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও অমানবিক নৃশংসতা ঘটায়। সরকারি অস্ত্রে সজ্জিত সালওয়া জুদাম নামের মিলিশিয়ারা বনের ভেতর সামনে যাদের পেয়েছে, তাদের খুন, ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। তাদের কারণে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদার তিন লাখ মানুষ বাস্তুহারা ও পলাতক। এখন ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ ও হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে। ব্যবহার হবে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। এরা সবাই গুলি করবে ‘আত্মরক্ষা’র খাতিরে। অথচ গরিব মানুষের সেই অধিকার নেই। খনি কোস্পানিগুলো এ যুদ্ধের জন্য মরিয়া। তাদের ধারণা, যে মানুষ এত দিন উচ্ছেদ ঠেকাতে সমর্থ হয়েছে, সহিংসতার চাপে তারা এবার সরে দাঁড়াবে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম অতীতে করপোরেট আইনজীবী হিসেবে বহু খনি কোম্পানির পক্ষে কাজ করেছেন, তিনি বেদান্তের পরিচালক ছিলেন, ২০০৪ সালে সেই পদ ছেড়ে ওই দিনই অর্থমন্ত্রী হন। এটি কী বার্তা বহন করে?
জনগণের ওপর নৃসংশতা নেমে এলে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের জন্য আর কী পথ খোলা থাকে? একমাত্র বিকল্প পথ আত্মহত্যা, ঋণের চক্রে আটকা পড়ে এক লাখ ৮০ হাজার কৃষক যেমন করেছে। প্রতিটি পাহাড়, নদী ও বনের ফাঁকা জায়গার জন্য চুক্তি করা আছে। সামাজিক ও পরিবেশগত অবিশ্বাস্য বদল ঘটানো হচ্ছে গোপনে, দক্ষতার সঙ্গে। শান্তিপূর্ণ পথে তা করা না গেলে, বলপ্রয়োগে তা আদায় করা হবে। মুক্তবাজার ব্যবস্থার চাপ ও প্রয়োজন এমনই।
জনগণ দেখেছে নদী শুকিয়ে গেছে, বন বিলীন হয়েছে, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে; তারা বুঝতে পারছে তাদের প্রতি কী করা হয়েছে। আজ সারা ভারতে অস্থিরতা। জনগণ তাদের ভূমি, তাদের সম্পদে অধিকার ছেড়ে দিতে নারাজ, তাই প্রতিবাদ। তারা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতে চায় না। ভারতের উন্নতির জাহাজ চড়ায় আটকে গেছে। তাই পুঁজিপতিরাও মরিয়া। ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রাখতে হলে গণতন্ত্র থাকবে না। পাহাড় থেকে বক্সাইট আর লোহার আকরিক আহরণ, ভারতের ৮৫ শতাংশ মানুষকে তাদের জমি থেকে উত্খাত করে শহরে নিয়ে আসতে ভারতকে পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে। সামরিকায়নের পথে যেতে হবে। সামরিকায়নের জন্য দেখাতে হবে শত্রুর জুজুভীতি। আর মাওবাদীরা হলো সেই ‘শত্রু’। হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে মুসলমানরা যেমন, করপোরেট মৌলবাদীদের কাছে মাওবাদীরাও তেমন। শুধু কয়েক হাজার মাওবাদীকে বন থেকে বের করে আনতে এত আয়োজন—এমন ভাবনা হবে বিরাট ভুল।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: আহসান হাবীব
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও সমাজকর্মী।
এসব পাহাড় ধ্বংস হলে পাহাড়কে পরিবেষ্টিত করে রাখা বনও ধ্বংস হবে। এখানে জন্ম নেওয়া নদী-নালা ও ঝরনার প্রবাহও থেমে যাবে। সমতলে আর সেচের পানি মিলবে না। ভারতের আরণ্যক কেন্দ্রে বসবাসকারী লাখ লাখ আদিবাসীর জীবন আজ এভাবেই আক্রান্ত।
শহরের কিছু মানুষ বলবে, ‘তাতে কী? প্রগতির জন্য কাউকে না কাউকে তো কোরবানি হতেই হবে। এবার এদের পালা। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশকে দেখুন—তারাও এ রকম উচ্ছেদ করেছে, আমাদের করতে দোষ কী?’ এমন ভাবনা থেকেই সরকার অপারেশন ‘সবুজ শিকার’ (গ্রিন হান্ট) ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধের ঘোষিত নিশানা মধ্য ভারতের অরণ্যের ভেতর গড়ে তোলা ‘মাওবাদী’ বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলো। কেবল মাওবাদীরাই বিদ্রোহী নয়। ভারতজুড়েই ভূমিহীন, দলিত, বাস্তুহারা, শ্রমিক, কৃষক, তাঁতি জনসাধারণ লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। তারা লড়ছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, জনগণের জমি ও সম্পদ করপোরেট কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার নীতির বিরুদ্ধে। তাদের শত্রুপক্ষ মহা প্রতাপশালী। দুই বছর আগে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাওবাদীদের ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি’ হিসেবে দাগিয়ে দেন। এ বছর ১৮ জুন লোকসভায় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদবহুল এলাকায় চরম বামপন্থার বিস্তার ঘটলে বিনিয়োগের পরিবেশের ওপর নির্ঘাত এর প্রভাব পড়বে।’
এই মাওবাদী কারা? এরা নিষিদ্ধঘোষিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)—সিপিআই (মাওবাদী)-এর সদস্য। ১৯৬৯ সালের নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অন্যতম উত্তরসূরি এই দল। মাওবাদীরা মনে করে, ভারতীয় সমাজের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে যাওয়া বৈষম্য দূর করার একমাত্র পথ ভারতীয় রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করা। ঝাড়খণ্ড ও বিহারে মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশে জনযুদ্ধ গ্রুপের বিপুল জনসমর্থন ছিল। ২০০৪ সালে অল্প দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারানগালে তাদের এক জমায়েতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।
মধ্য ভারতে মাওবাদীদের গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের প্রায় সবাই হতদরিদ্র ও দুর্ভিক্ষপীড়িত উপজাতীয়। তাদের সঙ্গে তুলনীয় কেবল সাহারা মরুর ভুখা মানুষেরা। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরও এসব মানুষের জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা আইনি অধিকারের সুযোগ আসেনি। দশকের পর দশক এরা নির্মম শোষণে বন্দী। ব্যবসায়ী ও মহাজনরা প্রতিনিয়ত এদের প্রতারিত করে, পুলিশ ও বন বিভাগের কর্মীরা মনে করেন, এদের নারীদের ধর্ষণ করা তাঁদের অধিকার। মাওবাদী কর্মীরাই প্রথম তাদের মর্যাদা দিয়েছে, দশকের পর দশক তারা এদের সঙ্গে থেকেছে, কাজ করেছে এবং একসঙ্গে লড়েছে।
যে সরকার হিংসা ও অবজ্ঞা ছাড়া এদের কিছুই দেয়নি, সেই সরকার এখন তাদের শেষ সম্বল জমিটুকুও ছিনিয়ে নিতে চায়। তারা সরকারের উন্নয়নের বুলিতে বিশ্বাস করে না। এ জন্যই তারা আজ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে মাওবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য ভারতীয় রাষ্ট্রের উচ্ছেদ হলেও এখন নেতারাও বুঝছেন যে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি অপুষ্ট আদিবাসীদের এই বাহিনী— যাদের অনেকেই জীবনে কখনো ট্রেন বা বাস বা এমনকি কোনো ছোট শহরও দেখেনি, তাদের লড়াই কেবলই টিকে থাকার জন্য। আর কিছু তারা বোঝে না।
২০০৮ সালে পরিকল্পনা কমিশন নিযুক্ত এক বিশেষজ্ঞ দল চরমপন্থী অধ্যুষিত এলাকায় উন্নয়নের চ্যালেঞ্জবিষয়ক এক প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে বলা হয়, ‘নকশাল (মাওবাদী) আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বীকৃতি দিতে হবে, যার শক্ত ভিত আছে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষক এবং আদিবাসীদের মধ্যে। এ আন্দোলনকে সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা, সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও স্থানীয় উন্নয়নের লড়াই হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’ এ বক্তব্য ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’র থেকে অনেক আলাদা।
যে জনগণ আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তারা টিভি দেখতে দেখতে (অথবা টিভির জন্য পারফর্ম করতে করতে) বা পত্রিকা পড়তে পড়তে বা কোনো এসএমএস জরিপে সময় ব্যয় করছে না। তারা মাঠে আছে। লড়াইয়ে আছে। তারা মনে করে, নিজেদের ঘরদোর ও জমিজিরাত রক্ষা করা তাদের অধিকার। তারা মনে করে ন্যায়বিচার প্রাপ্য তাদের।
এসব বিপজ্জনক মানুষদের হাত থেকে স্বচ্ছল নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকার বলছে, এ যুদ্ধ জিততে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। অদ্ভুত ব্যাপার যে ২৬/১১-তে মুম্বাই হামলার পরও সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলতে রাজি ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গেও কথা বলতে প্রস্তুত তারা। কিন্তু গরিবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশ্নে সরকারের অবস্থান কঠোর।
পুলিশের বিশেষ বাহিনী খুনের অনুমতি নিয়ে পাহাড়ে হন্যে হয়ে মাওবাদী খোঁজে; সেন্টাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ), বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ও কুখ্যাত নাগা ব্যাটালিয়ন ইতিমধ্যে গভীর বনের ভেতর গ্রামগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও অমানবিক নৃশংসতা ঘটায়। সরকারি অস্ত্রে সজ্জিত সালওয়া জুদাম নামের মিলিশিয়ারা বনের ভেতর সামনে যাদের পেয়েছে, তাদের খুন, ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। তাদের কারণে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদার তিন লাখ মানুষ বাস্তুহারা ও পলাতক। এখন ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ ও হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে। ব্যবহার হবে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। এরা সবাই গুলি করবে ‘আত্মরক্ষা’র খাতিরে। অথচ গরিব মানুষের সেই অধিকার নেই। খনি কোস্পানিগুলো এ যুদ্ধের জন্য মরিয়া। তাদের ধারণা, যে মানুষ এত দিন উচ্ছেদ ঠেকাতে সমর্থ হয়েছে, সহিংসতার চাপে তারা এবার সরে দাঁড়াবে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম অতীতে করপোরেট আইনজীবী হিসেবে বহু খনি কোম্পানির পক্ষে কাজ করেছেন, তিনি বেদান্তের পরিচালক ছিলেন, ২০০৪ সালে সেই পদ ছেড়ে ওই দিনই অর্থমন্ত্রী হন। এটি কী বার্তা বহন করে?
জনগণের ওপর নৃসংশতা নেমে এলে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের জন্য আর কী পথ খোলা থাকে? একমাত্র বিকল্প পথ আত্মহত্যা, ঋণের চক্রে আটকা পড়ে এক লাখ ৮০ হাজার কৃষক যেমন করেছে। প্রতিটি পাহাড়, নদী ও বনের ফাঁকা জায়গার জন্য চুক্তি করা আছে। সামাজিক ও পরিবেশগত অবিশ্বাস্য বদল ঘটানো হচ্ছে গোপনে, দক্ষতার সঙ্গে। শান্তিপূর্ণ পথে তা করা না গেলে, বলপ্রয়োগে তা আদায় করা হবে। মুক্তবাজার ব্যবস্থার চাপ ও প্রয়োজন এমনই।
জনগণ দেখেছে নদী শুকিয়ে গেছে, বন বিলীন হয়েছে, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে; তারা বুঝতে পারছে তাদের প্রতি কী করা হয়েছে। আজ সারা ভারতে অস্থিরতা। জনগণ তাদের ভূমি, তাদের সম্পদে অধিকার ছেড়ে দিতে নারাজ, তাই প্রতিবাদ। তারা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতে চায় না। ভারতের উন্নতির জাহাজ চড়ায় আটকে গেছে। তাই পুঁজিপতিরাও মরিয়া। ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রাখতে হলে গণতন্ত্র থাকবে না। পাহাড় থেকে বক্সাইট আর লোহার আকরিক আহরণ, ভারতের ৮৫ শতাংশ মানুষকে তাদের জমি থেকে উত্খাত করে শহরে নিয়ে আসতে ভারতকে পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে। সামরিকায়নের পথে যেতে হবে। সামরিকায়নের জন্য দেখাতে হবে শত্রুর জুজুভীতি। আর মাওবাদীরা হলো সেই ‘শত্রু’। হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে মুসলমানরা যেমন, করপোরেট মৌলবাদীদের কাছে মাওবাদীরাও তেমন। শুধু কয়েক হাজার মাওবাদীকে বন থেকে বের করে আনতে এত আয়োজন—এমন ভাবনা হবে বিরাট ভুল।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: আহসান হাবীব
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও সমাজকর্মী।
No comments